লন্ডনে সিলেটিদের গোড়া পত্তন

450

সৈয়দ সুজাত আলী

জাহাজ পালানো কিছু নাবিক ১৯২০ সাল থেকে পূর্ব লন্ডনে বাস করতেন। তারা সেখানে আছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। লন্ডনের চোখে সিলেটি সম্প্রদায় ঐতিহ্য অনুযায়ী সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকে লন্ডনে। অন্য নাবিকদেরও প্রধান আকর্ষণ সিলেটিদের এই আস্তানা। টিলা বারিতে জাহাজ গেলে নাবিকরা নামবেই। আর দেশী সিলেটিদের সাথে সঙ্গে খোশ গল্প করবে। তাদের বাড়িতে খাবার খাবে। ১৯২০ সালে লন্ডনে সিলেটির সংখ্যা ছিল নগণ্য। বেশির ভাগই ফিরে যেতো জাহাজে। শুধু রাতে ক্লাবে যাওয়া, একটু বাজার করা। এডেন কিংবা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আনা কিছু মনোহারী জিনিষ বিক্রি করা, কাপড় কেনা, নয়তো বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য একটি সেলাই মেশিন কেনা লন্ডনের কাজ বলতে এইটুকু। এই ভাবেই লন্ডনে সিলেটিদের গোড়া পত্তন ঘটে। যতদূর জানা যায়, সিলেটিদের মধ্যে প্রথম সৈয়দ আলী ১৮০৯ সালে বিলেত  আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাহাজী শ্রমিক নেতা আফতাব আলীর প্রচেষ্টায় অনেক লোক যুক্তরাজ্য আসতে সক্ষম হন। তাদের প্রায় সবাই ছিলেন জাহাজী। প্রবাসীদের অনেকইে বাস করতেন লন্ডনে। অন্যরা থাকতেন বিভিন্ন এলাকায়। মানচেস্টার, লিভারপুল, কার্ডিফ, গ্লাসকো ও সাউথ শিল্ড শহরের সীমেন বোর্ডিং ও লজিং হাউসে। এই ভাবে সিলেটিরা সারা ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েন। সিলেট অঞ্চলের লোকেরা বৃটিশ সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে বিলাতে আগমন করেন। অনেকেই এখানে বসতি স্থাপন করলেও কেউ কেউ চলে যান স্বদেশে। লন্ডনে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে পশ্চিম লন্ডনের চীন রোড ও ব্যারিড রোডে বাস করতেন। তাদের বেশির ভাগ লোকেরাই রেষ্টুরেন্ট, ক্লাব, হাউস ও হোটেল সমূহে ক্লিনার কিচেন পটার কুক ও শেফ ইত্যাদি ক্যাটাগরিংয়ের কাজ করতেন। ব্রিটেনের রাণী বাংলায় আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আমন্ত্রণে। তাহাকে পুরো ইতিবৃত্ত বুঝিয়ে বললেন হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও আফতাব আলী। দুশো বছর ধরে কেমন করে ইংরেজরা ভারত শাসন করেছে। ভারতীয়রা কত দরিদ্র আর কেনইবা তারা রোজগার করতে ইংল্যান্ড আসতে চায় এসব কথা তাঁরা বুঝিয়ে বলেন। রাণী বললেন ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে পার্লামেন্টকে বুঝিয়ে বলবেন ভাউচার দিতে। রাণী তাঁর কথা রেখেছিলেন। এমনি করে শুরু হয় সিলেটিদের বিলেত আসা। ভাউচারের মাধ্যমে অনেকেই বিলেতে যেতে সক্ষম হন। তাদের পাসপোর্ট দেবার ব্যাপারে আব্দুল মান্নান ছানু মিয়া ও তসদ্দুক আহমদ  অনেকই সহযোগিতা করেন। ঠিক এই সময়ে পাকিস্তান ওভারসীজ সিম্যান ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রমিক নেতা আফতাব আলী, সেক্রেটারী সৈয়দ উসমান আলী সারেং। ঢাকা কোর্টের সামনে এর কেন্দ্রীয় অফিস ও সিলেটের স্টেশন রোডে শাখা অফিস খোলা হয়। প্রধানত জাহাজীরাই এর সদস্য হন। কিছুদিনের মধ্যেই এর সদস্য সংখ্যা ২৫ হাজারে উন্নিত হয়। প্রখ্যাত জাহাজী নেতা আফতাব আলী ও সৈয়দ উসমান আলীর সহায়তার প্রথম দিকে জাহাজী শ্রমিকরা ও তাদের নিকট আত্মীয় যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে আফতাব আলী ও সৈয়দ উসমান আলী ট্রেভেল এজেন্সি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে থেকেই যুক্তরাজ্যে সিলেট অঞ্চলের লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সিলেটের  কিংবদন্তী পুরুষ তৌরিছ মিয়া লন্ডন যাওয়া নিয়ে একটি ঐতিহাসিক গান রচনা করেন :
উঠলোরে লন্ডনের জ্বর, বিক্রি করছে বাড়ীঘর
তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর, দিন গইয়া যায়রে।
বন্ধুবান্ধব যারা ছিল, সকলি লন্ডনে গেল
দেশটা শ্মশান হইল, করি কি উপায়?
বৃদ্ধ-জোয়ান সবে কয়, পাসপোর্ট করিতে হয়
মেডিক্যাল এডমিট কার্ড লাইনে, পাসপোর্ট বানায়রে।
মোল্লা-মুনশী পাসপোর্ট করে, লন্ডনী ভূত উঠলো ঘাঁড়ে
ফটো তুলতে যাইয়া বেটায় দাড়িটা মুন্ডায়।
রিজেকেরও মালিক শাঁই, জ্ঞান-বিশ্বাসে জানে নাই
পড়িয়াছে মোল্লা বেটা, শয়তানের ধোঁকায়রে।
পড়িয়াছে মোল্লা বেটা, শয়তানের ধোঁকায়।।
জমি, বাড়ী বেচে আনলো টাকা, বান্ধিয়া না যায়রে রাখা
পাসপোর্টের কারবারী দেখে, টাকাটা সমজায়।
কারবারীর আর অভাব নাই, নাম কত বলব ভাই
বড়ইকান্দির চেরাগ মিয়া, ভালো কাম চালায়রে।
সিলেট গজনভী নাম, ছুটু মিয়া চান্দভরাং
বনগাঁওয়ের বশর মিয়া, পাসপোর্ট বানায়।
করিমপুরের উস্তার আলী, নাম ধরে আর কত বলি
শাহারপাড়ার আরেক মিয়া, নাম কইতাম নায়রে।
আব্দুল আজীম, সাইস্তা মিয়া, কলমদর, আফসর লাগাইয়া
সৈয়দপুরের উসমান আলী, সারং চাচায়
সকলে সল্লা করিয়া, এমপয়নমেন্ট বাহির করিয়া
মাত্র দেড়শ’ টাকা দিলে, পাসপোর্ট হইয়া যায়রে।
শাহারপাড়ার আমীন মিয়া, করাচী সাহেব বনিয়া
পাসপোর্টের পারমিট আনিয়া, দেখাইলেন সবায়।
দেখে লোক দেওয়ানা হইল, কন্ট্রল দরে টাকারে দিল
হায়রে কন্ট্রলের পাসপোর্ট, ঘুমাইছে ঢাকায়রে।
যে জনে যেই ভাবে পারে, পাসপোর্ট একটা তৈয়ার করে
ভাড়ার টাকা জোগাড় করে, চলছেরে ঢাকায়
সাতকরা আর নালিপাতা, কি বলব লজ্জারই কথা
সুটকেস ভরিয়া গেছে, শুটকির বস্তায়রে। (সংক্ষিপ্ত)