কাজিরবাজার ডেস্ক :
কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার পর প্রথমবারের মতো সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন এক হাজার ১০ জন কওমি আলেম।
মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৬ষ্ঠ পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক হাজার ১০টি দারুল আরকাম মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করবেন নিয়োগপ্রাপ্তরা।
সোমবার বায়তুল এই আলেমদের হাতে সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেয়া হয়। এরপর বিকালে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের মিলনায়তনে তাদের জন্য তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন কর্মশালা শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে আলেমদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছেন। সরকার আলেমদের জন্য দাওয়াতভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।’
কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নের ফলে কওমি ভিত্তিক সনদপ্রাপ্তরা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন বলেন মনে করছেন নিয়োগপ্রাপ্তরা।
অনুষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তদের একজন টাঙ্গাইলের মধুপুরের আবু ইউসুফ বলেন, কওমি মাদ্রাসা থেকে সনদপ্রাপ্তদের সরকারি স্বীকৃতি না থাকার কারণে দেশের উন্নয়নে তারা সরাসরি অবদান রাখার সুযোগ পাননি।
এই কওমি আলেম বলেন, ‘এতদিন আমরা কর্মক্ষেত্র নিয়ে অনিশ্চয়তায়, দুশ্চিন্তায় থাকতাম। আমরা লেখাপড়া করেছি কিন্তু স্বীকৃতি ছিল না বলে হতাশায় ছিলাম। এখন স্বীকৃতির পাশাপাশি যোগ্যতা অনুসারে চাকরিও পেয়েছি।’
সরকারের এই উদ্যোগে মাদ্রাসার চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন বলেন মনে করেন আরেকজন নিয়োগপ্রাপ্ত আলেম খুলনার মো. আলী।
গত বছরের ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার গণভবনে কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এক বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিকে ভিত্তি করে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা সনদ দাওরায়ে-ই-হাদিসকে (স্নাতকোত্তর) স্বীকৃতি দেয়া হয়। একইসাথে সনদপ্রাপ্তদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়ারও প্রতিশ্রতি দেন শেখ হাসিনা।
তখন বলা হয়, সরকারের কোনো প্রতিনিধি ছাড়াই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর করা কমিটির অধীনে পরীক্ষা নিয়ে এই সনদ দেওয়া হবে। এই কমিটিতে কোনো সরকারি প্রতিনিধি থাকবেন না।
এরই ধারাবাহিকাতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হয় কওমি আলেমদের। নিয়োগপত্র সই শেষে সবাই পত্রটি সানন্দে উচিয়ে ধরেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে চলতি বছর সারাদেশে এক হাজার ১০টি দারুল আরকাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এসব মাদ্রাসায় সদ্য যোগদানকারী কওমি আলেমরা শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
এছাড়া ওই মাদ্রাসাগুলোয় আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়া আরও এক হাজার ১০ জন ছাত্রকে নিয়োগ দেয়া হবে। ইতিমধ্যে তাদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় কওমি, আলিয়া ও সাধারণ শিক্ষা- তিনটি গ্রুপে মোট তিন হাজার ৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস এর গভর্নর মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ও সিরাজ উদ্দিন আহমেদ বক্তৃতা করেন।
মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক জুবায়ের আহমদ সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন।
১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল ইসলামী ঐক্যজোট জোট করে কওমি মাদ্রসার সনদের স্বীকৃতির জন্য। জামায়াতের সঙ্গে আদর্শিক বিরোধ থাকলেও তারা এই সিদ্ধান্ত নেয় সনদের জন্য।
২০০১ সালে নির্বাচনের পর এই জোট ক্ষমতায় আসে। আর ২০০৬ সালে ওই সরকারের শেষ বছরে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়া হলেও আ কিছু করা হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সনদের স্বীকৃতির জন্য কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার প্রধান আহমেদ শাহ শফির নেতৃত্বে কমিটি করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণে এই কমিটি প্রতিবেদন দিতে পারেনি, আর কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি ঝুলে যায়।
কবে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গণভবনে আহমেদ শাহ শফির নেতৃত্বে কওমি আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন এবং সেখানেই কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা আসে।
এই সিদ্ধান্তের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সন্দেহ সংশয়ের বরফ গলতে শুরু করে।