কাজিরবাজার ডেস্ক :
একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সবাই মিলে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথানত না করা। আমি মনে করি, একুশে পদকজয়ীদের অনুসরণ করে আমাদের আগামী প্রজন্ম নিজেদের গড়ে তুলবে। একুশ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়, নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজের সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐতিহ্য সবকিছুকেই রক্ষা করা ও তার মর্যাদা দেয়া। তাই আসুন, আমাদের মাতৃভূমিকে আমরা গড়ে তুলি। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্বে যেন অনন্য মর্যাদায় চলতে পারি। স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারি।
বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একুশে পদক প্রদান ’১৯ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। বাংলা আমাদের ভাষা। জাতির পিতা এ কথা বারবার বলেছেন। আর সেই দেশকে আমরা গড়ে তুলতে চাই, বিশ্ব দরবারে একটা মর্যাদায় যেন বাংলাদেশ অধিষ্ঠিত হয়। বাঙালি জাতি যেন বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে চলতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এটুকুই চাই।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ২২ কীর্তিমান একুশে পদকপ্রাপ্তদের হাতে একটি সোনার মেডেল, সম্মাননাপত্র ও দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা একুশে পদক পেয়েছেন, তারা গুণীজন। তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান। দেশ-জাতি-ভাষায় তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। সেই অবদানের কথা সবসময় আমরা স্মরণ করি। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি এই সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আজ যেসব গুণীজন পুরস্কৃত হয়েছেন, তাদের প্রতিও আন্তরিক অভিনন্দন।
মহান একুশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সৌভাগ্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দেয়। আমরা আবার সরকারে আসি। সরকারে আসার পর সেই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নির্মাণ করি, সেখানে এখন গবেষণা চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন মাতৃভাষার নমুনা, এমনকি হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষার নমুনা সংগ্রহেরও কাজ চলছে। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের ভাষা বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেরও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার নমুনা সংগ্রহ করা এবং গবেষণা করার কাজ আমরা অব্যাহত রেখেছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, জাতির পিতার স্বাধীনতার পর জাতিসংঘে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকার প্রধান হিসেবে যতবার ভাষণ দিয়েছি, প্রতিবারই বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভাষার অধিকার, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের কৃষ্টি এটাকে রক্ষা করা, চর্চা করা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা, এটা আমাদেরই কর্তব্য।
তিনি বলেন, আমরা অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অর্জন করেছি, তার সুফলটা যেন আমাদের আগামী প্রজন্ম ভোগ করতে পারে। তারা যেন একটা সুন্দর জীবন পায়, সেটাই আমরা চাই। আমরা এই দেশটা এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই যেন বিশ্ব দরবারে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। আমরা এইটুকুই চাই- বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষ মাথা উঁচু করে চলবে। কারণ একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের আরও শিখিয়েছে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়, নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা করা যায়। মাতৃভাষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শিক্ষা-ঐতিহ্য সবকিছুকেই রক্ষা করা এবং তার মর্যাদা দেয়া।
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন, আমাদের মাতৃভূমিকে আমরা গড়ে তুলি, আমাদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সবকিছু নিয়ে যেন আমরা বিশ্বে একটা অনন্য মর্যাদা নিয়ে চলতে পারি, জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারি। পুরস্কারপ্রাপ্তদের অবদানের কথা স্বীকার করেন এবং তাদের প্রতি অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এই সম্মানটা মূলত এটা দেশের জন্য। জাতির জন্য এবং ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য। তাদের জীবনটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই পুরস্কার। আমরা বাঙালি জাতি আমাদের জীবনের যা কিছু অর্জন, সবই কিন্তু এসেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আমরা বাঙালী, বাংলা আমাদের ভাষা। সেই বাংলা ভাষার অধিকারটুকু পর্যন্ত আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৭ সালে করাচীতে এক শিক্ষা সম্মেলনে ঘোষণা করা হলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। এই খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। খাজা নাজিমুদ্দিন তখন মুখ্যমন্ত্রী। তার বাড়ির সামনে প্রতিবাদ জানানো হয়। সেই প্রতিবাদ থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। এরপর আমরা দেখেছি যে, বারবার আমাদের সংস্কৃতিতে আঘাত দেয়া, ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়া, বাঙালী আমরা এবং পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটি হয়েছিল সেখানে তখন লোকসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন আমরা। অথচ বাঙালীদের অধিকার ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা আন্দোলনের যে যাত্রা শুরু সে বিষয়ে আপনারা নিজেরা জানতে পারবেন যদি জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীটা একটু পড়েন। সেখানেই জানতে পারবেন, কিভাবে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি সিক্রেটস অব ডকুমেন্টের কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, এই ডকুমেন্টের মধ্য দিয়ে আপনারা জানতে পারবেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কি অবদান রয়েছে ভাষা আন্দোলনে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের, একটা সময় ছিল যখন ইতিহাস থেকে তাঁর যে অবদান সেটা মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এই ডকুমেন্টগুলো পাওয়ার পর থেকে এবং তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সেকথাগুলো আজকে আমাদের সামনে এসেছে। কিভাবে দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করতেন। তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালে প্রথম এই সংগ্রাম শুরু এবং সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। এরপরে ১৯৫৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখনি পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনা হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছিল।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে তখন আমাদের কিছু বাঙালী তারা কানাডায় বসবাস করতেন। তাদের একজনের নাম সালাম, আরেক জনের নাম রফিক। ভালবাসি মাতৃভাষা বলে একটি সংগঠন পৃথিবীর কয়েকটি ক্ষুদ্র ভাষাভাষী মিলে তারা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য একটা সংগঠন করে। সেই প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতিসংঘে কোন ব্যক্তি বা সংগঠন প্রস্তাব পাঠালে হয় না। সেখানে একটি সদস্য দেশ থেকে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তখনি প্রস্তুতি নেই এবং আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রাস্তাব পাঠাই। সেই প্রস্তাব মোতাবেকই আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি এইটুকু বলব, বাংলাদেশের মানুষের যা কিছু অর্জন সে অর্জনটা কিন্তু সব সময় আওয়ামী লীগই এনে দিয়েছে। আজকে বিশ্বজুড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। শুধু অর্জনটাই না মাতৃভাষাকে রক্ষা করা, মাতৃভাষাকে চর্চা করা, মাতৃভাষার উপর গবেষণা করার জন্য আপনারা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলব। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আমার আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন। আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি এবং নির্মাণ কাজ শুরু করি। কারণ প্রকল্প আমরা আগেই নিয়েছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, আমাদের সরকারের ২০০১ সালে ৫ বছর পূর্ণ হয়ে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতার পরে প্রথম একটি সরকার ৫ বছর পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা আমরা হস্তান্তর করি। পরবর্তীতে বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা ক্ষমতার আসার পর যথারীতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আমরা আবারও নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে এই ইনস্টিটিউটটি প্রতিষ্ঠা করি।
এবার একুশে পদক পেলেন যে ২২ জন ॥ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে পদকপ্রাপ্ত কীর্তিমানদের হাতে পুরস্কার, সম্মাননাপত্র ও চেক তুলে দেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এবার একুশে পদকপ্রাপ্তদের একটি সোনার মেডেল ও দুই লাখ টাকার চেক দেয়া হয়। মরণোত্তর পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে কিংবদন্তি পপ সঙ্গীতশিল্পী প্রয়াত আজম খানের পক্ষে তার কন্যা ইমা খান এবং অধ্যাপক হালিমা খাতুনের পক্ষে পদক গ্রহণ করেন তার মেয়ে প্রজ্ঞা লাবণী।
এছাড়া পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যরা সশরীরে উপস্থিত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে তিনজন হুইল চেয়ারে উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেন। ভাষা আন্দোলনের কারণে একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মনোয়ারা ইসলাম হুইল চেয়ারে করে পদক নিতে এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির আসন থেকে নেমে এসে সামনের কাতারে এসে মনোয়ারা ইসলামের গলায় পদক পরিয়ে দেন।
এবার একুশে পদকপ্রাপ্তরা হলেন- অধ্যাপক হালিমা খাতুন (ভাষা আন্দোলন, মরণোত্তর), এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু (ভাষা আন্দোলন), সুবীর নন্দী (শিল্পকলা, সঙ্গীত), আজম খান (শিল্পকলা, সঙ্গীত, মরণোত্তর), খায়রুল আনাম শাকিল (শিল্পকলা, সঙ্গীত), লাকী ইনাম (শিল্পকলা, অভিনয়), সুবর্ণা মুস্তাফা (শিল্পকলা, অভিনয়), লিয়াকত আলী লাকী (শিল্পকলা, অভিনয়), সাইদা খানম (শিল্পকলা, আলোকচিত্র), জামাল উদ্দিন আহমেদ (শিল্পকলা, চারুকলা), ক্ষীতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য (মুক্তিযুদ্ধ), ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ (গবেষণা), ড. মাহবুবুল হক (গবেষণা), ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া (শিক্ষা), রিজিয়া রহমান (ভাষা ও সাহিত্য), ইমদাদুল হক মিলন (ভাষা ও সাহিত্য), অসীম সাহা (ভাষা ও সাহিত্য), আনোয়ারা সৈয়দ হক (ভাষা ও সাহিত্য), মইনুল আহসান সাবের (ভাষা ও সাহিত্য) ও হরিশংকর জলদাস (ভাষা ও সাহিত্য)।