কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, দেশকে জঙ্গিবাদ, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করতে কাজ শুরু করা হয়েছে। এটি চালিয়ে যাওয়া হবে। দেশকে যখন আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তখনই দেখা যাচ্ছে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই যারাই অপরাধী হোক না কেন তাদের কোন ক্ষমা নেই। আমরা কোন অন্যায়-অবিচার বরদাশত করব না।
রবিবার গণভবনে আওয়ামী যুবলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচিত যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগের সকল কর্মকান্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া সম্মেলনের জন্য চয়ন ইসলামকে আহ্বায়ক এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদকে সদস্য-সচিব করে যুবলীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ৫৫ বছরের অধিক কেউ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে আসতে পারবে না।
সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় মানুষকে সমবেত করার পেছনে উদ্দেশ্য কী, এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন- সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হলো, যে আইডিটা হ্যাকিং করে এই ধরনের ঘটনা ঘটাল আর সেটাকে কেন্দ্র করে কী উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সমবেত হলো এবং পুলিশের ওপর আক্রমণ করল; তাদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল সেটাই বড় কথা। এরপর থেকে দেখা যাচ্ছে, ফেসবুকে নানা ধরনের অপপ্রচার সব জায়গায় ছড়ানো হচ্ছে একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য। তাহলে এরা কারা? এদের উদ্দেশ্যটা কী? অবশ্যই যারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় তাদেরকেও খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ভোলার বোরহানউদ্দিনে একটি হিন্দু ছেলে তার ফেসবুকের আইডি হ্যাকিং করে সেখানে তার নাম দিয়ে কতক মিথ্যাচার করা হয়েছে। যার ফেসবুক হ্যাকিং করেছে তারা আবার তাকে ফোন করে বিশ হাজার টাকা চেয়েছে। বিশ হাজার টাকা না দিলে তার ফেসবুক আইডিতে এমনসব কথা লিখবে যেটা তার জন্য ক্ষতি হবে। এই কথাটা পাওয়ার পর পরই ওই হিন্দু ছেলেটা পুলিশ স্টেশনে গেছে। সে সেখানে একটা জিডিও করেছে। জিডি করা সত্ত্বেও সেখানে তাকে কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে যে টেলিফোনটা করেছিল তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ফেসবুক আইডি হ্যাকিং হলে পরে ফেসবুক অপারেটর যারা তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তাদের কাছ থেকে আমরা সমস্ত তথ্য যোগাড় করতে পারব।
তিনি বলেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গেছে। যারা ফেসবুকে এই হিন্দু ছেলেটার আইডি হ্যাকিং করে তার কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে তার নাম করে যে কথাগুলো লিখেছে, সে তো একজন মুসলমান ছেলে। একজন মুসলমান হয়ে কীভাবে নবী করিমকে (সা.) নিয়ে এই ধরনের বাজে কথা লেখে এবং আরেকজনকে জড়াবার চেষ্টা করতে পারে? তিনি বলেন, সেই কথা ধরে সেখানকার লোক একজন পীর সাহেব আছেন বেশ কিছু লোককে সে জড়ো করে। যখন পুলিশ তাদেরকে বোঝাচ্ছে আপনারা এগুলো করবেন না, আমরা ছেলেটাকে গ্রেফতার করেছি। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এরপরও পুলিশের ওপর তারা চড়াও হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশের ওপর চড়াও হলে, পুলিশ নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য একটা ঘরে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয়ার পরও তারা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। সেই সময় সেখানে এসপি, ডিসি সকলেই পৌঁছে যায়। পুলিশকে রক্ষা করা এবং সাধারণ মানুষ যারা ছিল সেখানে, যারা তাদেরকে বোঝাতে গিয়েছিল তাদেরকে রক্ষার জন্য পুলিশ গুলি ছুঁড়লে অনেকে আহত হয়। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, কেউ যদি সত্যিকার ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, যদি তাদের নবী করিম (সা.) প্রতি এতটুকু সম্মান থাকে তাহলে আরেকজনের ক্ষতি করার জন্য এই ধরনের জঘন্য কথাটা কীভাবে লেখে? এটাও আমার একটা প্রশ্ন। কাজেই আমি এই ব্যাপারে দেশবাসীকে বলব, সবাইকে ধৈর্য ধরতে। আর যারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় তাদেরকেও খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশে একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এই সমস্ত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। যখনই দেখা যায় দেশটা একটু ভালভাবে চলছে, অগ্রগতি হচ্ছে, তখনই একটা শ্রেণী আছে নানাভাবে একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। এটা যেন কোনভাবে করতে না পারে সেজন্য আমি সাধারণ মানুষসহ দেশবাসীর কাছে সহযোগিতা চাই। দেশবাসীর কাছে আমার একটাই আহ্বান থাকবে সকলের ধৈর্য ধরতে হবে। কেউ যদি আমাদের নবী করিম (সা.) বিরুদ্ধে কিছু লেখে থাকে নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যের ক্ষতি করার জন্য যারা এই ধরনের কথা লেখে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ব্যবস্থা নেব। টেকনোলজি মানুষ যেমন ব্যবহার করতে পারে আবার কেউ অপকর্ম করলে সেটা ধরার টেকনোলজিও আছে। এটা ধরা পড়বে। কারণ, এই ছেলে যদি টেলিফোন করে টাকাটা না চাইত তাহলে তাকে খুঁজে বের করা মুশকিল হতো। তাই এই ধরনের ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করেছে। আরও যারা আছে আমরা তাদেরকে গ্রেফতার করব। আমরা ফেসবুক অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগও করেছি। আরও তথ্য আমরা বের করতে পারব।
গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব সময় সব জিনিস একেবারে ধারাবাহিক এমনভাবে প্রচার করবেন না যা একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। বরং যারা সত্যিকার অপরাধী তাদেরকে দেখান। কেন এভাবে আরেকজনের আইডি চুরি করবে, তাকে শেষ করতে তার কাছে চাঁদা চাইবে আর টাকা দিতে না পারলে তার নাম করে মিথ্যা প্রচার চালাবে? আর সেটাও চালাবে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বা মহানবীর বিরুদ্ধে! বরং এই অপরাধীদেরই শনাক্ত করা দরকার এবং তাদেরকে জাতির সামনে তুলে ধরা দরকার যে, তারা এ ধরনের জঘন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমি এটুকুই বলব এ ধরনের অনেক চক্রান্ত আমার বিরুদ্ধেও সব সময় হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল যেমন মানুষ ভোগ করছে, সে রকম এর কুফলও ভোগ করছে। নানা ধরনের বিপদে ফেলে দেয়। এটা যেন বিপদে ফেলতে না পারে অর্থাৎ গুজবে কান না দিয়ে সঠিক বিষয় জেনে নেয়া দরকার। তিনি বলেন, যার যার ধর্ম, তার তার কাছে। কাজেই সকল ধর্মের মানুষ এই দেশে সম্মানের সঙ্গে বাস করবে। এটাই আমাদের দেশের একটা নিয়ম এবং এটাই আমরা চাই যে, বাংলাদেশ যেন একটা শান্তিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠে।
যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যত সহযোগী সংগঠন আছে তাদের সকলের যেন একে একে সম্মেলন হয়, সেই পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছি। অনেক সময় নানা কারণে সম্মেলন দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আমরা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখব। এ ক্ষেত্রে যে-ই অপরাধী হবে তাদের কোন ক্ষমা নেই। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। কারণ আমরা যখন দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষের ভেতরে একটা লোভের সৃষ্টি হয়। যার ফল আমাদের সমাজটাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। কাজেই এই ধরনের অন্যায়-অবিচার বরদাশত করা হবে না।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সবাই ভাল থাকুক, সচ্ছল থাকুক। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হোক, সেটা আমরা চাই। কিন্তু অন্যায়ভাবে যদি কেউ কিছু করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, এটা একান্তভাবে প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কারণ যখন একটা পরিবর্তন আসে তখন দেখা যায় কিছু মানুষ হঠাৎ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। কিছু মানুষ গরিব থেকে যায়। এই আয় বৈষম্যটা যেন না থাকে সেদিকে দৃষ্টি রেখে আমরা একেবারে গ্রামের তৃণমূল মানুষেরও যেন আয় বৃদ্ধি পায়, তারাও যেন সচ্ছলভাবে থাকে, তারাও যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি এটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
চেয়ারম্যান ও চার প্রেসিডিয়াম সদস্য অনুপস্থিত : চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও চার প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়া অন্য ৩৪ সদস্য নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুবলীগের বৈঠক শুরু হয়। যুবলীগের ৭ম কংগ্রেস সম্পন্ন করার ইস্যু নিয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেন। বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদসহ অন্য সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ছাড়াও চার প্রেসিডিয়াম সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মীজানুর রহমান, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, শেখ আতিয়ার রহমান দিপু এ বৈঠকে অংশ নেননি।
তবে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে আছে প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ শামসুল আবেদীন, শহীদ সেরনিয়াবাত, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, ফারুক হোসেন, মাহবুবুর রহমান হীরন, আবদুস সাত্তার মাসুদ, আতাউর রহমান, এডভোকেট বেলাল হোসাইন, আলতাব হোসেন বাচ্চু, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, আবুল বাশার, মোহাম্মদ আলী খোকন, অধ্যাপক এবিএম আমজাদ হোসেন, আনোয়ারুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার নিখিল গুহ, শাহজাহান ভুইয়া মাখন, মোতাহার হোসেন সাজু, ডাঃ মোখলেছুজ্জামান হিরু, যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, সুব্রত পাল, মনজুর আলম শাহীন, নাসরিন জাহান চৌধুরী শেফালী, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এস জাহিদ, আমির হোসেন গাজী, বদিউল আলম, ফজলুল হক আতিক, আবু আহম্মেদ নাসিম পাভেল, আসাদুল হক, এমরান হোসেন খান, আজহার উদ্দিন ও ফারুক হাসান তুহিন।