কাজিরবাজার ডেস্ক :
নতুন করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতে আবেদন নিবেদন জানানো হলেও সবই নিষ্ফল। এদিকে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ দফায় দফায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে। এরপর মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল দু’দফা বাংলাদেশে এসে এ সংক্রান্ত আলোচনা চালিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, দু’দফায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়েও রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক মনোভাবে তা ভেস্তে গেছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার মনোভাবের নেপথ্যে দেশী-বিদেশী ও কিছু এনজিওর ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও চিহ্নিত হয়েছে। সরকার মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেই আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে সাধারণ অধিবেশন বসছে। এ অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সেদিকেই এখন দৃষ্টি বাংলাদেশের।
এদিকে রোহিঙ্গার ভারে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফ এলাকায় নেমে আসা বিপর্যয় কেবলই বিস্তৃত হচ্ছে। ৩২ আশ্রিত ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা সর্ব খাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে। এরা দোকানপাট, বাজার থেকে শুরু করে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের সবকিছুই অবাধে নিজেরা করছে। শুধু তাই নয়, এসব ক্যাম্প থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে চোরাচালান। মাদক ও মানব পাচার থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই যা রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে হচ্ছে না। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু আইন-কানুন থাকলেও সেসবের তোয়াক্কাই করছে না। সবই চলছে তাদের মর্জিমাফিক।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এসব লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে এলেও গত দু’বছরের বেশি সময়ের মধ্যে ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে এরা নিজেদের এদেশের বাসিন্দা হিসেবে ভাবতে শুরু করছে। দেশী-বিদেশী নিয়মিত ত্রাণ পাওয়া, অবাধ চলাফেরা, মোবাইলসহ আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা, আয় রোজগারে জড়িয়ে পড়া সবকিছুতেই এরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে সবকিছুতেই এরা একজোট হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি এদেশে থেকেই চালিয়ে যাওয়ার সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। অথচ আশ্রিত হিসেবে এসব রোহিঙ্গার এ জাতীয় কোন কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। মানবিক কারণেই তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সে মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে এদেশের আইন-কানুন, বিধিবিধান ক্ষেত্রবিশেষে আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনও এদের মেনে চলা অপরিহার্য। কিন্তু এসবের ধারে কাছেও এরা নেই। গত দু’বছর ধরে ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে করতে এরা বেপরোয়া মনোভাবে আশ্রয় ক্যাম্প থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। কক্সবাজার লিঙ্ক রোড থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট রাখা হয়েছে সত্যি, কিন্তু এসব চেকপোস্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত দু’বছর ধরে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ না করায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা প্রশ্রয় পেয়েছে বেশি। তারা তাদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করে চলেছে। টেকনাফ থেকে উখিয়ার কুতুপালং পর্যন্ত প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন যানবাহন কিংবা হেঁটেই এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যাওয়া আসা করছে তাদের ইচ্ছেমতো। পকেটে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতির কোন কাগজ নেই। আশ্রয় ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে গিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করছে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে। দিনের বেলায় ভাল মানুষের লেবাসধারী এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র হাতে ঘোরাফেরা করে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের হুমকি দিয়ে চলেছে।
নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের অনেকে প্রত্যাবাসন ফাঁকি দিতে ক্যাম্প থেকে চম্পটও দিচ্ছে। এদের কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে আগে থেকে বসবাসকারী পুরনো রোহিঙ্গাদের বাসাবাড়িতে। ‘বাংলাদেশী’ দাবিদার ওই রোহিঙ্গারা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ত্যাগে উৎসাহিত করছে বেশি। পুরনো রোহিঙ্গাদের পরিচালনাধীন মাদ্রাসা-এতিমখানায় পড়ছে রোহিঙ্গা শিশুদের একটি অংশ। শিক্ষকতা করছে রোহিঙ্গা মৌলবিরা। তারা সবাই ক্যাম্প ত্যাগকারী রোহিঙ্গা। তাদের নামে রেশন (ত্রাণ) তোলা হচ্ছে নিয়মিত। ক্যাম্পে একই ব্লকে অবস্থানকারী কেউ না কেউ ক্যাম্প পলাতক রোহিঙ্গাদের নামে ত্রাণ তুলে নিজেরাই ভাগ করে নিচ্ছে। ক্যাম্প ত্যাগকারী রোহিঙ্গারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের শহরের ভাড়া বাসায় নতুবা স্বজনদের জিম্মায় রেখে কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। এ পর্যন্ত ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর হদিস নেই। এসব কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এদিকে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রিত জুবাইর নামে এক রোহিঙ্গা যুবক জানান, এখানে তাদের দেখভাল করছে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা (আরএসও)। মিয়ানমারে না গেলে অন্য দেশে (বিদেশ) নিয়ে যাওয়া হবে বলে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়েই স্বদেশে ফিরে যাওয়া হবে বলে অবাস্তব আশ্বাসের বাণী শোনাচ্ছে ক্যাম্পে ঘাপটি মেরে থাকা আরসা, আরএসও ও মহিবুল্লাহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। মোবাইল ও সিম কেনার টাকা দিয়েছে এনজিও কর্মীরা। এছাড়াও আশ্রয় ক্যাম্পে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাচ্ছে নিয়মিত। তেল সাবান থেকে শুরু করে সব রকমের প্রসাধনী পর্যন্ত ত্রাণ হিসেবে মিলছে। এমনকি অনেকের ভাগ্যে ফার্নিচারও জুটেছে। এসব ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনপূর্ব দাবি পূরণ ও বিদেশে পাড়ি জমানোর আশ্বাস পেয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে আর আগ্রহী হচ্ছে না। অতিরিক্ত ত্রাণসামগ্রী আর এত আরাম-আয়েশ ফেলে রোহিঙ্গারা স্বদেশ রাখাইনেও সহজে ফিরে যেতে চাইছে না।