স্কুলছাত্র সাঈদ হত্যা, ঘাতক গেদার স্বীকারোক্তি ॥ ‘এবাদ গলায় রশি পেঁচিয়ে ধরে, আমি গলা, মাসুম হাত ও রাকিব পা চেপে ধরে’

77

Copy of geda miaস্টাফ রিপোর্টার :
নগরীতে স্কুলছাত্র আবু সাঈদ হত্যা মামলায় দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে র‌্যাবের সোর্স আতাউর রহমান গেদা মিয়া। গতকাল রবিবার সিলেটের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক মো: সাহেদুল করিমের আদালতে গেদা মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে সে স্কুল ছাত্র আবু সাঈদ হত্যাকান্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়ে বলেন, অর্থলোভে পড়েই তারা আবু সাঈদকে অপহরণ করেছিলো। এ অপহরণের পরিকল্পনা নগরীর জিন্দাবাজারের একটি রেস্টুরেন্টে বসে করা হয়। অপহরণকারীদের চিনে ফেলায় সাঈদকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। হত্যাকান্ডের সময় সে সাঈদের গলাটিপে ধরেছিলো। এছাড়া অপহরণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হত্যাকান্ড ও লাশ গুমের পরিকল্পনাসহ সহযোগিদের কথাও জানায় সে।
গত বৃহস্পতিবার সিলেটের চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবিএম জহিরুল গণি চৌধুরী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আতাউর রহমান গেদার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে সিলেটের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে বিচারক সাহেদুল করিম গেদার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সূত্র জানায়, প্রথম দফা রিমান্ডে সোর্স গেদা বিভিন্নভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে পুলিশের কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে নিজের সংশ্লিষ্টতা ¬স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজী হয়। এর আগে আলোচিত এ হত্যাকান্ডে গ্রেফতার হওয়া পুলিশ কনস্টেবল এবাদুল ও জেলা ওলামালীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
এ ব্যাপারে এসএমপি’র কোতয়ালী থানার আদালতে থাকা (জি আর ও ) দূর্গা কুমার জানান, আদালতে গেদা তার স্বীকারোক্তিমূলক জবান বন্দি প্রদান করেছে  এবং একটি বাসার  সিকিউরিটি গার্ডের কথাও উল্লে¬খ করেছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, পুলিশ কনস্টেবল এবাদুল ও ওলামালীগ নেতা রকিবের পর নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে গেদা মিয়া আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
উল্লেখ্য, নিহত শিশু আবু সাঈদ নগরীর রায়নগর দর্জিবন্ধ বসুন্ধরা ৭৪ নম্বর বাসার আবদুল মতিনের পুত্র ও শাহী ঈদগাহ এলাকাধীন হযরত শাহ মীর (রহ.) সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। মামার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার পথে ১১ মার্চ বুধবার সকাল ১১টার দিকে নগরীর রায়নগর এলাকা থেকে অপহৃত হয় আবু সাঈদ (৯)। এরপর গত শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর কুমারপাড়া ঝর্ণারপার এলাকায় পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমানের বাসা থেকে তার গলিত লাশ উদ্ধার করে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গেদা স্বীকারোক্তিতে যা বলেছে… : শিশু সাঈদ হত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী র‌্যাবের সোর্স গেদা কর্তৃক আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তি মূলক জবান বন্দি পাঠকদের জন্য নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলে। (কোতয়ালী থানার মামলা নং ১৬ তাং১৪/৩/১৫ইং, ধারা-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৭,৮এ ৩০ সংযোজনকৃত ৩০২/২০১/৩৪দঃবিঃ এ আসামী মোঃ আতাউর রহমান গেদা এর ১৬৪ ধারানুসারে লিপিকৃত দোষ স্বীকারোক্তি চলমান অংশ)।
সাঈদকে এলাকায় দেখে সন্দেহ হলে অনুসর করে দেখি সে কামাল চাচার মালিকের বাসায় ঢুকে, মালিক লন্ডন থাকে। কামাল চাচা ঐ তিন তলা বিল্ডিং দেখাশুনা করেন। এবং লাগোয়া একটা টিন সেডে অন্য একজন খাট লোক সহ থাকেন। খবরা খবর নিয়ে নিশ্চিত হই ঐ বাসায় ২৯০ ধারার অপরাধ হয়। গত মাসের ২৬ তারিখ আমি, রাকিব, পুলিশের ছেলে রুবেলসহ এলাকার কয়েকজন লোক নিয়ে ঐ বাসায় রেইড দিয়ে ৩য় তলায় আয়েশাসহ মোট ৪ জন মহিলা ও একজন পুরুষকে পাই। খবর পেয়ে এবাদ এসে এর মধ্যস্থতা করে। সে এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল। পরের দিনই মহিলাদের বের করে দেয়া হয়। এর পরে এবাদের সাথে আমার পরিচয় ও সখ্য গড়ে উঠে।
গত বুধবারের আগের বুধবার ১১ তারিখ সকাল বেলা আমি বন্দর বাজার ছিলাম। এবাদ ফোন দিয়ে এতিম স্কুলের সামনে  যেতে বলে। গিয়ে এবাদ, মাছুম ও রাকিবকে এবাদ জানায়, একটা ছেলেকে কিডন্যাপ করা হবে মুক্তি পণ হিসেবে টাকা যা পাওয়া যাবে তার একটা ভাগ আমাকে দেয়া হবে। আমার দায়িত্ব ছিল বাহিরের খবরাখবর রাখা। তখন সাঈদ আইসক্রিম কিনতে দোকানে আসে। তাকেই কিডন্যাপ করা হবে বলে এবাদ জানালে আমি এলাকার লোক সবাই আমাকে চিনবে বলে আমি সেলুনের সামনে চলে যাই। এবাদরা তিনজন সাঈদকে কথা বলে বলে এবাদের বাসায় নিয়ে যায়। এবাদের পুরো বিল্ডিং খালি। সে শুধু একা, পরিবার শ্বশুর বাড়ি। একটু পর আমি এবাদের দুতলাস্থ বাসায় যাই। গিয়ে সাঈদের মুখ হাত বেঁধে ফেলি। একটি পুরাতন মডেলের নকিয়া মোবাইলের মাধ্যমে (যার মধ্যে এয়ারটেলের সিম ছিল) এবাদরা তিনজন কারো সাথে যোগাযোগ করে পাঁচলক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। বিকেলের দিকে আমরা বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে যাই। আমাকে খবরাখবর রাখতে বলে তারা চলে যায়। আমি বাসায় চলে যাই। পরের দিন সকাল বেলা সাঈদের মামা আমাকে ফোন দিয়ে সাঈদ হারিয়ে গেছে, আমি র‌্যাব এর সোর্স তাদেরকে সাহায্য করতে বলে। ১০ টার দিকে তাদের বাসায় যাই। সেখানে চা খাই তখন এয়ারটেলের ঐ নাম্বার থেকে দুটি ম্যাসেজ সাঈদের মামা জয়নালের মোবাইলে আসে দ্রুত টাকা দেয়ার জন্য এবং টাকা দেয়ার লোকেশন তারা জানাবে বলে ঐ টেক্সে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জয়নাল ভাই আমাকে জানায়। আমি জয়নাল ভাই ও সাঈদের এক নানাকে নিয়ে জালালাবাদ ফুলকলির দোকানে র‌্যাব এর সাথে দেখা করি। সেখানে কথাবার্তা বলে এলাকায় চলে আসি। জয়নালদের থেকে আলাদা হয়ে ঐ মোবাইল নম্বরে ফোন করি। এবাদ নাম্বারটি ব্যবহার করছিল। ফোন রিসিভ করে সে কোন কথাই বলেনি। আমি জানাই যে, টাকা দিতে পার্টি প্রস্তুত আছে, ছেলেকে ছেড়ে দিলেই টাকা পাওয়া যাবে। তাকে অনুনয় বিনয় করে বলি নইলে আমি ফেঁসে যাবো, আমার এলাকার ঘটনা প্রায় ১০ মিনিট কল ধরেছিল, কিন্তু কোন কথাই বলেনি, পরে কয়েকবার কল করি। তাও প্রায় ৫ মিনিট কল রিসিভ করে আমার কথা শোনে কিন্তু এরপর থেকে কোন কথা বলেনি। আমার মোবাইলে সব রের্কড হয়ে গেছে। তা পুলিশকে দিয়েছি। এবাদরা টাকার জন্য কোথাও যায়। আমি এলাকাতেই ছিলাম। বিকেল বেলা এবাদ ফোন করে বাসায় যেতে বলে বাসায় মূল গেটে কামাল চাচা ওখাট লোকটাকে দেখি। এবাদের রুমে গিয়ে এবাদ, মাসুম ও রাকিবকে দেখি। তারা খুব তর্কাতর্কি করছিল। তা থেকে জানতে পারি যে, সাঈদের আত্মীয় স্বজনরা টাকা দেয়নি, পুলিশে জানিয়ে দেয়ায় তারা ফেরত এসেছে। এক পর্যায়ে সাঈদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এবাদ সাঈদের গলায় রশি পেঁচিয়ে ধরে, আমি গলা চেপে ধরি, মাছুম হাত ও রাকিব পা চেপে ধরে থাকে। একটু ক্ষণের মধ্যেই সাঈদ মারা যায়। বাহিরের অবস্থা দেখার ও খবরাখবর নেয়ার জন্য আমি চলে যাই। তার তিন জন লাশের ব্যবস্থা করার কথা বলে। সমস্যা হলে আমি জানানোর কথা হয়।
পরের দিন শুক্রবার সকাল বেলা আমি সাঈদের মামা ও নানাকে নিয়ে শাহি ঈদগাহে র‌্যাবের সাথে দেখা করি। সারাদিন এলাকায় থাকি। রাত ১০:৩০ টার সময় এবাদ ফোন দিয়ে বাসায় যেতে বলে। বাসায় গেলে লাশ সরাতে হবে। গাড়ি চাব বলে এবাদ হুকুম দেয়। সুবিধা মত কোন গাড়ি ঐ রাতে পাইনি। সিদ্ধান্ত হয় দিনের বেলা লাশ সরানো যাবে না রাতের বেলা ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই শনিবার দিনে এলাকায় থাকি। রাত দশটার দিকে ফোন আসে জানায় বাড়া হয়েছে থানায় গিয়ে দেখি এবাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাকে থানা থেকেই গ্রেফতার করা হয়। স্যার আল্লাহ আছে, বিচার করবেন। আমি যা জানি তা বলেছি।