অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, একজন জনপ্রিয় লেখক এবং একজন মুক্তমনা মানুষ। আদর্শ শিক্ষার প্রসারে তিনি যেমন নিবেদিতপ্রাণ, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। শিক্ষা যে মুখস্থ করার বিষয় নয়, তাকে যে সৃষ্টিশীলভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তা তিনি নানাভাবে তুলে ধরেছেন এবং শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সেভাবে তাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। শুধু নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তিনি সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে যেকোনো স্থানে যেকোনো উদ্যোগে ডাক পেলেই তিনি ছুটে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সদালাপী, হাসিখুশি ও অমায়িক একজন মানুষ। এমন একজন মানুষের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে যে বা যারা ছুরি নিয়ে হামলা চালাতে পারে, তাকে বা তাদের কি মানুষ বিবেচনা করা যায়!
প্রায় দুই দশক ধরে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। চিঠি বা টেলিফোনে হুমকির পাশাপাশি তাঁকে গালাগালও করা হয়েছে। হুমকিদাতাদের চেতনার স্তর বিবেচনা করে তিনি সেসব উপেক্ষা করেছেন। তা সত্ত্বেও পত্রপত্রিকায় সেসব হুমকির কথা এসেছে। নিয়মানুযায়ী তিনিও কিছু পুলিশকে জানিয়েছেন। সব বিবেচনায় তাঁকে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরা দেওয়া হয়েছিল। হামলার সময় পুলিশ তাঁর পাশেই ছিল। কিন্তু হামলা ঠেকানো যায়নি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে তিনি তখন একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দৌড়ে এসে বহিরাগত হামলাকারীকে ধরে ফেলেছেন এবং পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। এটাও কম নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে নিরাপত্তার আরো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল না কি? এর আগেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে শিক্ষককে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। তার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তায় এত ঘাটতি কেন? কিভাবে অস্ত্র নিয়ে বহিরাগত যুবক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারল? প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা নতুন করে ভাবতে হবে।
এই হামলা শুধু অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা নয় এটি সৎ চিন্তা, আদর্শবোধ, সুকুমার চর্চা, তথা সভ্যতার পথে এগিয়ে চলার ওপর অপশক্তির আঘাত। এর আগেও অনেক শিক্ষাবিদ ও মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর অন্ধকারের শক্তি একইভাবে হামলা করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. আবু তাহের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদসহ অনেককেই হারিয়েছি আমরা। অন্ধকারের শক্তির এই আঘাত চলতেই থাকবে, যদি না রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের দমনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আরো অনেক শিক্ষাবিদকেই একই ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর এই বর্বর ও কাপুরুষোচিত হামলার আমরা নিন্দা জানাই। হামলাকারীসহ এই হামলার পেছনে যারা ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। একই সঙ্গে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোরও দাবি জানাচ্ছি।