কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে মায়ের বুকের দুধ পান করা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, দু’বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করা শিশুর সংখ্যা বেড়ে ৮৭.৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা শ্রীলঙ্কা এবং কিউবায় এর হার যথাক্রমে ৮৮ ও ৮৭.৫ শতাংশ। মায়ের বুকের দুধের পরিবর্তে কৌটার বা বাজারের দুধ খেলে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে এ শিক্ষাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে পুষ্টি ধারণা বাড়বে এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ও মায়ের সংখ্যা কমে আসবে বলে মনে করেন মাতৃ ও শিশু পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ ১ আগষ্ট থেকে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কোন গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর পরিপূরক খাদ্য ও তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি নিবন্ধন ছাড়া আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিক্রয় বা বিতরণ করা যাবে না। বিজ্ঞাপন মুদ্রণ, প্রদর্শন, প্রচার অথবা প্রকাশ করা যাবে না বলে জানিয়েছেন ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানীরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, মাতৃদুগ্ধ শিশুর জন্মগত অধিকার। কোন কোন মা তার সন্তানকে কৃত্রিমভাবে তৈরি দুধ পান করিয়ে শিশুকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। আমি মনে করি এখানেই মা ও শিশুর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সকল মাকে নবজাতককে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ আর সুস্থ দেহ ও মনের জন্য মাতৃদুগ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির নিয়মে সন্তানের জন্য মায়ের দুধই সেরা খাবার। আধুনিক যুগের কৃত্রিম দুধের কুফলই বেশি। নিজ সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে। গৃহকর্মীর কাছে বেড়ে ওঠা শিশু অবহেলায় থাকে, মাতৃদুগ্ধ পায় না। প্রতিটি সরকারী অফিসে ব্রেস্টফিডিং সেন্টার থাকবে উল্লেখ করে নাসিম বলেন, তবে এ পদক্ষেপের বাস্তবায়ন এখনও সম্ভব না হলেও মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ এস কে রায় জনকণ্ঠকে বলেন, জীবনের প্রথম ৬ মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশু যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। আর জন্মের ৬ মাস পর শিশুকে বাড়তি খাবার খাওয়াতে শুরু করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার বলতে শুধু দামী খাবারকে বুঝায় না। অনেক পুষ্টি উপাদান বাড়ির আশপাশেই রয়েছে, যা স্বল্প মূল্যে সংগ্রহ করা সম্ভব। পারিবারিক খাবার থেকেই আলাদা করে (নরম ও গুঁড়ো করে মাখিয়ে) শিশুকে দেয়া যায়।
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশু বয়স ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার পর থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের বুকের পাশাপাশি সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। শিশুকে প্রতিদিন কমপক্ষে চার ধরনের খাবার খাওয়ানো উচিত। প্রাণিজ, ভিটামিন সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাক-সবজি, দুগ্ধজাত, তেল ও চর্বি জাতীয়, মটরশুটি ও ডাল এবং শস্য দানা জাতীয় খাবার থাকা প্রয়োজন। প্রাণিজ খাবারের মধ্যে ডিম, মাংস, কলিজা ও মাছ থেকে দৈহিক ও মেধা বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক শক্তি এবং ভিটামিন ও খনিজ উপাদান (আয়রন ও উচ্চমানের আমিষ) পাওয়া যায়। শিশু ও মাকে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার মাছ, গাজর ও গাঢ় শাক-সবজি খাওয়ানো উচিত। আয়রন ঘাটতি রক্ত স্বল্পতার একটি প্রধান কারণ। রক্ত স্বল্পতার ফলে শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বাধা পায়। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার কলিজা, মাছ ও গাঢ় সবুজ শাক-সবজি খাওয়ানো দরকার। ১৮১ দিন থেকে শুরু করে ৮ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুকে পরিবারের অন্যদের মতো খাবার খাওয়ানো শুরু করা উচিত। এ জন্য দিনে দু’বার ২৫০ মিলিলিটার (এক পোয়া) বাটির অর্ধেক বাটি শক্ত বা নরম খাবার খাওয়ানো পাশাপাশি দিনে দু’বার পুষ্টিকর হালকা খাবার খেতে দিতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ৯ মাসের শুরু থেকে ১১ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিনে তিনবার ২৫০ মিলিলিটার বাটির অর্ধেক বাটি খাবার খাওয়াতে হবে। এছাড়া, দিনে দু’বার পুষ্টিকর হালকা খাবার খেতে দিতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ১২ মাস থেকে ২৩ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিনে তিনবার ২৫০ মিলিলিটার বাটির পুরো বাটি খাবার খাওয়ানো হবে। এছাড়া দিনে দু’বার পুষ্টিকর হালকা খাবার খেতে দিতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, অপুষ্টির প্রভাব ব্যক্তি এবং পারিবারিক গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর এর রয়েছে ভয়াবহ ও স্থায়ী প্রভাব। শিশুর সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুশীলন না করার কারণে সৃষ্ট অপুষ্টি ও এর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে হবে। বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতি, পরিপূরক খাবার, নবজাতক ও শিশুর খাদ্যাভ্যাসের অংশ হিসেবে মায়ের দুধ খাওয়ানো, অসুস্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট খাবারের সমস্যার প্রভাব ও পুষ্টি বিষয়ক আইনের গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা।