শোকের মাস আগষ্ট

17

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘..মমতায় ভরা তোমার হৃদয় মানুষেরে ভালবেসে/ কাছে টেনে নিতে যত অভাজনে স্নিগ্ধ মধুর হেসে/ সেই অপরাধ যত অপবাদ লহিয়া হাস্য মুখে/ ক্রুদ্ধ ঘাতকের কঠোর আঘাত লইয়া আপন বুকে/ করনি গোপন আপনার তুমি হে অবিচল বীর/ তাইতো তোমায় ঘিরিয়া মানুষ নত করে নিজ শির/ তোমায় আঘাত হেনেছে যাহারা তাহারা ঘৃণ্যক্লীব/ তোমার মৃত্যু তোমারে করেছে অমর চিরঞ্জীব।’
স্বাধীনতার মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে মহিয়সী নারী প্রয়াত কবি সুফিয়া কামাল তাঁর লেখা ‘হে অবিচল বীর’ নামক কবিতায় এভাবেই কাপুরুষ বঙ্গবন্ধুর ঘৃণ্য হন্তারকদের প্রতি ঘৃণা-ধিক্কার জানিয়েছেন।
শুধু সুফিয়া কামালই নয়, শোকের মাস আগষ্টের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণে বাঙালি জাতি নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর খুনী ও তাদের মদদদাতাদের। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে নানা সেøাগানে লেখা শোকের পোষ্টার, ফেষ্টুন, ব্যানারে ছেয়ে গেছে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাঙালি জাতির বেদনাবিধুর শোকের মাস আগষ্টের আজ নবম দিন।
আগষ্ট এলেই তাই কাঁদে বাঙালি। বাঙালির মন খারাপের মাস এটি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত, এ ঘর থেকে সে-ঘর, সবখানে, সর্বত্র, সমানভাবে জুড়ে রয়েছেন তিনি আজও। শাহাদাতের ৪৪ বছর পরও, আজও, আলোয়-উদ্ভাসনে, সঙ্কটে ও সম্ভাবনায়, বাঙালির চিরমানসপটে চির সমুজ্জ্বল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। কারণ তিনিই তো বাঙালির শত-সহস্র বছরের অবিস্মরণীয় এক রাজনৈতিক নেতা, বাঙালির জাতির পিতা।
তাই আগষ্ট এলেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। গোমড়া মুখ গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মন খারাপ হয় বিকেলের। বেদনায় হাঁটে মানুষ। ভাসে শোকে। গুমরে কেঁদে ওঠে ধানম-ির বাড়িটা। সে কান্না বাতাসে ছড়ায় আগুন। জ্বলে শহর। যুথবদ্ধ হয় মানুষ। ভালবাসার নৈবেদ্য দেন পিতাকে। সম্মিলিত কণ্ঠে শপথ নেন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলা গড়তে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শোষণ-বঞ্চনা, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে।
এই আগষ্টেই ক্ষমতালোভী নরপিশাচরা সপরিবারে হত্যা করে জাতির জনককে। বাঙালীর থেকে চিরতরে মুছে দিতে শেষবারের জন্যও দেখতে দেয়নি মুখগুলো। দাফন করা হয়েছে কড়া প্রহরায়, অবহেলায়, অশ্রদ্ধায়। তারপর চলেছে কত ষড়যন্ত্র, ঘৃণ্য রাজনীতি। বিকৃত করা হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম অবদান। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। কৃতজ্ঞ বাঙালি ভোলেনি সে মুখ, কণ্ঠ, আদল। সঙ্কটে ও বিপন্নতায়, বিশৃঙ্খলা ও অনাহারে, রাজনীতি ও সমাজের ভাঙ্গনে- এখনও তাই বাঙালী ফিরে যায় তাঁরই কাছে। হাঁটে বঙ্গবন্ধুরই দেখানো পথে।
আর এ কারণেই তো স্বাধীনতার চার যুগ পরেও দেশের নানা স্থানেই যখন বেজে ওঠে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত সেই বর্জনির্ঘোষ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, তখনই নতুন করে শিহরিত হয়ে ওঠে বাঙালি। রক্তে জ্বলে ওঠে বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতা রক্ষায় যে কোন ত্যাগ স্বীকারের মন্ত্র। স্বাধীনতা বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করার প্রেরণা জোগায়।
ইতিহাসে হয়ত এ মাসে অনেক বিজয়ের কাহিনী লেখা আছে। কিন্তু বিজয়ের সেসব কাহিনী রক্তের স্রোত ধারায় মিশেছে আগষ্টে এসে। এ মাস নতুন করে ভাবতে শেখায়। এ মাস প্রতিশোধের চেতনায় শাণিত করে সবাইকে। কেননা এ মাসেই আমরা হারিয়েছি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কালজয়ী মহাপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বস্তুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ইতিহাসের বাকঘোরানো এক সিংহ পুরুষ। বাঙালি জাতির চরিত্র সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বোধ করি আর কেউ জানতেন না। তবুও তিনি জীবনের বিনিময়ে সেই জাতির জন্যই রচনা করেন ইতিহাসের এক অমোঘ অধ্যায়। পৃথিবীতে কোন জাতিই মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। আর স্বাধীনতার জন্য এই স্বল্পতম সময়ে প্রায় ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মদানের ঘটনাও ইতিহাসে বিরল।
বঙ্গবন্ধুর এক তেজোদীপ্ত ভাষণেই উদ্বুদ্ধ গোটা জাতি সেই বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বভাব নেতা। কী বাল্যে, কী কৈশোরে বা কী মত্ত যৌবনে সবখানেই ছিলেন তিনি এক কালজয়ী মহাপুরুষ। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অবিভাজ্য সত্তা। আর সে জন্যই আগষ্টের পুরো মাসজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছেন জাতির জনকের প্রতি।