জেড.এম. শামসুল :
আজ ৮ ফেব্র“য়ারী। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তরিত করতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ অব্যাহত আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন অতিবাহিত হওয়ার প্রাক্কালে বাংলাভাষা বিরোধী চক্র নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। বাঙালি ছাত্রজনতা বসে থাকেনি। শহর থেকে শহরাঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বাঙালি জাতি। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় সকল বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠায় চতুর পাকিস্তানীরা নানা ছলচাতুরী শুরু করে। ১৯৪৯ সালের এ দিনে পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাকিস্তানী শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের এক বৈঠকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যের তীব্র আন্দোলন শুরু করেন সেই ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মাত্র ১৭ দিন পর থেকে। পরদেশী ভাষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য থেকে বাঁচার লড়াই। বাঙালি জাতি মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সাথে অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে শুরু করে বাংলাভাষা অধিকারের আন্দোলন। তখন রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ বছর ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তমদ্দুন মজলিস। এই তমদ্দুন মজলিসই ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করে রাষ্ট্রভাষা দাবী বিষয়ক প্রথম পুস্তিকা। সেই পুস্তিকায় ফলাও করে বলা হয়েছিল “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দ্দু”। ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে ১৯৪৯ সালের ৭ এপ্রিল করাচিতে এক সমাবেশে ভারতের সাধক স্বামী কালযুগানন্দ বাংলা বর্ণমালার স্থলে আরবী হরফের প্রস্তাব সমর্থন করেন। তিনি এ সমাবেশে বলেন, বাংলাকে সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত করার জন্য বাংলা বর্ণমালাকে আরবী বর্ণমালায় রূপান্তরিত করলে তাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা যেতে পারে। এ বছরের ৯ এপ্রিল দৈনিক আজাদ পত্রিকায় অধ্যাপক ফেরদাউস খান “বাংলা বনাম আরবী হরফ” শীর্ষক এক নিবন্ধে বাংলায় আরবী হরফ প্রবর্তনের বিরোধীতায় যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন, বিজ্ঞান সম্মতভাবে বাংলা বর্ণমালা আরবীর চেয়ে অনেকাংশে শ্রেয়। এ বছরের ১৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্ররা বাংলায় আরবী হরফ প্রবর্তন প্রশ্নে একটি স্মারকলিপি তৈরী করে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড ও বর্ণমালার বিবেচনা বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে প্রেরণ করে। এ বছর অব্যাহত আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিপক্ষে নানান কলাকৌশল প্রয়োগ করতে থাকে বাংলাভাষা বিরোধী চক্র। এসব চক্রের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আব্দুল ওয়াদুদ’র সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ভাষার বর্ণমালা ষড়যন্ত্রের মুখে নিজেদের ঘর সামলানোর হুশিয়ারী ব্যক্ত করেন। বাংলাভাষা নিয়ে বিবেক প্রতিবন্দীদের খপ্পরে পড়ে আন্দোলন ব্যাহত হয়নি। বাংলার সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ রক্ষায় বাংলার পক্ষে যথেষ্ট জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। শহর নগর এমনকি গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এ শ্লোগান চলতে থাকে। বাংলাভাষার শত্র“দের পরাস্ত করতে আন্দোলনকারীরা আরো সক্রিয় হতে থাকে। অব্যাহত আন্দোলনে ভাষা শত্র“দের তাদের প্রভুভক্তের বিভিন্ন চক্রান্ত বাঙালির সন্দেহের সৃষ্টি করে। ভাষার পক্ষে জনমত সৃষ্টি দেখে নির্মম ইতিহাস রচনার দিকে এগুতে থাকে। কিন্তু বাঙালিরা দমবার জাতি নয় একে একে সাংগঠনিক তৎপরতা চলতে থাকে।