ক্ষণগণনা উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী ॥ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয়

113
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে মুজিব বর্ষের ক্ষণগণনা সূচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সঙ্গে ছিলেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঐতিহাসিক জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে উৎসবমুখর পরিবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষের জমকালো ও বর্ণাঢ্য ‘ক্ষণগণনা’র উদ্বোধন করে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অন্ধকার সময় কাটিয়ে আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি। মাঝখানে একটা কালো অধ্যায় আমাদের জীবন থেকে চলে গেছে। বাংলাদেশে মাঝখানে যে কালো অধ্যায় গেছে, সে কালো অধ্যায় যেন আর কোনদিন ফিরে না আসে। সেই কালো অধ্যায় যেন আর কোন দিন আমাদের দেশের মানুষের ওপর ছায়া ফেলতে না পারে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে বিজয়ের যে ‘আলোকবর্তিকা’ তুলে দিয়েছেন, তা নিয়েই আগামী দিনের পথচলার কথা জানিয়ে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, যে বিজয়ের আলোকবর্তিকা জাতির পিতা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, সে মশাল নিয়েই আমরা আগামী দিনে চলতে চাই। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কখনও মাথানত করে না, করবেও না। উন্নত জাতি হিসেবে সারাবিশ্বে দেশের মানুষ মাথা উঁচু করে চলছে, এই হোক আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা। আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেদিনটিতে আমরা হয়তো বিমানবন্দরে আসতে পারিনি, তখন আমার বাচ্চাটি ছোট ছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে, ওই সময় আমার মা (ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) সর্বক্ষণ একটি রেডিও নিয়ে বসেছিলেন, ধারাবাহিক বিবরণ শুনছিলেন, আমরা পাশে বসে সারাক্ষণ ধারাবিবরণী শুনছিলাম।
দেশের জনগণের প্রতি বাবা বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালবাসার কথা তুলে ধর বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মনে পড়ে, জাতির পিতা কিন্তু বাংলার মাটিতে নেমে আমাদের কথা ভাবেননি, পরিবারের কথা ভাবেননি। তিনি চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে তাঁর প্রিয় জনগণের কাছে, তাঁর প্রিয় মানুষগুলোর কাছেই তিনি সর্বপ্রথম পৌঁছে যান। তারপর আমরা তাঁকে পাই। কারণ তিনি এদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালবেসেছেন। চেয়েছিলেন এ দেশের মানুষ সুন্দর জীবন পাবে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী কবিগুরুর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি’। তারই উত্তর বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন এই ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। উত্তরে জাতির পিতা বলেছিলেন- ‘কবিগুরু দেখে যান আপনার সাত কোটি মানুষ আজ মানুষ হয়েছে, তারা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে।’
তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ যেন জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলে এই বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে, সেই কামনা করছি ক্ষণগণনার এই শুভলগ্নে। চলুন আজকের দিনে আমরা সেই প্রত্যয় নিই যে, এই বাংলাদেশ কারও কাছে মাথানত করে না, বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতি মাথা উঁচু করে চলবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সেই সোনার বাংলা ইনশাআল্লাহ আমরা গড়ে তুলবো।
শুক্রবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে রাজধানীর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। জাঁকালো অনুষ্ঠানে মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনার ঘড়িও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ল্যাপটপের মাধ্যমে প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে ক্ষণগণনার উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপিত ক্ষণগণনার ঘড়িও একসঙ্গে চালু হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি প্রতিবছরই উদযাপন করে কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি। কিন্তু এবারই প্রথম ব্যতিক্রমী উদ্যাপনে রাজধানীর তেজগাঁও জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর সেই প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক দৃশ্য প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যা দেখে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মধ্যে একটি আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার প্রতীকী অবতরণ দেখে কেঁদেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেঁদেছেন তাঁর বোন শেখ রেহানাও। বেঁচে থাকলে এই বছরই ১০০ বছর পূর্ণ করতেন জাতির জনক; আর তাই তাঁর জন্মশতবার্ষিকীটা ঘটা করে উদ্যাপনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ, তার ক্ষণগণনা শুরু হয় পুরনো বিমানবন্দরের এই জমকালো অনুষ্ঠান থেকেই।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দৌহিত্র প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়সহ তাঁদের পরিবারের সদস্য, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, দুই হাজারেরও বেশি দেশী-বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথি এবং দশ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত দর্শকের উপস্থিতিতে শুক্রবার বিকেলে স্মরণ করা হলো সেই মুহূর্তটিকে, যেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনন্দ।
আমন্ত্রিত অতিথি ও নিবন্ধিতদের জন্য দুপুরের পর থেকেই উন্মুক্ত করে দেয়া হয় অনুষ্ঠানস্থলের নির্ধারিত প্রবেশ পথগুলো। সবাইকে নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বেলা দুইটা থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করে।
বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু হয় মূল অনুষ্ঠানপর্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক মোঃ রফিকুল ইসলাম ও প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে এসে নির্ধারিত আসনে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।
আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান, প্রবীণ আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমান, কবি-সাংবাদিক নির্মলেন্দু গুণ, অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য, সামরিক- বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, বিদেশী বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধি, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনের তারকা ব্যক্তি, জাতীয় দলের ক্রিকেটার, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ করেন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি।
মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে পুরনো বিমানবন্দরে অবতরণ করে একটি উড়োজাহাজ। পাকিস্তানের কারগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন পর লন্ডন হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের এরকম একটি উড়োজাহাজে (সদ্য কেনা সি-১৩০ জে) করেই সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে পৌঁছান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বিমানটি ধীরে ধীরে এসে টারমাকে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে থামে। এ সময় বাজানো হয় দু’বাংলার কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই গান- ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়, ঘরে ঘরে এতো খুশি তাই..’।
বিমানটি টারমাকে পৌঁছানোর পর দরজা খোলা হলে ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। লাখো শহীদের রক্ত স্নাত জাতীয় পতাকা হাতে ১৫০ জন তখন সেখানে লাল গালিচার পাশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তাদের জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে আর লেজার লাইটের মাধ্যমে বিমানের দরজার ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রূপক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে লাল গালিচার মাথায় ছোট্ট মঞ্চে এসে থেমে যায়। এরপর গার্ড অব অনার দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। এ সময় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হলে সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে। উপস্থিত সবার কণ্ঠে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড।
বঙ্গবন্ধু যে আলোকবর্তিকা হয়ে সেদিন দেশে ফিরেছিলেন, তারই প্রতীকী উপস্থাপনা ছিল এ আয়োজন। এরপর ছোট বোন শেখ রেহানা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার পর মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন ও ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন ল্যাপটপের বোতাম চেপে। দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের ২৮টি স্পটে, ৫৩ জেলায় ও দুটি উপজেলা মিলিয়ে অসংখ্য জায়গায় বসানো কাউন্টডাউন ক্লকও সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায়। এই সময় জাতীয় পতাকার রঙের লাল-সবুজের বেলুন এবং একশ’টি শান্তির প্রতীক পায়রা উড়ানো হয়। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। এই ক্ষণগণনা শেষে আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সূচনা হবে মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের; বছরজুড়ে চলবে সেই আয়োজন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রয়েছে নানা বর্ণাঢ্য আয়োজন।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাঙালি আত্মপরিচয় পেত না
মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার কর্মসূচী উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে জাতি হিসেবে বাঙালি আত্মপরিচয় পেত না। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও স্বাধীনতার পূর্ণতা পায়নি দেশের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা বন্দিদশায় ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলেও ১৭ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর মেজর অশোক তারার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে। ওই সময় মানুষের মুখে হাসি দেখি। যারা যুদ্ধে সব হারিয়েছেন, সেই ব্যথা-বেদনার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন প্রিয় নেতাকে পেয়ে।
দেশকে স্বাধীন করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলার দুঃখী মানুষের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর তাঁর মূল্যবান জীবনটা কাটিয়েছেন কারাগারে। এদেশের মানুষ যেন অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা পায়- এটি ছিল তাঁর স্বপ্ন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের মিলানওয়ালি কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে রাখা হয়। সেই জেলাখানায় গরমের সময় প্রচন্ড গরম, আর শীতের সময় প্রচন্ড শীত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ ৯ মাস তিনি ওই নির্জন কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, দেশ স্বাধীন হবে, দেশের মানুষ মুক্তি পাবে। এ কারণে শত কষ্টের মধ্যেও কখনও তিনি চিন্তিত ছিলেন না। বরং যখনই তাঁকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হতো, তিনি জয় বাংলা শ্লোগান দিতেন। বাংলাদেশের জনগণ এই জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিল।
দেশের জনগণ, ভোটার ও নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন দেয়া সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলার জনগণের প্রতি। নির্বাচনী জয়ী হয়ে জাতির পিতার প্রত্যাবর্তন দিবসে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা শুরু করলাম। আজকে যে আয়োজন হয়েছে, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের রেপ্লিকায় সেই দিনটি স্মরণ করা হলো। এই কাজের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।’
মুজিবীয় আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা হবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি, কিন্তু তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল বাংলার মাটিতে। বাংলাদেশে মাঝখানে যে কালো অধ্যায় গেছে, সে কালো অধ্যায় যেন আর কোনদিন ফিরে না আসে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ দিয়ে গেছেন। তাঁর জীবনের ২৪ বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন। পাকিস্তানের শাসক কোনদিনও চায়নি বাঙালীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানের শাসন মূলত অচল হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের কোন নির্দেশ বাঙালীরা মানতো না। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কোন কাজ হতো না। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিতেন, বাঙালী জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদাররা দেশে গণহত্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জাতির পিতা আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগের নেতারা তা মাইকিং করে সারাদেশে প্রচার করে। বাঙালি জাতির বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী যার কাছে যা কিছু আসে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভারতসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর্থন ও সহায়তা প্রদানকারী রাষ্ট্র ও সেসব দেশের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা ভুট্টো ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমে লন্ডনে যান, সেখান থেকে দিল্লী হয়ে এই ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু, পূর্ণতা পায় দেশের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা এবং ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধের কথা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের প্রকৃতি ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধু নাম মুছে ফেলার চেষ্টার পাশাপাশি ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণ সারাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কোর প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে। অন্ধকার থেকে দেশ আবারও আলোর পথে যাত্রা শুরু করে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই মুক্তিযুদ্ধের সেই অমিততেজী স্লোগান- ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধরলে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান ধরে গোটা এলাকাকে প্রকম্পিত করে তোলেন।