ইকোনমিস্টের রিপোর্ট ॥ অর্থনৈতিক অবস্থানে চীন ও ভারতের চেয়ে কম ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

29

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী নোভেল করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে মানুষ ঘরবন্দী। প্রাণ সংহারক এই ভাইরাস গ্রাস করতে চলেছে অর্থনীতিও। করোনার প্রভাবে উন্নত-অনুন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশেরই যখন অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে তখন সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। গত শনিবার অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিচারে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে অর্থ বাণিজ্যের সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’। এতে বলা হয়, বিশ্বের ৬৬টি দেশের এই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে নবম স্থানে, যা চীন ও ভারতের চেয়েও ভাল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল বাংলাদেশের নামই তুলনামূলক নিরাপদে থাকা দেশের তালিকার শীর্ষ দশে এসেছে। এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, করোনার প্রভাবে জিডিপিতে ধস নামার শঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশ কার্যত সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে। সংস্থাটি বলছে, করোনা বিদায় নিলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো, চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারত, সৌদি আরব, পাকিস্তানের মতো দেশকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের। গত মাসের মাঝামাঝি বিশ^ব্যাংকের এক পূর্বাভাসে জিডিপি কমার কথা বলা হলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, কোভিড-১৯ সামলাতে পারলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা করে দেশের শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ আশার আলো দেখিয়েছে। তারা বলছেন, করোনা চলে গেলে বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করা গেলে তৈরি পোশাক খাতের একটা উল্লম্ফন দেখা যাবে।
জানা যায়, পৃথিবীর অর্থনীতির আকার মোটামুটি ৮০ ট্রিলিয়ন ডলারের। নোভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব ছিল আনুমানিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের। কিন্তু আপাতত এই হিসাব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নোভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্থবির বিশ্ব অর্থনীতি। এশিয়া থেকে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া কিংবা আফ্রিকা-সবখানেই এক ধরনের অচলাবস্থা। উৎপাদনও নেমেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। তারপরও কিছু কিছু দেশ শিথিল করেছে লকডাউন। অর্থনীতি বাঁচাতে খোলা হচ্ছে দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা বন্ধ থাকায় তিন দশকের মধ্যে এবারই প্রথম বছরের শুরুর তিন মাসে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে চীন সরকার। ইউরোপ ও আমেরিকায় মহামারীর প্রকোপ শুরু হয়েছে পরে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশেই এখনও লকডাউন ওঠেনি। তাদের ক্ষতির তথ্যও সুনির্দিষ্টভাবে আসতে শুরু করেনি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাসহ শতাধিক দেশ ইতোমধ্যে আইএমএফ এর সহায়তা চেয়েছে। মিসরের মত কোন কোন দেশ আগের ঋণ শুধতে না পেরে বেইল আউট চেয়েছে। ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সের বরাত দিয়ে ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর বন্ড ও শেয়ার বাজার থেকে গত চার মাসে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি তুলে নিয়েছে। তুলে নেয়া অর্থের এই অঙ্ক ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময়ের তিনগুণ।
গত শনিবার অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিচারে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে অর্থ বাণিজ্যের সাময়িকী ইকোনমিস্ট, যেখানে করোনাভাইরাস সঙ্কটে সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে থাকা দশ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বিশ্বের ৬৬টি দেশের এই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে নবম স্থানে, যা চীন ও ভারতের চেয়েও ভাল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল বাংলাদেশের নামই তুলনামূলক নিরাপদে থাকা দেশের তালিকার শীর্ষ দশে এসেছে। ইকোনমিস্ট লিখেছে, কোভিড-১৯ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে অন্তত তিনভাবে। লকডাউনের কারণে মানুষ ঘরে থাকতে বাধ্য হওয়ায় উৎপাদনও বন্ধ থাকছে। বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় রফতানি আয় কমে যাচ্ছে। আর বিশ্বের বড় একটি অংশ বেকায়দায় থাকায় বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহেও টান পড়ছে। এই মহামারী যদি জুলাইয়ের আগেও থিতিয়ে আসে, তারপরও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জিডিপি এবার আইএমএফের গত অক্টোবরের পূর্বাভাস থেকে ৬.৬ শতাংশ কম হবে বলে মনে করছে ইকোনমিস্ট। সঙ্কট মোকাবেলা করতে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অন্তত আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হতে পারে বলে ইকোনমিস্টের ধারণা। আর এই টাকা তাদের সংগ্রহ করতে হবে বিদেশ থেকে, অথবা নিজেদের রিজার্ভ ভেঙ্গে চলতে হবে। ইকোনমিস্ট লিখেছে, করোনাভাইরাসের মহামারীর অভিঘাতে কোন দেশ অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে এবং কোন দেশ তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থায় আছে, তা বুঝতে এই তালিকা করেছে তারা। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর শক্তি আর দুর্বলতার জায়গা বিচার করতে গিয়ে চারটি সূচক ইকোনমিস্ট বিবেচনায় নিয়েছে। এগুলো হলো- জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারের ঋণ, বিদেশী ঋণ, ঋণের সুদ এবং রিজার্ভ। করোনাভাইরাস সঙ্কটে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ অবস্থায় থাকা শীর্ষ দশ হলো- বতসোয়ানা, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, পেরু, রাশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, বাংলাদেশ ও চীন। আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দশ দেশ হলো- ভেনিজুয়েলা, লেবানন, জাম্বিয়া, বাহরাইন, এ্যাঙ্গোলা, শ্রীলঙ্কা, তিউনিশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ওমান ও আর্জেন্টিনা। ইকোনমিস্টের বিচারে ঝুঁকির বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ৬৬ দেশের এই তালিকায় ভারত ১৮, পাকিস্তান ৪৩ এবং শ্রীলঙ্কা ৬১তম অবস্থানে রয়েছে।
এদিকে বিশ^জুড়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ধস নামার শঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশ কার্যত সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, গোটা বিশ্বেই আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে ব্যাপকভাবে। করোনা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাতে পারে তার চিত্র তুলে ধরেছে আইএমএফ। সেই তালিকায় দেশভিত্তিক প্রস্তাবিত জিডিপি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ রয়েছে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে। সংস্থাটি ২০১৯ সালে কোন দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার কেমন ছিল আর ২০২০ সালে কেমন হতে পারে এবং করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি বৃদ্ধির হার কেমন হতে পারে তার আগাম পূর্বাভাস দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির একটা দিক নির্দেশও রয়েছে তাদের পূর্বাভাসে। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ; সেখান থেকে এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে সেই হার নেমে যেতে পারে ঋণাত্মক বৃদ্ধিতে (-৩ শতাংশ)। তবে ২০২১ সালে বৃদ্ধির হার হতে পারে ২০১৯ সালের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আইএমএফের পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, করোনায় বিশ্বের অনেক দেশের জিডিপিতে ধস নামার আশঙ্কা তৈরি হলেও কার্যত সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি হয়েছিল। করোনার প্রভাবের মধ্যেও বাংলাদেশ সেই হার ২ শতাংশ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে বলে মত আইএমএফের। আর ২০২১ সালে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া উন্নত ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেরই ২০২০ সালে ঋণাত্মক বৃদ্ধির সম্ভাবনা।
যদিও করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ হতে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের ওপর এ প্রাক্কলন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের জিডিপি অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরে ছিল ৮.২ শতাংশ। এই বৈশ্বিক ঋণদান সংস্থার পূর্বাভাসে শুধু এ বছর নয়, আগামী অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়াবে ১.২ থেকে ২.৯ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে একটু ঘুরে দাঁড়ালেও তা ৪ শতাংশে নিচেই থাকবে।
কিন্তু নোভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি জোরালোই থাকবে বলে মনে করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আগের বছরের চেয়ে কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থাটি। প্রবৃদ্ধির কিছুটা শ্লথ গতির পেছনে বৈশ্বিক চাহিদায় নেতিবাচক প্রবণতার কথা গত এপ্রিলে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০২০ নামে সংস্থাটির শীর্ষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, দ্রুত বর্ধনশীল তৈরি পোশাকের রফতানির বড় বাজারগুলো থেকে চাহিদা কমায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে নামবে। তবে বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আস্থার উন্নয়ন হলে ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি কিছুটা এগিয়ে ৮ শতাংশে উঠতে পারে বলে আশা করছে এডিবি। এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন পারকাশ এক বিবৃতিতে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালই করছে।
এরমধ্যে করোনাভাইরাসের সঙ্কট কেটে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য সম্ভাবনা দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈশ্বিক ঝুঁকি চলে গেলে অল্প মূল্যের গার্মেন্টস পণ্য কেনার চাহিদা বাড়বে। যেহেতু অনেকের আয় কমে যাবে, ফলে কম মূল্যের পণ্যের চাহিদা বাড়বে। যেগুলোর জন্য আমাদের দেশের চাহিদা তৈরি হবে। ফলে, এটি আমাদের দেশের জন্য একটি সুযোগ বা সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, ২০০৮-০৯ সালে যে বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, তারপর আমরা দ্রুত ফিরে আসতে পেরেছিলাম। ২০১০ সালের জানুয়ারির পর দ্রুততার সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তৈরি পোশাক খাত-বহির্ভূত অন্যান্য খাতেরও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, পরবর্তী মাসগুলোতে। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি, করোনা চলে গেলে বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করা গেলে এই খাতের একটা উল্লম্ফন দেখা যাবে।
মূলত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা করে দেশের শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণেদনা প্যাকেজ আশার আলো দেখিয়েছে।