কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও গ্রেফতার হয়নি বরগুনায় শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফের আসল হত্যাকারীরা। ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে রিফাতকে সরাসরি হত্যকান্ডে জড়িত খুনী রিফাত ফারাজী ও নয়ন বন্ডকে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের সব জায়গায় বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তারা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য রেডএলার্ট জারি করা হয়েছে। এ দু’জন খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই ও মাদক সংক্রান্ত এক ডজন মামলার আসামি। ইতোমধ্যেই পুলিশ হত্যার সঙ্গে পরোক্ষ জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন অধিকাংশ হত্যাকারী গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে সর্বাত্মক অভিযান চলছে। নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়িতে অস্ত্রধারী পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রিফাত হত্যাকারীদের পক্ষে আদালতে না দাঁড়াতে আইনজীবীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন চৌদ্দ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম।
গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে দশটার দিকে বরগুনা সরকারী কলেজের সামনে প্রকাশ্যে খুনী নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা রিফাতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। রিফাতের স্ত্রী মিন্নি খুনীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ওদিন বিকেল চারটায় রিফাত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ঘটনার সময় আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মোবাইল ফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করে। পরে ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিলে রীতিমতো ভাইরাল হয়। পরদিন ১২ জনকে আসামি করে রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বরগুনা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি মূলহোতা হিসেবে অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ও অপর খুনী রিফাত ফারাজীকে মোস্টওয়ান্টেড চিহ্নিত করে সর্বত্র বিশেষ বার্তা প্রেরণ।
এ ঘটনায় হাইকোর্ট খুনীরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সে জন্য পুলিশ প্রধানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুনীদের দ্রুততার সঙ্গে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন।
শুক্রবার ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি বলেন, রিফাতের খুনীরা যে দলেরই হউক না কেন, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। খুনীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ইতোমধ্যেই অধিকাংশ খুনী গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বরগুনা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত তিন জন গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশের গাফিলতি প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে। রিফাত হত্যা মামলায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে দেশের সব জেলার পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে রেডএ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। কোনভাবেই কাউকে পালিয়ে যেতে দেয়া হবে না।
এর আগে বরগুনার পুলিশ সুপার মোঃ মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, রিফাত হত্যা মামলার ৪ নম্বর আসামি চন্দন, ৯ নম্বর আসামি হাসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া নাজমুল নামে আরও এক সন্দেহভাজন খুনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় যাওয়ার সময় বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে এমভি মানামী লঞ্চ থেকে ওই চার যুবককে আটক করা হয়।
মামলার এক নম্বর আসামি সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে ৮টি ও ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে চারটি মামলা আছে। প্রতিটি মামলায় পুলিশ সঠিকভাবে চার্জশীট দাখিল করেছিল। কিন্তু আদালত থেকে তারা জামিন নিয়ে তারা বাইরে বের হয়।
তিনি আরও দাবি করেন, রিফাত হত্যাকান্ডে পুলিশের কোন গাফিলতি নেই। হামলার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের সহযোগিতায়ই রিফাতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রিফাত হত্যাকান্ডে পুলিশের কোন দায়িত্বে অবহেলা আছে কি-না তা জানার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি পুলিশের কোন দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পায়নি। এমনকি আসামিদের গ্রেফতার না করতে কোন চাপ নেই।
ঘটনাস্থলের কাছে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত তিন জন ছাড়া বাকি খুনীরা নজরদারিতে আছে।
এদিকে মিন্নির ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যতদিন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, ততদিন এমন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মোতাবেক যে কালো শার্ট, জিন্সের প্যান্ট আর চোখে সানগ্লাস পরে রিফাতকে কোপায় সেই হচ্ছে খুনী রিফাত ফরাজী। হাতে বড় একটি রামদা নিয়ে সে রিফাতকে কোপাতে থাকে। রিফাত ফরাজীর পিতার নাম দুলাল ফরাজী। রিফাত তার পিতার বড় সন্তান। রিফাত ফরাজীর বাড়ি বরগুনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি রোডে।
এদিকে শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, রিফাতের হত্যাকারীদের বিচারে দলীয় পরিচয়সহ স্থানীয় প্রভাব কোন বাধা হতে পারবে না। রিফাতের হত্যাকারীদের পক্ষে আদালতে কোন আইনজীবীকে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। বেশি টাকা দিলেও আইনজীবীদের রিফাতের খুনীদের পক্ষে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। আইনজীবীদের প্রতি বিবেক দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানান মোহাম্মদ নাসিম।
এদিকে ঘটনার পর মিন্নি ও নয়ন বন্ডকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রচার প্রোপাগান্ডা চলছে বলে দাবি করেছেন মিন্নি। তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, নয়ন তাকে খুব উত্ত্যক্ত করত। হুমকি দিত। অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখাত। তার এক ভাই কলেজ রোড এলাকার একটি স্কুলে পড়ে। নয়ন তার ভাই ও বোনকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। একদিন অস্ত্রের মুখে তাকে জিম্মি করে একটি বাসায় নিয়ে গিয়েছিল নয়ন। একটি কাগজে তার স্বাক্ষর নিয়েছে। সেই স্বাক্ষর দিয়ে কিছু করেছে কি-না তা তার জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ও নয়নকে নিয়ে যা ছড়ানো হচ্ছে, মিথ্যা। প্রচারকারীদের তিনি শাস্তি দাবি করেন।
শুক্রবার পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া এ্যান্ড পিআর) মোঃ সোহেল রানা জানান, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌ-বন্দরগুলোতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে জেলা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই, সিআইডি, র্যাব এবং ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কাজ করছে। আসামিদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিতে জনগণের প্রতিও অনুরোধ জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নয়ন বন্ডের বাড়ি বরগুনা পৌর শহরের বিকেবি রোডের শহরের ধানসিঁড়ি এলাকায়। তার পিতার নাম আবু বক্কর সিদ্দিকি। ক্ষমতাসীন দলের কিছু লোকের সহায়তায় সে নিজেকে বড় ধরনের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলে। সুবিধা নিতে নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা বলে পরিচয় দিত। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাবেক এমপি ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে খুনী রিফাত ফরাজী। রিফাত ফরাজী ও তার ঘনিষ্ঠ রিশানের ঘনিষ্ঠ নয়ন বন্ড।
দুইজনের ৭ দিন, একজনের তিন দিনের রিমান্ড : বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে শাহনেওয়াজ রিফাত (রিফাত শরীফ) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা মামলায় গ্রেফতার তিন আসামির মধ্যে চন্দন ও হাসানের ৭ দিন ও নাজমুল হাসানের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোঃ রাসেল এ আদেশ দেন।
এর আগে সকাল ১১টার দিকে আসামিদের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ন কবির ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালতের বিচারক বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এজহারভুক্ত আসামি চন্দন ও মোঃ হাসানের ৭ দিন করে ও অজ্ঞাতনামা আসামি নাজমুল আহসানের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(তদন্ত) হুমায়ন কবির রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমরা আদালতের কাছে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেক আসামির জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করি। আদালতের বিচারক দুইজনের ৭ দিন ও ১ জনের ৩ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
উল্লেখ্য, বুধবার (২৬ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারী কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে শাহনেওয়াজ রিফাতকে। তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি হামলাকারীদের প্রাণপণ বাধা দিয়েও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি। একাধারে রিফাতকে কুপিয়ে বীরদর্পে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ত্যাগ করে দুর্বৃত্তরা। তারা চেহারা আড়াল করারও কোনও চেষ্টা করেনি। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।