মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
ঢাকায় ছয় ঘন্টা ব্যাপী ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে কোনো সমাঝোতা ছাড়াই মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের বৈঠক শেষ হয়েছে। বাগান মালিকপক্ষ ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকা মজুরি দেওয়ার কথা বলেছে। তবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে চা শ্রমিকনেতারা।
বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওযায় মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের ২৩২টি চা বাগানে ষষ্ঠ দিনের ধর্মঘট করেছে চা শ্রমিককেরা। ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সারা দেশে চা শ্রমিকেরা তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত রয়েছে।
১৮ আগষ্ট বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া চাবাগানের ফিনলে চা কারখানার সামনে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করছে। একইসাথে দেশের সবকটি চা বাগানের শ্রমিককেরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।
শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী নেতৃত্বে গত (১৭ আগষ্ট) বুধবার বিকাল ৫টার বৈঠক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৈঠক ৬টায় শুরু হয়ে রাত ১১টায় শেষ হয়। বৈঠকের প্রথমদিকে চা শ্রমিক নেতারা মজুরি বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। পরে মালিকপক্ষ তাদের বক্তব্যে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
আলোচনায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষ কোনো সমঝোতায় আসতে না পারায় রাত সাড়ে ৮টায় চা বিরতি দেয়া হয়। পরে আবার শুরু হয় বৈঠক। কিন্তু বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।
এর আগে গত (১৬ আগষ্ট) মঙ্গলবার চা শ্রমিকনেতাদের নিয়ে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী শ্রীমঙ্গলস্থ শ্রম অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৈঠকে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় ওই ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী, বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি শাহ আলম, চা সংদরে কনভেনার তাহসিন আহমদ চৌধুরী, এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরী, সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি, মনু ধলাই ভ্যালির সম্পাদক নির্মল দাশ পাইনকা, সিলেট ভ্যালীর রাজু গোয়ালাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ বলেন, ‘ছয়ঘন্টা ধরে চলা বৈঠককে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। মালিকপক্ষ বৈঠকে যে মজুরি প্রস্তাব করেছেন সেটি ৩০০ টাকার ধারে কাছেও নয়। আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম চলবে আর আলোচনার দোয়ারও খোলা থাকবে, আমাদের আপত্তি নাই।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, ‘শ্রম অধিদপ্তরে আলোচনায় বসেছিলাম। অলোচনায় কোনো সমাধান হয় নাই। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা করার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সেটা আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমরা ৩শ টাকার মজুরির দাবি অটল রয়েছিলাম। আমরা মালিকপক্ষকে বলেছি, আমাদের মানুষের সাথে আলোচনা করে পরবর্তীতে আপনাদেরকে জানিয়ে দিবো।’
তিনি আরও বলেন, আগামী ২৩ আগষ্ট আন্ত:মন্ত্রণালয়ের মিটিং আছে, আমাদেরকে ডেকেছে, আমরা মিটিং বসবো। এর আগে আমরা মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন, প্রধানমন্ত্রী যদি হস্তক্ষেপ না করেন? তাহলে বাগান শান্তি হবে না এবং শ্রমজীবি খেটে খাওয়া চা শ্রমিকরা দু-বেলা ভাত খেতে পারবে না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি শাহ আলম বলেন, শ্রমিক নেতারা দুই দিনের সময় নিয়েছেন। তাঁরা পরে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। তিনি আরও বলেন, চা উৎপাদন কোনো বছর ভালো হয়, আবার কোনো বছর খারাপ হয়, সেটা আবহাওয়ার কারণে। চা শ্রমিকদের সাথে আমরা দুই বছর পরপর চুক্তি সম্পাদন করি। এখন মজুরি নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছে, সেটা দেশের স্বার্থে ও মালিকদের স্বার্থে সামাল দিতে হবে। আমাদের উৎপাদন ব্যহৃত হচ্ছে, প্রথমে শ্রমিকনেতাদের বলেছি, যাতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে যান, মজুরির বিষয়টি আমরা সমাধান করবো নিজেরাই। তাঁরা আমাদের কথা রাখেনি। চা শিল্পে প্রচুর পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট লাগে। সেটাও বুঝতে হবে তাদের।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিল। ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকা মজুরি দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। সরকারের ডাকে আমরা বৈঠকে এসেছি। আবার ডাকলে আবার আসব। আলোচনা করব। কিন্তু আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।’
বাংলাদেশ শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, মালিক শ্রমিকদের বৈঠকে কোনো সিন্ধান্ত হয়নি। তবে আলোচনা চলবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নাই যে তাঁরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে কি না। উনারা একদিন সময় চেয়েছেন। উনাদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন ২/১ দিনের মধ্যে। প্রয়োজনে ২/৩ দিনের পরে আরেকটা মিটিং করবো, সেই সিদ্ধান্ত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২৩ তারিখে ত্রিপক্ষীয় মিটিং আছে, সেটাও বহাল আছে।
ফিনলে টি কোম্পানির চারটি বাগানের সহকারী ম্যানেরজারের জিডি:
এদিকে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের চলমান ধর্মঘটের মধ্যে ৪টি চা-বাগানের পক্ষ থেকে শ্রীমঙ্গল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে কাঁচা চা-পাতা নষ্ট হওয়ার কারণে এ জিডি করা হয়। শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা-বাগান, ডিনস্টন চা-বাগান, আমরাইল ছড়া চা-বাগান ও বালিশিরা চা-বাগানসহ ৪টি চা-বাগানের সহকারী ম্যানেজাররা বাদী হয়ে আলাদাভাবে সাধারণ ডায়েরি করেছেন। অভিযোগ করা হয়েছে, চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে ফিনলে টি কোম্পানির রাজঘাট চা বাগানের ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩৫ কেজি, ডিনস্টন চা কারখানায় ৯৯ হাজার ২৫০ কেজি, বালিশিরা চা কারখানায় ৫০ হাজার ২০৭ কেজি, আমরাইল চা কারখানায় ৫ হাজার ৬৮৩ কেজি কাঁচা চা-পাতা নষ্ট হয়ে গেছে।
শ্রীমঙ্গল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির বলেন, পৃথকভাবে চা বাগানের ম্যানেজাররা ৪টি জিডি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত ৩শ’ টাকা মজুরির দাবিতে ৯ আগষ্ট থেকে চার দিন কর্মবিরতি এবং গত ১১ আগষ্ট শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট করছেন চা শ্রমিকেরা।