কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাদক পাচারের কৌশলের শেষ নেই। প্রথমবারের মতো গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতরে মাদকের চালান জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। ইতোপূর্বে লাউ, কুমড়া, শুকনো মরিচ, জুতা, ইলিশ মাছ, কচ্ছপ ও নারীর অন্তর্বাস, গুহ্যদ্বার, পেট, পাকস্থলীর ভেতরে ইয়াবাসহ মাদক পাচার করে আসছে মাদক কারবারিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিতে কত ধরনের যে কৌশল-কায়দা করছে মাদক কারবারিরা তার কোন ইয়ত্তা নেই। মাদক পাচারকারীদের নিত্যনতুন ও ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল দেখে হতবাক হয়ে পড়েন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। বাংলাদেশে কোন মাদকদ্রব্য উৎপাদন হয় না। অথচ সারাদেশে প্রতিবছর লেনদেন হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মাদক। দেশের প্রায় ৬৮ লাখ মাদকাসক্তের জন্য সীমান্ত দিয়ে আসছে ২৪ ধরনের মাদকদ্রব্য। পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে অভিনব কায়দায় ঢুকছে মাদক। মাদকের রমরমা ব্যবসার উদ্দেশ্যে গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতরে চলছে মাদক পাচার। এমন একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশ বলছে, ভারত থেকে আসছে এসব মাদক। কৌশল পাল্টে নতুন নতুন কায়দায় মাদক ঢোকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি এমনই এক মাদকের চালান আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। ভারত থেকে মৌলভীবাজার হয়ে রাজধানীতে ঢুকছে মাদক, এমন খবরে উত্তরায় আগে থেকে ওৎপেতে গোয়েন্দারা। পরে ওই জায়গা থেকে জব্দ করা হয় একটি ট্রাক। খোদ রাজধানীতে ট্রাকে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার দেখে প্রথমে বিভ্রান্ত হন গোয়েন্দারা। পরে আটককৃত গাড়ি চালক ও হেলপারকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া যায়, এসব সিলিন্ডারের ভেতরেই লুকিয়ে রাখা আছে বিপুল পরিমাণ মাদক। বিশেষ কায়দায় সেগুলো খুলে একে একে বের করে আনা হয় শত কেজি গাঁজা। চালক জানায়, আগে আরও দু’বার আনা হয়, এবার নিয়ে তিন বার। হেলপারকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আগে কখনও ঢাকায় আসেনি, প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছি। তবে গোয়েন্দা অভিযানের আগেই পালিয়ে যায় মূল ব্যবস্যায়ী। ট্রাকে করে বিশেষভাবে গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতর লুকিয়ে ঢাকা নিয়ে আসছে মাদক। এমন খবর পেয়ে, অভিযান চালিয়ে সফল হয়েছি বলে গোয়েন্দা পুলিশের দাবি।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গতবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর দেশব্যাপী চলা অভিযানে রাজধানীতে জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ মাদক। ব্যবসা কিছুটা কমলেও নির্মূল হয়নি পুরোপুরি। জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানের মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মাদক কারবারিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে তাদের চোখে ধুলো দিতেই নানা ধরনের অভিনব উপায় অবলম্বন করে মাদক পাচার হচ্ছে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে এক ব্যক্তি। যিনি বিশেষ পদ্ধতিতে পাকস্থলী ভর্তি করে ইয়াবা নিয়ে কক্সবাজার থেকে বিমানে ঢাকায় এসেছিলেন। প্রায়শ স্থল ও জল সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইয়াবাই সবচেয়ে বেশি। আর ইয়াবা পাচারে বাহকদের অদ্ভুতকৌশলে বিস্মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। সর্বশেষ গত ১৮ আগস্ট বিশেষ কায়দায় পাকস্থলীতে করে চার হাজার ২০০ ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসার পর ইমাম হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। তাকে তল্লাশি করে কিছু না পেলেও তাদের সন্দেহ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ইমাম হোসেন জানান, পাকস্থলীতে করে চার হাজারের বেশি ইয়াবা নিয়ে এসেছেন তিনি। এক্সরে করার পর দেখা যায় পেটের ভেতরে সেসব ইয়াবার প্যাকেট। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রায় ১৮ ঘণ্টা সময় নিয়ে ইয়াবার প্যাকেটগুলো তার পেট থেকে বের করেন।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, মাদক পাচারের এমন ভয়ঙ্কর কৌশল আগে কখনও দেখা যায়নি। টেকনাফের বাসিন্দা ইমাম হোসেন মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের আন্তানায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যে কারণে লোকটি মারাও যেতে পারতেন। তিনি জানান, প্রায়ই তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক জব্দ করা হচ্ছে। যার মধ্যে ইয়াবাই বেশি। মরিচের ভেতরেও ইয়াবার চালান ধরা পড়েছে। সীমান্তে পাচারকারীদের ধরতে গিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচারের নিত্যনতুন কৌশল সম্পর্কে জানতে পারেন বিজিবি সদস্যরা। বিজিবির বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও ইউনিটের সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওইসব মাদক পাচারকারীকে আটক করতে সক্ষম হন।
বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য আটক করেছে বিজিবি। এরমধ্যে ৪৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৬ ইয়াবা, এক লাখ ৬৩ হাজার ৩৬৯ বোতল ফেনসিডিল, ১৩ হাজার ৭৬ কেজি গাঁজা, এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৩ বোতল বিদেশী মদ, ১৯ কেজি ২৪৮ গ্রাম হেরোইন, চার লাখ ৬৬ হাজার ১২৩ পিস বিভিন্ন ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট, ৪১ হাজার ৬৫২টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন, এক কোটি ১০ লাখ এক হাজার ৭৪৪ পিস বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ট্যাবলেট জব্দ করে বিজিবি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিতে মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে এসব মাদক পাচারের চেষ্টা চালিয়েছে। এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, জিআই পাইপ, পানির কলসিতে ইয়াবা তৈরির কেমিক্যাল, মহিলাদের অন্তর্বাস, পেট, পাকস্থলী, ইলিশ মাছ ও শুকনো মরিচও রয়েছে।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে ২৪ ধরনের মাদকের ছড়াছড়িতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক জব্দ হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশী মদ, বিদেশী মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এ ছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে। এসব দ্রব্যের নেশাজনিত চাহিদা থাকায় বেশিরভাগই ভেজাল উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই। নতুন প্রজন্ম এখন ইয়াবার প্রেমে উন্মাদ। ইয়াবা আকারে ছোট হওয়ায় সহজে বহন করা যায়। এ কারণে অন্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা সেবনকারী ও বিক্রেতারা খুব সহজে নিরাপদে সেবন ও বিক্রয় করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয় না। ভারত, মিয়ানমারের সীমান্ত পথে বাংলাদেশে নানা ধরনের মাদক আসছে। মাদক কারবারিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিতে নানা ধরনের অভিনব কায়দা-কৌশল অবলম্বন করছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি টাকার মাদকের চালান পাচার হচ্ছে। মাদকের কারণে নানা ধরনের অপরাধের জন্ম নেয়, সামাজিক অবক্ষয় হয়, অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণসহ নানাবিধ কারণে বর্তমানে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। মাদকবিরোধী অভিযানকে ফাঁকি দিয়ে মাদকের কাঁচাবাজার ধরতেই মাদক কারবারিরা অভিনব উপায় বেছে নিয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার দাবি।