হযরত শাহজালাল (রহ.) পবিত্র লাকড়ী তোড়ার ওরস ॥ লাকড়ী তোড়ার মেলা এর ঐতিহাসিক পটভূমি

47

হযরত শাহজালাল (রহ.)- এর স্মৃতি বিজড়িত “লাকড়ি তোড়ার মেলা’ প্রতি বছর শাওয়াল চাঁদের ২৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় এবং এ দিন থেকেই বার্ষিক ওরস শরীফ তথা হযরতের ওফাত দিবস পালনের প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু ২৬ শাওয়ালের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে আমরা অনেকে সঠিক তথ্য জানি না। হযরত শাহজালাল (রহ.)- এর সিলেট বিজড়িত কোন অলৌকিক ঘটনা নয় বরং তা ছিলো একটা বাস্তব সম্মত, বিচক্ষণ রণ কৌশলের ফল। মহান হযরত তাঁর ৩৬০ জন অনুসারী ও দিল্লি সালতানাতের এক বিরাট সৈন্য বহর নিয়ে অত্যাচারী রাজা গৌড়গৌবিন্দকে পরাজিত ও উৎখাত করে অত্র অঞ্চলে শান্তি স্থাপন ও ইসলামের মহান বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সিলেটে আসেন। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে মানব যুদ্ধ বিগ্রহ আর প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সিলেটের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। কিন্ত মানব প্রেমিক মহান দরবেশ অহেতুক রক্তপাত ও সম্পদহানী এড়ানোর উদ্দেশ্যে গৌড়গোবিন্দের দূর্গ অবরোধের সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনা ও কৌশল নির্ধারণের পর তিনটি স্থানে সুরমা নদী অতিক্রম করে গৌড়গোবিন্দের দুর্গ অবরোধ করেন এবং তিনি স্বয়ং গৌড় দোয়ার বা দুর্গের প্রবেশ দ্বারের বিপরীত বর্তমান পীর মহল্লায় অবস্থান নেন। দীর্ঘ দু’বছর অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় গৌড়গোবিন্দের সৈন্য বাহিনী বার বার অবরোধ ভাঙ্গার চেষ্টা চালায় ফলে নানা স্থানে ছোট খাটো যুুদ্ধ হতে থাকে এতে অনেক সৈন্য পীর আউলিয়া শহীদ হতে লাগলেন। কিন্তু তখন কোন নির্দিষ্ট গোরস্থান না থাকায় এবং যুদ্ধাবস্থায় মরদেহ সরিয়ে নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় যে যেখানে শহীদ হন তাকে সে স্থানেই দাফন করা হয়।
সিলেট শহরের রাস্তাঘাট ও খালে বিলে আউলিয়াগণের মাজার তারই সাক্ষ্য বহন করে। এভাবে দীর্ঘ দুইবছরের ব্যর্থ চেষ্টার পর গৌড়গোবিন্দের মনোবল ভেঙ্গে পড়লে সে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিনিময়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। মহান দরবেশ তাঁর সে প্রস্তাব গ্রহণ করে তাকে পেঁচাগড় দুর্গে চলে যেতে অনুমতি দেন এবং শাওয়াল চাঁদের ২৬ তারিখ স্বীয় অনুসারীদের নিয়ে সিলেট শহরে প্রবেশ করেন আর তারই সাথে অত্র অঞ্চলে দ্বীন ইসলামের বিজয় নিশান উত্তোলিন হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ২৬শে শাওয়াল তারিখে মহান ধুমধাম ও জাকজঁমকের সাথে সিলেটে ইসলামের বিজয় পালিত হয়ে আসছে। এ দিন দরগাহ প্রাঙ্গণে কুচকাওয়াজ ও মেলা অনুষ্ঠিত হতো। মহান দরবেশ এতে সমবেত অনুসারী ও জনসাধারণের উদ্দেশ্যে নসিহত প্রদান করতেন। যার ফলে অত্র এলাকায় দ্রুত ইসলামের প্রসার ও বিকাশ ঘটতে লাগল। বিভিন্ন ধর্ম, পেশা শ্রেণীর মানুষ ইসলামের সুমহান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে লাগল। কিন্তু মহান দরবেশের জীবন সায়াহে স্বাভাবিক নিয়মে কিছু কিছু সামাজিক সমস্যা ও শ্রেণীভেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। এর শিকার জনৈক কন্যাদায়গ্রস্থ নওমুসলিম কাঠুরিয়া তার দু’জন বিবাহযোগ্য কন্যা নিয়ে মহান দরবেশের দ্বারস্থ হলেন। দরবেশ তার সমস্যার কথা শুনে তাকে আগত প্রায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার পরামর্শ দিলেন। নির্দিষ্ট দিনে মহান দরবেশ ভক্তবৃন্দ ও অনুসারীদের কুচকাওয়াজসহ বর্তমান লাক্কাতুরা এলাকার গভীর জঙ্গলে গিয়ে সবাইকে লাকড়ী তোড়া তথা ভাঙ্গার নির্দেশ দিলেন ও নিজেও তা করলেন। অবশেষে ক্লান্ত দরবেশ বিশ্রামের আশায় ও অল্প উঁচু ঢিলায় উঠে বসলেন। এ দিনটি ছিল দরবেশের মুর্শিদ ও মামা হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (র.)- এর ওফাতের তারিখ হইতে হযরত সমবেত ভক্তবৃন্দসহ মুর্শিদের রুহের মাগফিরাত কামনায় সে টিলায় বসে ফাতেহা পাঠ করলেন। অতঃপর ভক্তবৃন্দসহ সংগৃহীত লাকড়ী নিয়ে নিজ হাবেলীতে ফিরে আসলেন। সে থেকে এলাকাটির নাম হয় লাক্কাতুরা।
আসরে (আছরের) নামাজ অন্তে হযরত শাহজালাল (রহ.) সমবেত জনতার প্রতি নসীহত করতে দাঁড়িয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করলেন-আমরা আজ কি কাজ করলাম? সমস্বরে আওয়াজ হলো-আমরা আজ লাকড়ী কেটে নিয়ে এলাম। আবার প্রশ্ন হলো-আজ থেকে আমরা সবাই কি কাঠুরিয়া নই? আবার আওয়াজ হলো-হ্যাঁ! আজ থেকে আমরা সকলেই কাঠুরিয়া।
মহান দরবেশ মুচকি হেসে বললেন-এই লোকটি একজন কাঠুরিয়া। এর দু’জন উপযুক্ত কন্যা আছে, তোমাদের মধ্যে কারা এদের বিবাহ করতে রাজি আছো? অনেকেই হাত তোলে সম্মতি জানাল। হযরত এদের মধ্যে থেকে দু’জন উপযুক্ত পাত্র দেখে মেয়ে দুটির বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরত শাজালাল (রহ.) মহান ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মীতার যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা আজও আমরা লালন করছি।
কথিত আছে, দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ বিজয় দিবস মহা ধুমধাম ও জাকজঁমকের সাথে পালিত হয়ে আসছিলো, এমন কি পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা এ অনুষ্ঠান সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও অংশগ্রহণে পালিত হতে দেখেছি। এ অনুষ্ঠানে পুলিশ বাহিনীর ব্যান্ড ও ঘোড়া এবং বন বিভাগের হাতির অংশগ্রহণ এরই প্রমাণ বহন করত। কিন্তু বিগত ১৯৮৬-৮৭ইং সালে কতিপয় ধর্মান্ধ দুষ্কৃতিকারীর প্ররোচনায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘকালের ব্যবধান আর আমাদের অজ্ঞতার কারণে সিলেট বিজয়ের অনুষ্ঠান আজ শুধু লাকড়ী ভাঙ্গার অনুষ্ঠানে পরিণত হলেও প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা নয়।
মহান রাব্বুল আল-আমীন ও তার প্রিয় বান্দার মারিফত বুঝা একটু কঠিন বৈকি। কেটে আনা বিপুল পরিমাণ লাকড়ী নিয়ে ভক্তরা যখন ভাবিত তখন মহান হযরত বললেন, রেখে দাও, লাকড়ীগুলো কাজে লাগবে। আল্লাহর ওলীর জীবনের শেষ কারামত অল্প কিছু দিনের মধ্যে প্রকাশ পেল। মাত্র বাইশ দিনের মাথায় পরবর্তী জিলক্বদ চাঁদের ১৯ তারিখ যোহরের ফরজ নামাজ আদয়রত অবস্থায় হযরত ইহধাম ত্যাগ করে জান্নাতবাসী হলে মুর্শিদের দাফন কাফনে শরিক হওয়ার জন্য দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্তকোলের আগমন ঘটতে লাগল। তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে রান্নাবান্নার জন্য প্রচুর লাকড়ীর প্রয়োজন দেখা দিলে ঐ লাকড়ীগুলো কাজে লাগানো হয়। তারই ধরাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত প্রতি বছর ২৬শে শাওয়াল বিজয় দিবসে সংগৃহীত লাকড়ী দিয়ে মহান হজরতের পবিত্র ওরস শরিফের নিয়াজ রান্নার জন্য চুলায় আগুন ধরানো হয়।
তাই আজ এ মহাক্ষণে সিলেটের আপামর জনসাধারণ তথা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের আহবান আমরা আজ সকলে মিলে হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রহ.)- এর শিক্ষা অন্তরে ধারণ করি, কিছুটা হলেও হযরতের ওরস পালনে অবদান রাখি। বিজ্ঞপ্তি