বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন তাতে কূটনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্রটিই পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সহাবস্থান এবং সহিষ্ণুতা ও স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার মনোভাবই প্রধান হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘাত নয়, আলোচনার যে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সামনে নিয়ে এসেছেন তা সাধুবাদযোগ্য। এটা ঠিক যে একেবারে শুরুর দিকে আমাদের দেশে মিয়ানমার তাদের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে ঠেলে দেয়ার পর হাজার হাজার রোহিঙ্গা যখন নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশের ভূসীমানায় আশ্রয় নিতে থাকে সে সময় আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছিল। সেটি ছিল পরিষ্কার উস্কানি। কিন্তু বাংলাদেশ সে ফাঁদে পা দিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়নি। বরং কূটনৈতিকভাবেই সেটি মোকাবেলা করা হয়। দৃঢ় প্রতিবাদ জানানো হয় ওই অসঙ্গত তৎপরতার। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি শান্তিপূর্ণ হলেও কেউ আক্রমণ করলে তার জবাব দেয়ার মতো প্রস্তুতিও থাকতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের সে প্রস্তুতি রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলার মানুষ অনেক মমতাশীল। নিজেরা দুঃখ-কষ্টে থাকলেও অন্যের দুঃখ-কষ্টে তাদের মন কাঁদে। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী স্বদেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সত্তায় একজন মমতাময়ী জননী মিশে আছেন বলেই একজন অসহায় রোহিঙ্গার অপমৃত্যু কিংবা অনিশ্চিত বিপদসঙ্কুল জীবন তিনি মেনে নিতে পারেননি। সীমান্ত এক প্রকার খুলেই রাখা হয়েছিল ২০১৭ সালে, যাতে তাড়া খাওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পেতে পারে। আমাদের সরকারপ্রধানের এই মানবিক গুণ সম্পর্কে গোটা বিশ্ববাসী জানে। মাদার অব হিউম্যানিটি অভিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে এক ধরনের কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়েছে তাকে। কিন্তু এরপর? বাংলাদেশ সীমিত সম্পদের দেশ। তারও রয়েছে অসংখ্য সমস্যা ও সঙ্কট। ভূখন্ডের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। তাই স্থায়ীভাবে এই নতুন ১১ লাখ (যা প্রতিদিনই বাড়ছে সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে) রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থায়ীভাবে ভরণপোষণ এবং তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা কঠিন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে, সুনির্দিষ্টভাবে বললে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থান করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৬০ শিশু- এমন সংবাদ আগেই দিয়েছে ইউনিসেফ। এর আগে বিবিসি একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল এক বছরে বাংলাদেশে ৪৮ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেবে। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং তাদের বাংলাদেশে শরণ নেয়ার পর সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাইরের পৃথিবী সম্পূর্ণ অবগত। দু’একটি দেশ ছাড়া সকলেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাসের সকল সুবিধা ও অধিকার প্রদানের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বলেছে।
বর্তমানে সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ‘সেফ জোন’ তৈরির প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। রাখাইনে একটি সেফ জোন হলে সেখানে যাতে ভারত, চীন ও আসিয়ানের দেশগুলো রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করতে পারে। কারণ, তাদের প্রতি মিয়ানমারের আস্থা আছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকারীদের জন্য নিরাপদ ভূমি তৈরি হলে উদ্ভূত সঙ্কটের সুন্দর একটি সমাধান হতে পারে। শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য সংঘাত নয়, আলোচনাই একমাত্র পথ। বিশ্বনেতাদের সক্রিয় ভূমিকাও কাম্য।