নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ করতে ॥ তোপের মুখে বিএনপির হাইকমান্ড

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণ করতে গিয়ে দলের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে বিএনপি হাইকমান্ড। জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি না করে কেন অসময়ে কাউকে কিছু না বলে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির শূন্যপদগুলো একক সিদ্ধান্তে পূরণ করা হচ্ছে এ নিয়ে দলের ক’জন নেতা লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চেয়েছেন। তবে তারেক রহমান সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। এখন তিনি এ বিষয়ে ক’জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই জাতীয় কাউন্সিল করে বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের দাবিতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী সোচ্চার হয়। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজি না থাকায় জাতীয় কাউন্সিল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীরাই এখন বলাবলি করছেন। তবে কাউন্সিল না করলেও গোপনে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির শূন্যপদগুলো একে একে পূরণ করা শুরু করেন তারেক রহমান। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির চারটি শূন্যপদের মধ্যে হঠাৎ করে দু’জনকে নিয়োগ দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলের পর স্থায়ী কমিটিতে স্থান না পাওয়া যেসব প্রবীণ নেতারা এতদিন অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন। তারা যখন দেখতে পান তাদের চেয়ে অনেক জুনিয়র দুজনকে স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেয়া হয় তখন এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা ডালপালা মেলে। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরাও বিষয়টিকে ভালভাবে নেননি। তাই এ নিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯ জুন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হঠাৎ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে ঘোষণার পর তাদের সিনিয়র অন্তত ডজনখানেক নেতা স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্যসহ সর্বস্তরের নেতার সঙ্গে আলাপ করে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের এ ক্ষোভের কথা জানার পর দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। সবার একই কথা দলের এই দুর্দিনে যেখানে সর্বস্তরের নেতাকর্মী মিলেমিশে কাজ করা জরুরী, সেখানে কাউকে কিছু না বলে কেন একক সিদ্ধান্তে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করা হচ্ছে। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর দাবি ছিল জাতীয় কাউন্সিল। কিন্তু কেন এ দাবি উপেক্ষা করা হচ্ছে? তাহলে কি অদূর ভবিষ্যতে দলের জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর সম্ভাবনা যদি থাকে তাহলে এখন কেন শূন্যপদ পূরণ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলের পর ৫৯২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। তখন ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয় আর দুটি পদ শূন্য রাখা হয়। এই ১৭ জনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র সালাউদ্দিন আহমেদ ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হলেও আব্দুল্লাহ আল নোমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ও আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ ডজন খানেক সিনিয়র নেতাকে বঞ্চিত করা হয়। তখন স্থায়ী কমিটিতে স্থান না পেয়ে আব্দুল্লাহ আল নোমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদসহ ক’জন নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং দলীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকেন। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া তাদের শীঘ্রই স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেয়ার আশ্বাস দিয়ে দলে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিলে তারা দলের সকল কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন।
খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক ক্ষমতা বলে নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো একে এক পূরণ করতে থাকেন। প্রথমে ছোট ছোট পদগুলো পূরণ করায় এ নিয়ে তেমন আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। কিন্তু দলীয় ফোরামে কোন আলোচনা না করেই সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণ করতে গিয়ে সর্বস্তরের নেতাকর্মীর তোপের মুখে পড়েন তারেক রহমান।
এদিকে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ দলের নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণ করতে গিয়ে নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়া তারেক রহমান নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে আপাতত কৌশল পরিবর্তন করেছেন। স্থায়ী কমিটির বাকি দুটি শূন্যপদ পূরণ থেকে আপাতত তিনি বিরত থাকেন সেই সঙ্গে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ প্রশমন করতে সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দিয়ে জাতীয় কাউন্সিল হবে বলে আশ্বাস দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি বিএনপি মাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, শীঘ্রই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে জাতীয় কাউন্সিলের এ আশ্বাসের কথা দলের কোন স্তরের নেতারাই বিশ্বাস করতে পারেননি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে ঢেলে সাজানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে কি কারণে জাতীয় কাউন্সিল না করে নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করা হচ্ছে তা আমি বলতে পারব না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শূন্যপদ পূরণ করতে পারেন। দলের স্থায়ী কমিটিতে তিনি যোগ্য দুজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। তবে দলের জাতীয় কাউন্সিলেরও প্রস্তুতি চলছে।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রতি ৩ বছর পর জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার কথা। কিন্তু ৩ বছর ৩ মাস পার হয়ে গেলেও তা করা হচ্ছে না। কাউন্সিল ছাড়া দল গোছানোর কাজ শুরু করায় বিএনপির সর্বস্তরে কোন্দল শুরু হয়েছে। মহাসচিবসহ দলের কিছু সিনিয়র নেতা কোন্দল সামলানোর চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না। তাই দলীয় হাইকমান্ডও এ নিয়ে চিন্তিত।
জানা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সিনিয়র নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এতে বাগড়া দেন। তার মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল করতে গেলে দল নানামুখী সমস্যায় পড়তে পারে। তাই তার নির্দেশেই এক পর্যায়ে জাতীয় কাউন্সিলের প্রক্রিয়া থেমে যায়। এ কারণে তৃণমূলের পাশাপাশি দলের সিনিয়র নেতারাও মনোক্ষুণœ হন।
শুধু মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির শূন্য পদই নয় লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একের পর দলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা কমিটি দেয়া শুরু করেন। মূল দলের মতো বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ইউনিট কমিটিও প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেয়া শুরু করা হয়। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে কিছু না জানিয়ে দলের দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে বিভিন্ন ইউনিটের নতুন নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ ১৯ জুন দুই নেতাকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির পদ দেয়া হয়। আর যখন যে ইউনিটের কমিটি দেয়া হয় সেখানেই কোন্দলের কারণে একাধিক গ্রুপ পাল্টাপাল্টি কর্মকান্ড শুরু করে। আর তা করতে গিয়ে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয় দলের নেতাকর্মীরা।