কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ শেষ হতে চলল আল্লাহর অবারিত রহমতের প্রতিশ্রুত মাহে রমজানের প্রথম দশক। এ মাস জামাতবদ্ধ পাঞ্জেগানা নামাজের একটি উত্তম মৌসুম। তাই নামাজের ওয়াক্ত সম্পর্কে কিছু মাসালা অবগত হওয়া সময় উপযোগী। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে এক দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, হযরত রাসুলে মাকবুল (স) বলেছেন- হযরত জিব্রাইল (আ) আল্লাহর নির্দেশে কা’বা শরীফের নিকট দুইবার নামাজের ওয়াক্ত নির্ধারণ করার জন্য ইমামতি করে নামাজ পড়িয়েছেন। প্রথমবার যখন ফিরিশতা জিব্রাইল (আ) নামাজ পড়ালেন তখন তিনি আমাকে জোহর নামাজ পড়ালেন-যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ল অর্থাৎ এটা ছিল জোহরের প্রথম ওয়াক্ত। তখন কেবল মাত্র সূর্য ঢলে পড়েছিল, যার ছায়ার পরিমাণ ছিল জুতায় ব্যবহৃত ফিতার সমান।
আর সালাতুল আছর পড়ালেন যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার একগুণ দীর্ঘ হলো। তিনি আমাকে মাগরিবের নামাজ পড়ালেন যখন রোজাদার ইফতার করেন অর্থাৎ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই এবং এশার নামাজ পড়ালেন রক্তিম আভা (শফক) পশ্চিমাকাশ থেকে যখন বিলীন হয়ে গেল। আর ফজরের নামাজ পড়ালেন যখন রোজাদারের ওপর পানাহার নিষিদ্ধ হয় তখন অর্থাৎ সুবহে সাদিকের শুরু লগ্নে। সর্বোপরি জিব্রাইল (আ) প্রথম ইমামতি করে নামাজ আদায় করার সময় প্রত্যেক ওয়াক্তে কেবল প্রথম ওয়াক্তে নামাজ পড়িয়েছিলেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ইরশাদ করেন- দ্বিতীয়বার হযরত জিব্রাইল (আ) আবার ইমামতি করলেন, তখন এমন সময় জোহরের নামাজ পড়ালেন যখন কোন বস্তুর ছায়া তার একগুণ দীর্ঘ হয়ে গেল এবং আছরের নামাজ পড়ালেন যখন ছায়া দ্বিগুণ দীর্ঘ হলো। আর মাগরিবের নামাজ আগের দিনের মতো অর্থাৎ একই সময়ে আদায় করালেন যখন কোন রোজাদার ইফতার করে। এশার নামাজ পড়ালেন যখন রাতের একতৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়ে গেল। সবশেষে যখন ফজরের নামাজ পড়ালেন তখন পূর্বাকাশে ঊষা আলোকিত হলো অর্থাৎ পরিষ্কার হয়েছে। সর্বোপরি দ্বিতীয় দিনের নামাজ পড়িয়েছেন শেষ ওয়াক্ত চিহ্নিত করার জন্য।
পেয়ারা নবী হযরত রাসুলে মাকবুল (স) বলেন- নামাজ শেষ করে হযরত জিব্রাইল (আ) আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স)! ইহা আপনার পূর্ববর্তী নবী (আ) গণের নামাজের সময়। আর নামাজের সময় প্রদর্শিত এই দুই সময়ের মধ্যখানে। (তিরমিজি শরীফ)।
ফজরের নামাজ অন্ধকারে না ঊষা (বা আকাশ ফর্সা) হলে পড়া উত্তম, এ বিষয়ে শরীয়ত অভিজ্ঞ ইমামগণের বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়- ইমাম শাফেয়ী, আহমদ, মালিক, ইসহাক (র) প্রমুখের মতে ফজরের নামাজ অন্ধকারের মধ্যে পড়া উত্তম। ইমাম আবু হানিফা (র) ও আবু ইউসুফ (র)-এর মতে, ফজরের নামাজ আছফার (ফর্সা) এর মধ্যে শেষ করা উত্তম। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, ফজরের নামাজ আলোতে পড়লে জামায়াতে বেশিসংখ্যক লোক অংশ নিতে পারে।
ইমামদের সর্বসম্মতিক্রমে শীতকালে জোহরের নামাজ তাড়াতাড়ি আদায় করা উত্তম। তবে গ্রীষ্মকালে জোহরের নামাজের মুস্তাহাব সময় সম্পর্কে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী, মালেক ও আহমদ (র) প্রমুখের মত অনুযায়ী জোহরের নামাজ সব ঋতুতে তাড়াতাড়ি পড়া উত্তম। তবে কেবল মাত্র ৪টি শর্ত সাপেক্ষে দেরিতে পড়া উত্তম। যথা-১. গ্রীষ্ম প্রধান দেশ হওয়া। ২. প্রচন্ড গরম পড়া। ৩. জামায়াতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা এবং ৪. দূরবর্তী এলাকা হতে লোকদের উপস্থিত হওয়া।
আছরের নামাজের মুস্তাহাব বা উত্তম ওয়াক্ত সম্পর্কে ইমামদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। ইমাম শাফেয়ী, মালেক, আহমদ, ইসহাক ইবনে মুবারক প্রমুখের মতে, আছরের নামাজ তাড়াতাড়ি পড়া উত্তম। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, আছরের নামাজ সূর্যের রং হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিলম্ব করে পড়া উত্তম। কেননা হযরত আলী ইবনে শায়বান বলেন, আমরা নবী করীম (স) এর নিকট আসলাম, অতপর তিনি আছরের নামাজকে সূর্য পরিষ্কার সাদা থাকা পর্যন্ত (অর্থাৎ রক্তিম বর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত) দেরি করে আদায় করলেন।-(আবুদাউদ)।
সকল ইমামের ঐকমত্যে সূর্যাস্তের পর হতেই মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। তবে এর শেষ ওয়াক্ত নিয়ে বিশেষজ্ঞ ইমাম ও আইনবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী, মালেক, আউযায়ী, ইবনে মোবারক প্রমুখের মতে, সূর্যাস্তের পর পবিত্রতা অর্জন করে আজান ও ইকামত সম্পন্ন করত: পাঁচ রাকাত নামাজ আদায় করা পরিমাণ সময় পর্যন্ত মাগরিবের সময় থাকে। এরপর পড়লে কাযা হবে। তাদের দলিল হলো, হাদিসে জিব্রাইল যাতে বলা হয়েছে-জিব্রাইল (আ) দু’দিনে মাগরিবের নামাজ একই সময়ে আদায় করেছেন।
হযরত ইমাম আবু হানিফা, আহমদ, আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ, সুফিয়ান সাওরী, ইসহাক প্রমুখের মতে, শফক গায়েব হওয়া পর্যন্ত মাগরিবের ওয়াক্ত বাকি থাকে। কেননা সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (স) বলেছেন, যখন তোমরা মাগরিবের নামাজ পড়বে তবে তার সময়সীমা হচ্ছে শফক বিলীন হওয়া পর্যন্ত। -(মুসলিম)।
হযরত ইমাম শাফেয়ী, মালেক ও আহমদের দৃষ্টিতে ‘শফক’ মানে লাল আভা, ইমাম আবু হানিফার মতে, লালিমা বিদূরিত হবার পর যে সাদা রেখা প্রকাশিত হয় তা-ই শফক। শফক গায়েব হওয়ার পর থেকেই এশার নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। তবে এর শেষ সময় সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে- ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক, আহমদ প্রমুখের মতে, সুবহে সাদিক প্রকাশিত হবার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত এশার নামাজের ওয়াক্ত বাকি থাকে। এশার নামাজ অর্ধরাতের শেষে পড়া মাকরুহ এবং রাতের প্রথম এক তৃতীয়াংশে পড়া উত্তম।
উল্লেখ্য, নামাজের মাকরুহ সময় মোট ৬টি। তন্মধ্যে ৩টি সময়ে ফরজ, নফল, কাযা সব ধরনের নামাজ পড়া হারাম, যেগুলোকে আওকাতে মানহিয়্যা বা নিষিদ্ধ সময়ও বলা হয়। সেগুলো হলো-১. সূর্য উদয়ের সময়, ২. ঠিক দুপুরের সময় এবং ৩. সূর্যাস্তের সময়। এছাড়া মাকরুহ বাকি তিনটি সময় হলো-১. ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে কোন নফল নামাজ পড়া। ২. আছরের নামাজের পর সূর্যাস্তের পূর্বে কোন নফল নামাজ পড়া এবং ৩. দুই ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর ঈদের নামাজের পূর্বে কোন নফল নামাজ পড়া।
পাঞ্জেগানা নামাজের সত্যিকার মুসল্লিদের জন্য উপরোক্ত নামাজের সময়সীমা, উত্তম ওয়াক্ত, নিষিদ্ধ সময় প্রভৃতি ধারণা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে নামাজ শুদ্ধ ও অশুদ্ধের ব্যাপার, সওয়াব বেশ কমের ব্যাপার।