দেশে নতুন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে উচ্চবিত্তের সন্তানরা

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশে নতুন করে মাদকের বাজার সৃষ্টির চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া চক্র। মাদকের বাজারে প্রবেশ করাচ্ছে চার ধরনের নতুন ভয়ঙ্কর মাদক। নতুন মাদকের তালিকায় সদ্য যোগ হয়েছে- ম্যাজিক মাশরুম, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফেটামিন ও এস্কাফ সিরাপ। ইয়াবা ও হেরোইনের পাশাপাশি এই চার ধরনের মাদক প্রবেশ করার ঘটনাকে বাংলাদেশে নতুন মাদকের বাজার সৃষ্টির চেষ্টা বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, র‌্যাব ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের দাবি।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ও বাজার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন অন্যতম। প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে মাদককারবারিরা। তবু থেমে নেই নিত্য নতুন মাদকের আমদানি। চীন ও থাইল্যান্ডের কড়া অবস্থানের কারণে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা সরবরাহ বন্ধ হয়েছে দেশ দুটিতে। এরপর থেকেই মিয়ানমারের মাদককারবারিদের বড় বাজার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
২০১৮ সালে ইয়াবা ও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। এতে টান পড়ে সরবরাহে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বাজারে দেখা যাচ্ছে নতুন মাদকের দৌরাত্ম্য। মাদককারবারিদের এসব চক্র এখন লেনদেনও করছে মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইনে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কিছুই তাদের নজরদারির বাইরে নেই। যারা নতুন মাদক নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নতুন চার ধরনের মাদক : ইয়াবার বিরুদ্ধে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন হলো কারবারিরা সুবিধা করতে পারছিল না। এজন্য তারা চেষ্টায় ছিল নতুন মাদক বাজারে আনার। এখন বলা যায় মাদকের ট্রানজিশন পিরিয়ডের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে তারা। বিশ্বের আরও অনেক দেশেই এমনটা দেখা যায়। একটি মাদক এক বা দুই দশক চলে। এরপর কৌশলগত কারণেই নতুন কিছু নিয়ে আসে মাদকচক্র। বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকের বাজারে নতুন তালিকায় সদ্য যোগ হয়েছে- ম্যাজিক মাশরুম, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফেটামিন ও এস্কাফ সিরাপ। এর প্রতিটিই বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যারা এসব মাদক নিয়ে গ্রেফতার হয়েছে, দেখা গেছে তারা সবাই সচ্ছল পরিবারের সন্তান।
২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথমে আইস পিলসহ এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৭ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর ও ঝিগাতলায় অভিযান চালিয়ে আইস তৈরির ল্যাবেরও সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঝিগাতলার একটি বাসার বেজমেন্টে এই ল্যাব তৈরি করা হয়েছিল।
এলএসডিসহ মাদককারবারি গ্রেফতার : বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে এক নাইজিরিয়ান নাগরিককেও আইসসহ গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বিভিন্ন কেমিক্যালের বিক্রিয়া ঘটিয়ে তৈরি করা এই মাদক যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সাধারণত ধনী রাষ্ট্রের মাদকসেবীরা এটি গ্রহণ করে। এক গ্রামের দাম ৭-১০ হাজার টাকা।
মেথামফেটামিনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ অবস্থা আইস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইয়াবা তৈরিতেও এর ব্যবহার আছে। ইয়াবা আসক্তদের শরীরে একসময় অনেক ইয়াবা সেবনের পরেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তখন তারা সরাসরি মেথামফেটামিন গ্রহণ করে বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আইস উদ্ধার হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকেই দেশে এ মাদকের ব্যবহার বেড়েছে। গত ৬ জুলাই রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে ‘ম্যাজিক মাশরুম’সহ দুই যুবককে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে ম্যাজিক মাশরুমের পাঁচটি বার উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি বারে ২৪টি স্পাইস থাকে। গ্রেফতার দুজন হলেন- নাগিব হাসান অর্নব (২৫) ও তাইফুর রশিদ জাহিদ (২৩)। দুজনে বাংলাদেশে এসএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়ালেখা করেছেন। অর্নব ২০১৪ সালে কানাডায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষে সেখানে কর্মরত আছেন। সে-ই কানাডা থেকে এই ম্যাজিক মাশরুম বাংলাদেশে নিয়ে আসে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ড্রাগটি কেক ও চকলেট মিক্স অবস্থায় সেবন করা হয়। এ ছাড়া পাউডার ও ক্যাপসুল হিসেবেও পাওয়া যায়। এটি ব্যবহারে সেবনকারীর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এমনকি কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফ দেয়।
ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি : গত ৩০ মে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডিসহ (লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড) চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হঠাৎ কেন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় চালাল, সেটা তদন্ত করতে গিয়েই আমরা মাদকটির সন্ধান পাই।’ অত্যন্ত দামী এ মাদক ঢাকায় অনলাইনে বিক্রি করত ১৫টি গ্রুপ। যারা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তবে এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই মহাখালী থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এই মাদকের সন্ধান পায়। তারাও কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল।
গত জুনেই দেশে উদ্ধার হয় ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন বা ডিএমটি। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার লাভ রোডে অভিযান চালিয়ে ডিএমটিসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে ৬০০ মিলিগ্রাম ডিএমটি উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব দাবি করেছে, দেশে প্রথমবারের মতো ডিএমটি উদ্ধার হলো। এলএসডির চেয়ে ভয়ঙ্কর এই মাদক। এটা সেবনে হ্যালুসিনেশন হয়। সেবনের ৩০-৪০ মিনিট গভীর হ্যালুসিনেশন হয়। এতে সেবনকারী দ্রুত কল্পনার জগতে চলে যায়। এতে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। সেবনকারী মারাও যেতে পারে।
র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, এলএসডির মতো ডিএমটিওসেবীরাও উচ্চবিত্ত। তারা নিজেরাই বিদেশ গিয়ে এটি নিয়ে আসে। কেউ পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমেও নিয়ে আসে। মাদকটি দামী হওয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি।
নতুন মাদকে আগ্রহ কেন? দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক গ্রহণের ফলে আসক্তদের দেহে এসবের প্রতিক্রিয়া কমে আসে। তারা উদ্দীপনার জন্য নতুন কিছু খুঁজতে থাকে। ব্যক্তি জীবনে হতাশা ও ব্যর্থতা ঢাকতেও শক্তিশালী মাদক খোঁজে তারা। মাদককারবারিরা তখন চাহিদা বুঝে নতুন মাদক সরবরাহ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৮ সালের মে মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে। ইয়াবার বিরুদ্ধে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসারসহ সকল বাহিনী জিরো টলারেন্স নীতিতে প্রায় দুই বছর টানা অভিযান চালায়।
জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী বলেছেন, আমাদের দেশের মাদকসেবীরা একই সময় বিভিন্ন মাদক গ্রহণ করে। যে ইয়াবা খায়, সে গাঁজাও গ্রহণ করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাদকের বাজার বেশ বড়। এটা ধরে রাখতে একের পর এক কৌশল খাটাবেই কারবারিরা। ভৌগলিক কারণেও তাদের কাছে বাংলাদেশ প্রিয়। অভিযানের কারণে মাদক প্রবেশ হয়ত কমেছে, তবে মাদককারবারিরা বসে নেই। তারা নতুন নতুন মাদক নিয়ে এসে ভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের মাদকের বাজার দখল করে রাখার জন্য মাদকের বাজার সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে।