প্রভাষক জ্যোতিষ মজুমদার
ভাটিবাংলার সিংহপুরুষ, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান, বর্ষীয়ান জননেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সিপাহসালার, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা, সাবেক রেলমন্ত্রী, বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিগত ৫ ফেব্র“য়ারি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখ, রোজ রবিবার ভোর প্রায় সাড়ে ৪টার সময় শেষ নিশ^াস ত্যাগ করেন।
বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৬ সালের ৫ মে, সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চিকিৎসক দেবেন্দ্র দাস সেনগুপ্ত ও মাতা সুমতিবালা সেনগুপ্ত। তিনি দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি এবং সিলেট এম.সি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মান ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্টাল ল’ কলেজ থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন।
মেধাবি ও তীক্ষ্ম ধীশক্তির অধিকারী হওয়া সত্বেও লেখাপড়ার প্রতি তাঁর তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। যতটা না ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও রাজনীতির প্রতি। ছাত্র জীবন থেকে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। সেই নাটক পাগল লোকটির বিশ^ রাজনীতির অঙ্গনে পথচলা সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে। সত্তরের ঐতিহাসিক প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সময়ও ন্যাপ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আওয়ামী লীগ আর নৌকার বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের বিপরীতে নির্বাচিত হয়ে এক চমক সৃষ্টি করলেন তিনি। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য।
সিলেটের হাওর অঞ্চলের দুর্ধর্ষ গেরিলা কমান্ডার ছিলেন তিনি। সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ¯্রফে যুদ্ধ করে একটা স্বাধীন বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেই দায়িত্ব শেষ করেননি তিনি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে রেখেছিলেন মুখ্য ভূমিকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। তাছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী আনতে গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতি শুরু হয় বামপন্থি সংগঠনে। সাম্যবাদী দর্শনের দীক্ষা নিয়ে ছাত্রাবাস্থায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করা এই নেতা দৃঢ় ৫৯ বছর দাপটের সঙ্গে চলেছেন। তিনি ছিলেন তেজদীপ্ত, বক্তৃতার জাদুকর। সুতরাং তিনি একাই মাতিয়ে রাখতেন সংসদ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে সরকারের সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে কথাবলা, সর্বোপরি নতুন সংবিধানে স্বাক্ষর না করা প্রভৃতি কারণে তিনি বিশ^মিডিয়ার নজর কাড়তে সক্ষম হন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মোট ৭ বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে প্রথম বারের মত ন্যাপ থেকে, ১৯৭৩ সালে একতা পার্টি থেকে এবং ১৯৭৯ সালে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সাংসদ হন। আওয়ামীলীগে যোগ দেয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদান করেন। স্পষ্ট কথা বলে দলের অনেকের চক্ষুশূল হয়ে ৫৫ বছরের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে ফাঁদে পড়তে হয়েছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ২০১২ সালের একবারই মন্ত্রীত্বের স্বাদ পান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রেল মন্ত্রী হওয়ার এ অভিজ্ঞতা তাঁর সুখকর ছিলনা। রেলের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিলেও তাঁর সহকারী ৭০ লাখ টাকা সহ আটক হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ না করে তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সামন্যতম কলঙ্কের আঁচ পর্যন্ত না লাগলেও শেষ জীবনে এসে তাঁকে ব্যক্তিগত সহকারীর অর্থ কেলেংকারীর অভিযোগ মাথায় নিয়ে মন্ত্রীত্ব থেকে বিদায় নিতে হল এই বর্ষীয়ান নেতাকে। একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মনে রাখবেন মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হওয়া এত সহজ নয়।
ভাটির কাঁদামাটি গাঁয়ে মেখে উত্তাল হাওরের বিশালতার মধ্যে তাঁর সৃষ্টি। কারো রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেননি কখনো। তর্জনী উচিয়ে কথা বলেছেন জীবনভর। মঞ্চে কিংবা সংসদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের তেজদীপ্ত এবং চিরচেনা রসালো বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মত আকৃষ্ট করত সবাইকে। আমার প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বহুগুণে বেড়ে যায় আরও একটি কারণে, আর সেটি হল ২০১৫ সালে যখন আমার গ্রামের বাড়ি শাল্লা থানার নারকিলা গ্রাম থেকে ৭টি গরু চুরি হয়ে যায়, তখন একদিন তিনি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমাকে সান্ত্বনা বাক্য শুনান এবং আরও জানান যে, তিনি শাল্লা থানার পুলিশ কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, মেম্বারদেরকে এ বিষয়টি দেখার জন্য বলেছেন। তাঁর (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) মত বিশ্বমানের নেতার কাছ থেকে ফোন পেয়ে আমি ধন্য হলাম এবং পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে উনার দীর্ঘায়ূ কামনা করি। সৃষ্টিকর্তা আমার ডাক শুনেন নি। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। এরকম পলিটিশিয়ান সব দেশেই বিরল।