ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য নিরূপণ

861

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
রাজ্য ছিলো সে দেশে আর সেখানে ছোট ছোট উপভাষার সংখ্যাও বেশি। ঐসব উপভাষাগুলো আবার দীর্ঘ মিশ্র অঞ্চল দ্বারা বিচ্ছিন্ন। জার্মানির উপভাষা পরিস্থিতি অতীতের রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা এবং নিকট অতীতের আঞ্চলিক পটপরিবর্তনের প্রতিফলন। সমাজ কাঠামো বা সামাজিক কার্যকারণ কিভাবে ভাষাকে প্রভাবিত করে লিওনার্ড ব্লুমফিল্ড তা বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁর মতে মানব সমাজের ভাষাতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য জনবসতির গভীরতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং ভাষাভাষীর পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যাপকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। পূর্বে ভাষাতাত্ত্বিকরা ভাষা ও পরিবেশগত কারণের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতেন, ব্লুমফিল্ড মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ব্যাপারটি ভাষাতাত্ত্বিক ও অভাষাতাত্ত্বিক বিষয়ের মধ্যে মাধ্যমরূপে চিহ্নিত করেছেন। ভাষার মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমন কি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষভাবে প্রতিফলিত বলে তিনি মনে করেন নি, ঐসব বিষয় মানুষের মৌলিক যোগাযোগকে যতটা চালিত করতে পারে ততটুকুই তা ভাষাকে প্রভাবিত করে। ‘‘খবড়হধৎফ ইষড়ড়সভরবষফ, খধহমঁধমব, ঘবি ণড়ৎশ, ঐড়ষঃ, জরহবযধৎঃ ্ ডরহংঃড়হ, ১৯৩৩.’’
অধুনা সামাজিক ভাষাতত্ত্বের লক্ষ্য ভাষাসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষার ভিত্তিতে সামাজিক ব্যবস্থাসমূহ তুলনা করা। ভাষার কোন্ রূপ কত লোক কি পরিবেশে ব্যবহার করে থাকে এবং ভাষার বিভিন্ন রূপের প্রতি স্থানীয় মনোভাব কি তা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়। ঐ বিষয়টি অনুধাবনের জন্যে ভাষার দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়। যার একটি ভাষার অভ্যন্তরীণ রূপ, অপরটি যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ভাষার ভূমিকা। ভাষার প্রথম বৈশিষ্ট্যে যেসব বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য যাচাই করা হয় সেগুলো হলো, ‘স্টান্ডার্ড’ বা শিষ্টভাষা, ‘ভারনাকুলার’ বা লোকভাষা, ধ্র“পদী এবং মিশ্রভাষা। ভাষার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বা যোগাযোগ মাধ্যম রূপে যেসব বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য খোঁজা হয় তা হলো, ব্যক্তি বা শ্রেণির ভাষা, বৃহত্তর যোগাযোগের ভাষা, পেশা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা ইত্যাদি। ‘‘ঔড়যহ ঔ. এঁসঢ়বৎু, ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ, উরৎবপঃরড়হং রহ ঝড়পরড় খরহমঁরংঃরপং, ঘবি ণড়ৎশ, ঐড়ষঃ, জরহবযধৎঃ ্ ডরহংঃড়হ, ১৯৭২, চ ১-২৫.’’
ঐ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিককালে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জরিপ চালান হয়, এসব জরিপ নাগরিক পরিবেশে ভাষার পরিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের ভাষাতাত্ত্বিক জরিপ থেকে দেখা যায়, যেখানে শিক্ষার হার খুব বেশি সেখানে শিষ্ট ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষারও সহ অবস্থান রয়েছে। স্কটল্যান্ডে শিষ্ট ভাষার বৈশিষ্ট্য স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্নতর হওয়ায় বোঝা যায়
ভাষার বৈচিত্র্য মূলত সামাজিক সম্পর্কের ওপরেই নির্ভরশীল, আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক প্রভাব সেখানে পরোক্ষ। আমেরিকায় ভাষাতাত্ত্বিক উইলিয়ম লেবভ নিউইয়র্ক মহানগরীর ইংরেজি ভাষার বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে প্রশ্নমালা ও উত্তর সংগ্রহের প্রচলিত উপভাষা জরিপ পদ্ধতি বর্জন করে নতুন রীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তিনি এক একটি অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের মধ্য থেকে বিশেষ নির্ভরযোগ্য উপভাষাভাষী বেছে নিয়ে তাদের ভাষার সম্ভাব্য সকল বৈশিষ্ট্য জরিপ করেন। শুরুতে তিনি নির্দিষ্ট এলাকার এমন কয়েকটি ধ্বনিতাত্ত্বিক ও ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য জরিপ নির্বাচন করেন যা দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত এবং ঐ এলাকার মানুষের ব্যক্তিভঙ্গির বৈচিত্র্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, সর্বোপরি যার মধ্যে সামাজিক তথ্যাদি সর্বাধিক ধরা পড়ে। তিনি বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যগুলো লিপিবদ্ধ করেন, প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তির কাছ থেকে তার ভাষাতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন প্রকার ঘরোয়া ও আনুষ্ঠানিক পরিবেশে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তিনি তার উপাদানকে সম্প্রসারিত করেন। এই পদ্ধতিতে ভাষাভাষীর সমাজ শ্রেণীগত ও জাতিগত বৈচিত্র্য নির্ভরযোগ্য রূপে ধরা পড়ে। উইলিয়াম লেবভ তার জটিল ও কার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে ভাষার সমসাময়িক পরিবর্তনকেও সনাক্ত এবং দৃশ্যমান করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ‘‘ঔড়যহ ঔ. এঁসঢ়বৎু, ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ, উরৎবপঃরড়হং রহ ঝড়পরড় খরহমঁরংঃরপং, ঘবি ণড়ৎশ, ঐড়ষঃ জরহবযধৎঃ ্ ডরহংঃড়হ, ১৯৭২, চ. ১-২৫.’’ বর্তমানকালে ইংরেজি ভাষার স্বরধ্বনি পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি সমগ্র ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জরীপ ও বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। লেবভের যুগান্তকারী ‘নিউইয়র্ক সমীক্ষা’ আমেরিকায় সামাজিক ভাষাতত্ত্বের নতুন ঐতিহ্য ও ধারা সৃষ্টি করেছে। উপভাষাতত্ত্ব আর কেবল মাত্র আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ ও সংকলন নয় বা ভাষার ভৌগোলিক বৈষম্য অনুসন্ধান নয় বরং ভাষার বহুমুখী সামাজিক ভূমিকার সমীক্ষা।
উপভাষাতত্ত্বের বিবর্তনের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলা ভাষার বৈচিত্র্য বিশ্লেষণের যে সব প্রয়াস হয়েছে তার আলোচনা করতে পারি। পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দা আস্সুস্পাসাঁও ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ভোকাবুলারিও এম্ ইদিওমা বেন্গাল্লা এ পর্তুগিজ’ নামক বাংলা ভাষার যে প্রথম ব্যাকরণটি ঢাকা জেলার ভাওয়াল পরগানায় বসে রচনা করেছিলেন তাতে ভাওয়াল অঞ্চলের উপভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত উক্ত লেখকের ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ বেদ’ গ্রন্থেও ভাওয়ালের উপভাষা ব্যবহৃত হয়। শতাধিক বছর পূর্বে পূর্ববাংলার উপভাষার রূপ কেমন ছিল তার যৎকিঞ্চিৎ নমুনা মানোএলের ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ, বেদ’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। গ্রন্থটিতে গুরু ও শিষ্যের নিম্নরূপ কথোপকথন রয়েছে:
শি : পূজ্য হোক সিদ্ধি পরম নির্মল ধর্ম।
গু : তিনি তোমার আশীর্বাদ দেক, এবং তোমারে ভাল করুক; আইস পোলা, তুমি কেটা?
শি : আমি খ্রীস্তাও, পরমেশ্বরের কৃপায়।
গু : কোথায় যাও?
শি : বারিতে যাই।
গু : তোমার বারি কোথায়?
শি : ভাওয়াল দেশে; আমি তোমার বাইয়ত। নাগরিতে বসি।
গু : আমি তো সেখানে যাই। আমার সঙ্গে আইস। ‘‘ সবিতা চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গালা ইউরোপীয় লেখক, কলিকাতা, ফার্মা কে.এল. মুখোপাধ্যায়, ১৯৭২, পৃ. ৯৩-৯৯।’’
মানোএলের ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ, বেদ’ গ্রন্থের নাম পৃষ্ঠাতেই উল্লেখ আছে :
ফাদার মনোএল-দা আস্সুস্পাসাঁও লিখিয়াছেন এবং বুঝাইয়াছেন বাঙ্গালাতে ভাওয়াল দেশে, সন, হাজার সাত শত পাইনতিশ বসসর খ্রীস্টর জর্ম বাদে। ‘‘ সবিতা চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গালা ইউরোপীয় লেখক, কলিকাতা, ফার্মা কে.এল. মুখোপাধ্যায়, ১৯৭২, পৃ. ৯৩-৯৯।’’
গ্রন্থটিতে গুরু ও শিষ্যের, সংলাপ থেকে শতাধিক বছর পূর্বের পূর্ববঙ্গের উপভাষার নিম্ন প্রকার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উদ্ধার করা যায়। ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য-পশ্চাৎ নিম্নমধ্য গোলাকৃতি ‘অ’ স্বরধ্বনির স্থানে পশ্চাৎ উচ্চ গোলাকৃতি ‘উ’ ধ্বনি, যথা শহর > গুহর। পশ্চাৎ উচ্চ মধ্য গোলাকৃতি ‘ও’ ধ্বনির স্থানে পশ্চাৎ উচ্চ গোলাকৃতি ‘উ’ ধ্বনি, মোটা > মুটা। অঘোষ স্বল্পপ্রাণ স্পৃষ্ট কণ্ঠ ‘ক’ ধ্বনির স্থানে ঘোষ স্বল্পপ্রাণ ‘গ’ ধ্বনি, কাক > কাগ, শাক > শাগ। শব্দের আদি অবস্থানে উষ্ম তালব্য ব্যঞ্জন ‘স/শ’ স্থানে ‘হ’ সকল > হগল। স্বরমধ্যবর্তী অঘোষ স্বল্প ও মহাপ্রাণ স্পৃষ্ট কণ্ঠ ‘ক’ ও ‘খ’ স্থানে ‘হ’, রাখাল > রাহআল। ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ, বেদ’ গ্রন্থে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার বর্তমানে প্রচলিত রূপ ‘কইন্যা’ বা ‘রাইখ্যা’ নেই আছে ‘কনিয়া’, ‘রাখিয়া’ তবে ‘মধ্যে’ শব্দের রূপ সেখানে ‘মইধে’। শব্দ মধ্যে ‘ই’ আগমের পূর্ববঙ্গীয় রীতির উপস্থিতি রয়েছে, যেমন- বোন > বইন, চার > ছাইর, ষাট > ষাইট ইত্যাদি।
রূপতত্ত্বে, পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে কর্তৃকারকে ‘এ’ বিভক্তির ব্যবহার ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ বেদ’ গ্রন্থে লক্ষণীয়, যেমন- ‘মাইয়াএ মরিয়া গেল’, ‘মাতাএ ছাওয়ালের উপরে প্রতি রাইতে সিদ্ধি ক্রুশ করিয়াছিল’ ইত্যাদি।
বাক্যরীতিতেও গ্রন্থটিতে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার রীতি পাওয়া যায় যেমন- ‘আইস পোলা তুমি কেটা?’ ‘তুমি নি আস্থার নিরূপণ জান?’ ‘হায় জানি।’ ইত্যাদি। উক্ত গ্রন্থে পূর্ববাংলার উপভাষায় ব্যবহৃত অনেক শব্দ পাওয়া যায়, যেমন- যথা, ছাওয়াল, মাইয়া, পোলা, ফাল, লগে ইত্যাদি। ‘‘ সবিতা চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গালা ইউরোপীয় লেখক, কলিকাতা, ফার্মা কে.এল. মুখোপাধ্যায়, ১৯৭২, পৃ. ৯৩-৯৯।’’
উত্তরবঙ্গীয় : দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনা।
রাজবংশী : রংপুর।
পূর্ববঙ্গীয় : ক. ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালি।
খ. ফরিদপুর, যশোহর, খুলনা।
গ. সিলেট।
দক্ষিণবঙ্গীয়: চট্টগ্রাম, নোয়াখালি।
আধুনিক শিষ্ট বা কথ্য বাংলার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ঐ সব উপভাষার নিম্নরূপ সাধারণ ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য গ্রিয়ার্সন অনুসরণে মুনীর চৌধুরী নির্দেশ করেছেন। ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: তাড়নজাত মূর্ধন্য ব্যঞ্জন ‘ড়’ স্থানে দন্ত্য ‘র’, যথা বড় > বর। তাড়নজাত দন্ত্য ‘র’ স্থানে পার্শ্বিক ‘ল’ যেমন, শরীরে > শরীলে। রাজশাহী অঞ্চলে বিশেষত চাপাইনওয়াবগঞ্জ এলাকায় উষ্ম তালব্য ‘শ’ও উষ্ম দন্ত্য ‘স’ ধ্বনির মধ্যে বিভ্রান্তি। স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে সম্মুখ প্রসৃত উচ্চমধ্য ‘এ’ এবং নিম্নমধ্য ‘এ্যা’ ধ্বনি, পশ্চাৎ গোলাকৃতি নিম্নমধ্য ‘অ’ এবং উচ্চমধ্য ‘ও’ ধ্বনির মধ্যে বিভ্রান্তি। রাজবংশী বা রংপুরের উপভাষায় অঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ব্যঞ্জন ‘ছ’ এবং উষ্ম দন্ত্য ‘স’, ঘোষ স্বল্পপ্রাণ তালব্য ‘জ’ এবং উষ্ম দন্ত্য ‘য’ নাসিক্য দন্ত্য ‘ন’ এবং পার্শ্বিক ‘ল’, ঘোষ অল্পপ্রাণ দন্ত্য ‘দ’ এবং ঘোষ মহাপ্রাণ দন্ত্য ‘ধ’ ধ্বনির মধ্যে ব্যতিক্রম পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গীয়তে স্পৃষ্ট তালব্য ব্যঞ্জন ‘চ’ ‘ছ’ ‘জ’ ‘ঝ’ এর পরিবর্তে ঘৃষ্ট বা উষ্ম ‘ছ’ এবং ‘য’ ধ্বনি পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গীয়তে কোনো কোনো অঞ্চলে একটি স্বরতস্ত্রীয় স্পৃষ্ট ধ্বনি পাওয়া যায়। সিলেটীতে স্পৃষ্ট কণ্ঠ ‘ক’ এবং স্পৃষ্ঠ্য ‘ফ’ ধ্বনির ঘর্ষণজাত রূপ পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গীয়তে অঘোষ স্বল্পপ্রাণ ‘ক’ এবং মহাপ্রাণ ‘খ’ মধ্য অবস্থানে উষ্ম কণ্ঠ ‘হ’ ধ্বনিতে পরিণত হয়, আদি অবস্থানে ‘হ’ ধ্বনি ঊহ্য থাকে। দক্ষিণ বঙ্গীয়তে স্পৃষ্ট কণ্ঠ ‘ক’ ধ্বনি উষ্মতা প্রাপ্ত হয়। পূর্ববঙ্গীয়তে বর্গের চতুর্থ ধ্বনি ঘোষ মহাপ্রাণ ‘ঘ’, ‘ঝ’, ‘ঢ’, ‘ধ’, ‘ভ’ যথাক্রমে স্বল্পপ্রাণ ‘গ’ উষ্ম ‘য’, স্বল্পপ্রাণ ‘ড’ ও ‘দ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়।
মুনীর চৌধুরী গ্রিয়ার্সন অনুসরণে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষার নিম্নরূপ রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন: উত্তরবঙ্গীয়তে কর্তার বহুবচনে তে বিভক্তি, যেমন- ছাওতে। কর্মে ‘দেক’, যেমন- চাকরদেক; গৌণকর্মে ‘গুণে’ যেমন- আমাকগুয়ে, বাপাকগুণে। অপাদানে ‘ত’, যেমন- কষ্টেত, দেশত। ক্রিয়াপদে অসমাপিতা ‘এ্যা’, যেমন- কর‌্যা, হয়্যা। উত্তমপুরুষে ভবিষ্যৎকালে ‘ইম’ ‘আম’, যেমন- বলিম, করিম।
রাজবংশীতে কর্তায় বহুবচনে ‘গুলা’, ‘গিলা’, যেমন- বালকগুলা। সম্বন্ধের বহুবচনে ‘ঘর’- চাকরেরঘর। কর্মকারকে ‘ক’ এবং সম্বন্ধে ‘কার- বালককার। অপাদানে ‘অত’, ‘ওত’- বালকত্। ক্রিয়াপদের রূপ, প্রথম পুরুষ বর্তমান ও পুরাঘটিত ‘ও’, যথা- মুই আছোঁ। অতীতে ‘নু’, আছিনু। ভবিষ্যতে ‘ম’, ‘মু’, ‘মো’, যথা- থাকিমু, থাকিম, থাকমো, থাকম। দ্বিতীয় পুরুষের অতীতে ‘লু’ ‘ল্লু’ ভবিষ্যতে ‘বু’, যেমন- তুই কাইল্লু, তুই করবু। পূর্ববঙ্গীয়তে- কর্মে ‘এরে’, বাপেরে। সম্বন্ধের বহুবচনে ‘গো’ ছাকরগো, তাগো। কর্মের বহুবচনে ‘রারে’, আমরারে, তোমরারে। অপাদানে ‘অ’, ‘ত’,- দিল, গলত।
ক্রিয়াপদের রূপ, প্রথম পুরুষ ভবিষ্যৎ- ‘মু’, কমু। ময়মনসিংহে ‘রাম’- করবাম। তৃতীয় পুরুষ অতীতে ‘ল’। অসমাপিকাকে ‘আ’, ‘ইয়া’- করিয়া, কইরা। কুমিল্লায় দ্বিত্ব বইল্লা, উইঠ্ঠা। কুমিল্লায় অনির্দেশক ‘তো’ ‘তাম’-করতো, কইতাম। ময়মনসিংহে ‘অত’, ‘বার’- বারত, আইগাইবার। সন্দ্বীপে ‘অন’- করন। সিলেটীতে সম্বন্ধের একবচনে। ‘অর’- গরর। আপাদানে ‘ত’, ‘ও’,-গরত, গরো। কর্তায় বহুবচনে ‘আইন’- গরাইন, ‘টাইন’, গরটাইন। অতীতে মধ্যমপুরুষে ‘লাই’- দেখলাই। তৃতীয়াতে ‘লা’- দেখলা। ভূতার্থ অনির্দেশকে ‘তাম’, ‘তায়’, ‘তা’, ‘তাইন’- খাইতাম, খাইতায়, খাইতা, খাইতাইন। ঘটমান বর্তমানে উত্তমপুরুষে ‘ত্রাম’, ‘ইয়ার’, ‘রাম’- যাইত্রাম, যাইয়ার, যাইরাম। দ্বিতীয় পুরুষে ‘ত্রায়’, ‘ত্রে’,- যাইত্রায়। নির্দেশাত্মক ‘উইন’, ‘উকা’, ‘উক্কা’। অনির্দেশক- ‘তায়’, ‘তে’, যেমন- তুই যাইতায় ছাও, হে যাইতো ছায় তাইন যাইতা ছাইন ইত্যাদি।
দক্ষিণ পূর্ববঙ্গীয় চট্টগ্রামীতে কর্তায় ‘এ’, অপাদানের ‘তুন’, সম্বন্ধে ‘অর’, অপাদানে ‘অত’, বহুবচনে ‘গুণ’ ‘উণ’, যথা- কুঁউরগুণ; বর্তমানকালে প্রথম পুরুষে ‘ব’, তৃতীয় পুরুষে ‘তান’। অতীতকালে প্রথম পুরুষে ‘(গ ইয়ম’, গে’, যথা- করগিয়ম, করিয়াম, করগি, অথবা করজিয়ম ইত্যাদি। দ্বিতীয় পুরুষে ‘(গ) ইয়’, ‘লা’; তৃতীয় পুরুষে ‘(গ০ ইয়’; ভবিষ্যত কালে ‘(গ) ইউম’, ‘বঅ’, ‘যাম; দ্বিতীয় পুরুষে ‘বে’, অনুজ্ঞা- ‘অ’ না বাচক ‘ইঅ’ যেমন- নকরিঅ। সম্মানবাচক- করওক। অসমাপিকা ‘ইয়ারে’, যথা- গরিয়ারে।
বাংলাদেশের উপভাষাসমূহে রূপতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য অধিক এবং তা নিম্নোক্ত তিনটি ক্ষেত্রে সর্বাধিক,- সর্বনাম, কারক বিভক্তি, ক্রিয়া বিভক্তি। যেমন- সর্বনামে ‘আমি’র উপভাষা রূপ উত্তরবঙ্গে ‘মুই’, নোয়াখালিতে ‘আই’। ‘আমার’, উত্তরবঙ্গে ‘মোর’, নোয়াখালিতে ‘আর’। ‘আমাদের উত্তরবঙ্গে ‘হামার’, ময়মনসিংহে ‘আমরার’, কুমিল্লায় ‘আমাগো’, বরিশালে ‘মোগো’, দক্ষিণবঙ্গে ‘আমরা’ ইত্যাদি।
কারক বিভক্তিতে ‘চাকরদের’, উত্তরবঙ্গে ‘চাকরদেরকে’, পূর্ববঙ্গীয়তে ‘ছাঅরগো’, দক্ষিণবঙ্গে ‘ছঅরগুণ’। ‘গলায়’, পূর্ববঙ্গে ‘গলাত’।
ক্রিয়া বিভক্তিতে ‘বলব’, উত্তরবঙ্গে ‘বলিম’, পূর্ববঙ্গে ‘কমু’, দক্ষিণবঙ্গে ‘খইয়ুম’ ইত্যাদি। ‘‘ গঁহরবৎ ঈযড়ফিযঁৎু, ওহঃবৎসধঃরড়হধষ ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ অসবৎরপধহ খরহমঁরংঃরপং. ঔঁষু, ১৯৬০ চ. ৬৪-৭৮.’’
গ্রিয়ার্সনের উপাদান বাংলাদেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক নয়, যেমন- ঢাকা জেলা থেকে কেবল মানিকগঞ্জের নমুনা সংগৃহীত হয়েছিলো, ঢাকা শহরে প্রচলিত উপভাষার নমুনা সেখানে নেই। ফলে গ্রিয়ার্সনের জরিপে আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপভাষার সীমানা নির্ণয় ও ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ণাঙ্গ নয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও বাংলা ভাষার উপভাষা বৈচিত্র্য পূর্ণাঙ্গভাবে নির্ণয় করেননি তবে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাসে ঐ প্রসঙ্গে তিনি কিছু মূল্যবান মতামত রেখেছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত সংক্ষেপে নিম্নরূপ, বাংলা উপভাষাগুলি একটিমাত্র প্রত্মভাষার বিবর্তিত রূপ নয়, বাংলার উপভাষাগুলি সাধুভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চলের নিজস্ব কোনো উপভাষা নেই, বিভিন্ন উপভাষার পারস্পরিক প্রভাবে এ
অঞ্চলের বাংলা ভাষা গড়ে উঠেছে। বাংলা উপভাষাগুলির যে চার প্রধান ভাগ- রাঢ়, বরেন্দ্র বা পু-ু, বঙ্গ এবং কামরূপ তার মধ্যে পূর্ব প্রত্যন্ত বঙ্গে অর্থাৎ সিলেট, ত্রিপুরা, নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামের উপভাষাগুলিতে এমন সব ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আছে যা বাংলা ভাষার অন্য কোনো উপভাষায় নেই। পূর্ব প্রত্যন্ত বঙ্গের উপভাষার এই বৈশিষ্ট্যের কারণ ঐ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিহিত। উপভাষাগুলির ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ছাড়া আভিধানিক ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, অপনিহিত ‘ই’ ধ্বনি রাঢ় বা অন্যান্য অঞ্চলের উপভাষা অপেক্ষা বঙ্গ ও বরেন্দ্র উপভাষায় অধিকতর রক্ষিত, এই দুটি উপভাষার স্বরধ্বনি-ব্যবস্থা অধিকতর লক্ষণশীল, মধ্যযুগের বাংলা ভাষার লক্ষণ ‘বঙ্গ উপভাষাগুলি’তে সবচেয়ে বেশি অটুট রয়েছে। স্বরমধ্যবর্তী মহাপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণহীনতার ফলে বঙ্গ উপভাষাগুলিতে নতুন বৈশিষ্ট্যের আগম ঘটেছে। পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব বাংলার উপভাষাগুলিতে আদ্য ও মধ্য অবস্থানে স্পৃষ্ট ব্যঞ্জনের ব্যাপক উষ্মীভবন একটি বিশিষ্ট লক্ষণ এবং এই বৈশিষ্ট্য এই উপভাষাসমূহকে বাংলার অন্যান্য উপভাষা থেকে পৃথক করেছে। ‘‘ঝঁহরঃর কঁসধৎ ঈযধঃঃবৎলর, ঞযব ঙৎরমরহ ধহফ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ইবহমধষর খধহমঁধমব. ঠড়ষ. ১, খড়হফড়হ. এবড়ৎমব অষষবহ ্ টহরিহ খঃফ. ১৯৭০, চ. ১৩৭-১৪৭. ’’
বাংলাদেশে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রণয়ন ও প্রকাশের কৃতিত্ব বাংলা একাডেমীর, এ অভিধানের প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। অভিধানটি বস্তবপক্ষে আঞ্চলিক শব্দের। প্রথমে ছিয়ানব্বই জন সংগ্রাহক প্রায় একুশ হাজার শব্দ সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন, পরে আবার চারশত তিপ্পান্ন জন সংগ্রাহক একলক্ষ ছেষট্টি হাজার দুইশত ছেচল্লিশটি আঞ্চলিক শব্দ প্রেরণ করেন। সংগ্রাহকের অর্ধাংশ ছিলেন অধ্যাপক ও শিক্ষক, এক চতুর্থাংশ ছাত্র, আর এক-চতুর্থাংশ বিভিন্ন কর্মজীবী। বাংলাদেশের সব জেলা থেকেই আঞ্চলিক শব্দ সংগৃহীত হলেও, ঢাকা শহরে অবস্থানকারী সংগ্রাহকেরাই ছিলেন সংখ্যাধিক্য, যদিও তাঁরা বিভিন্ন জেলার শব্দ সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন। ঢাকা শহরের বাইরে কোনো কোনো জেলার সংগ্রাহকের সংখ্যা তিন-চারজনের বেশি নয়। অধিকাংশ সদস্যই ধ্বনিতত্ত্ব জ্ঞান বা প্রশিক্ষণহীন ফলে শব্দের যথাযথ উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করার বা ধ্বনিবৈশিষ্ট্য রক্ষার ক্ষমতাবিহীন কাজেই বিভিন্ন অঞ্চলের ধ্বনিবৈশিষ্ট্য সংগৃহীত শব্দাবলীর মধ্যে রক্ষিত হয়নি। ঐসব কারণে সংগৃহীত শব্দের মধ্যে পঁচাত্তর হাজারের বেশি শব্দ রাখা যায়নি। আলোচ্য অভিধানটির ভূমিকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষার শ্রেণিবিন্যাস বা বিভিন্ন উপভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় নেই, সংগৃহীত শব্দাবলীর ভিত্তিতে কোনো ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এ অভিধানের ভূমিকাতে গ্রিয়ার্সন কৃত বাংলা উপভাষার প্রাচ্য বিভাগের পূর্বদেশী ও দক্ষিণ-পূর্ব শাখার নিম্নোক্ত তালিকাটি উদ্ধৃত করেছেন :
১.    পুর্বদেশী- ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বাখরগঞ্জ, দক্ষিণ-পূর্ব ফরিদপুর, সিলেট
ক. ইহার একটি প্রশাখা পূর্বকেন্দ্রিক- যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, (দক্ষিণ-পূর্বাংশ ব্যতীত)
খ. আর একটি প্রশাখা- হাজং (ময়মনসিংহ জেলা)।
২.    দক্ষিণ-পূর্ব- নোয়াখালি, চট্টগ্রাম।
ক.    ইহার একটি প্রশাখা চাকমা। ‘‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, (প্রধান সম্পাদক), পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা, বাঙলা একাডেমী, ১৯৬৫।’’ গ্রিয়ার্সনের উপভাষা বিভাগ সম্পর্কে ভূমিকায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মন্তব্য: ‘গ্রিয়ার্সন সাহেব এই সমস্তউপভাষা বিভাগ, শাখা ও প্রশাখার বিশিষ্ট লক্ষণগুলি বিস্তৃত রূপে প্রদর্শন করেন নাই; কিন্তু ইহার প্রয়োজন আছে। ‘‘ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, (প্রধান সম্পাদক), পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা, বাঙলা একাডেমী, ১৯৬৫।’’ অবশ্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও ঐ প্রয়োজন মেটাননি, তিনি নিম্নরূপ মন্তব্য সহ অতি সংক্ষেপে গ্রিয়ার্সন সাহেবের মতামতই উদ্ধৃত করেছেন, আমি গ্রিয়ার্সন সাহেবের শ্রেণিবিভাগ আপাতত স্বীকার করিয়া লইয়া … এই সমস্ত শ্রেণীর বিশিষ্ট লক্ষণগুলি তাঁহার মতানুযায়ী নিম্নে প্রদান করিতেছি। …
ক. পূর্বদেশী শাখা। ধ্বনিতত্ত্ব। প্রাচ্য বিভাগের সাধারণ ধ্বনিতত্ত্ব, চ বর্গের দন্ত্য-তালব্য উচ্চারণ, শ, ষ, স, স্থানে (যুক্ত বর্ণ ব্যতীত) হ উচ্চারণ মূল হ কারের লোপ। মহাপ্রাণ ঘোষ বর্ণের মহাপ্রাণতা লোপ এবং ড়, ঢ় স্থানে র।
রূপতত্ত্ব। প্রাচ্য বিভাগের সাধারণ লক্ষণ রক্ষিত।
ক.    পূর্ব কেন্দ্রীক প্রশাখা। গ্রিয়ার্সন সাহেব যশোর, খুলনা, ফরিদপুরের (দক্ষিণ-পূর্বাংশ ব্যতীত) কথ্য ভাষাকে পূর্বদেশী শাখার একটি প্রশাখা রূপে নির্দেশ করিয়াছেন; কিন্তু ধ্বনিতত্ত্বে একমাত্র ছ স্থানে ঝ এবং ঔ স্থানে ত উচ্চারণ ভিন্ন এবং রূপতত্ত্বে কর্মকারকের একবচনের বিভক্তি ‘রে’ এবং সকর্মক ক্রিয়ার অতীতকালে প্রথম পুরুষে ‘ল’ ভিন্ন ইহা বহু বিষয়ে পাশ্চাত্য বিভাগের বিশিষ্ট ধ্বনি ও রূপতত্ত্বের সহিত অভিন্ন। এইজন্য ইহাকে পাশ্চাত্য বিভাগের পূর্বশাখা রূপে গ্রহণ করা কর্তব্য। ইহার একটি বিশেষত্ব যেতে খেতে ইত্যাদি তুমর্থ ক্রিয়া বিভক্তির ‘তে’ স্থানে ‘তি’ যথা- করতি, খাতি, অধিকরণে ই কার উ কারের পরস্থিত এ কার স্থানে ই কার (যথা- পিঠি, গুড়ি, চুলি) এবং সম্বন্ধের এর স্থানে ‘ইর’ (যথা- পিঠির, গুড়ির, চুলির)।
খ.    দক্ষিণ-পূর্ব শাখা। নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামের উপভাষার মধ্যে মাত্র ‘প’ স্থানে ‘ভূ এবং প্রথম পুরুষের সর্বনামের স্ত্রীলিঙ্গের রূপ (নোয়াখালিতে হেতি; চট্টগ্রামে তেই, তাই হিতি) ভিন্ন আর কোনও সাধারণ লক্ষণ নাই। … নোয়াখালিকে পূর্বদেশী শাখার এলাকাধীন করা যাইতে পারে। ইহার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে ড় ধ্বনি রক্ষিত আছে। …আমরা কেবল চট্টগ্রামের উপভাষাকে এই দক্ষিণ-পূর্ব শাখাভুক্ত মনে করি। … চট্টগ্রামী উপভাষার ধ্বনিতত্ত্ব এই যে,
ক.    ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি রক্ষিত আছে, যেমন- ঘর, ঝর, (ঝড়), ধান, ভাত ইত্যাদি।
খ.    ইহার আদি হ রক্ষিত আছে, যেমন- হাত, হাতী ইত্যাদি।
গ.    পদমধ্যবর্তী ম অনুনাসিক হয়, যথা- আঁই (আমি), আঁর (আমার) তুঁই (তুমি), কুঁআর (কুমার), ছঁই (ছিম), হঁউক (শামুক) ইত্যাদি।
ঘ.    পদমধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায়ই লোপ বা বিকৃত হয় যথা- তঅন (তখন), ডাই (ডাকিয়া), খুই (খুলিয়া) ইত্যাদি। রূপতত্ত্বে ইহাতে সর্বনামের প্রথম পুরুষের স্ত্রীলিঙ্গে তেই, তাই, হিতি আছে এবং নিষেধার্থক অব্যয় ‘ন’ ক্রিয়ার পূর্বে বসে, যথা- ন যাই, ন আসিল (ছিল না)। ‘‘ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (প্রধান সম্পাদক), পুর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা, বাঙলা একাডেমী, ১৯৬৫।’’
গ্রিয়ার্সন অবলম্বনে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন ছাড়া শহীদুল্লাহ্ বাংলাদেশের কয়েকটি উপভাষার কিছু ধ্বনি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তার মতামত দিয়েছেন। সিলেট এবং চট্টগ্রামের ‘ক’ ধ্বনির আরবি ‘খে’ ধ্বনির এবং ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলায় ‘জ’ ধ্বনির আরবি ‘যে’ ধ্বনির অনুরূপ উচ্চারণ সম্পর্কিত কোনো কোনো মহলের ধারণার খন্ডন করে তিনি লিখেছেন,
প্রথমত : এইরূপ বিকৃত উচ্চারণ হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ নির্বিশেষে স্থানীয় সকল অধিবাসীর মধ্যে দেখা যায় :
দ্বিতীয়ত : আরবি ভাষার যখন ‘কাফ’ এবং ‘খে’, ‘জীম’ এবং ‘যে’ দুই ধ্বনিই সমভাবে আছে, তখন কেবল এই ‘খে’ এবং ‘যে’ উচ্চারণের জন্য আরবি প্রভাব স্বীকার করা যায় না। … বহুস্থানে যে শ ষ স স্থানে হ কার উচ্চারণ হয়, তাহা অবশ্য পারসী প্রভাবের ফল নয়। ‘‘ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (প্রধান সম্পাদক), পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা, বাঙলা একাডেমী, ১৯৬৫।’’
‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধানের’ ভূমিকায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষায় রক্ষিত ভাষার কিছু প্রাচীন লক্ষণের উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন বাংলার একবচনের ‘মই’ সর্বনামটির রূপান্তর ‘মুই’ আধুনিক শিষ্ট বাংলায় অসাধু বলে পরিত্যক্ত; কিন্তু কোনো কোনো উপভাষায় তা রক্ষিত, যেমন- পূর্ব সিলেটীতে ‘মুই মারো’, দিনাজপুরে ‘মুইমাঁর’, ‘হামরা মারি’। সাধু বাংলা ভিন্ন উপমহাদেশের সমস্ত আর্য ভাষায় নিষেধাত্মক অব্যয় ক্রিয়ার পূর্বে বসে, এই বৈশিষ্ট্য প্রাচীন ও আদি মধ্য বাংলাতেও রক্ষিত, চট্টগ্রামের উপভাষায় এই বৈশিষ্ট্য রক্ষিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষার আরো যে বৈশিষ্ট্যের কথা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উল্লেখ করেছেন তা হলো আসামী ভাষার সঙ্গে তার সাদৃশ্য। যেমন- সর্বনামের প্রথম পুরুষের স্ত্রীলিঙ্গ সিলেটীতে ‘তাই’, চট্টগ্রামীতে ‘তেই’, ‘তাই’, ‘হিতি’, ঢাকায় ‘হাতাই’, নোয়াখালিতে ‘হেতি’। আসামী ভাষায় ‘তাই’ রূপ আছে। আসামী ভাষা ও চট্টগ্রামী উপভাষার ধ্বনি ও রূপতত্ত্বে ঐক্যের উদাহরণ, ধ্বনিতত্ত্বে ঘোষ মহাপ্রাণ ‘ঘ’ ‘ধ’ ‘ভ’ এবং আদি অবস্থানে ‘হ’ ধ্বনির উপস্থিতি। রূপতত্ত্বে-সম্বন্ধের একবচনে র্‘’, যেমন- হার্ত, ঘর্র। অধিকরণের একবচনে ‘ত্’ বিভক্তি যথা- বারিত্, ঘরত॥ সর্বনামের প্রথম পুরুষের স্ত্রীলিঙ্গে আসামীতে ‘তাই’, চট্টগ্রামীতে ‘তাই’, ‘তেই’, ‘হিতি’। পদক্রমে নিষেধার্থক অব্যয় ‘ন’ এর ক্রিয়ার পূর্বে ব্যবহার, যথা- ন গেল, ন আছিল্ ইত্যাদি। এই সাদৃশ্য সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন,
এই সাদৃশ্যের কারণ কি? উত্তরবঙ্গের ভাষার সহিতও আসামী ভাষার সাদৃশ্য আছে, যেমন- ধ্বনিতত্ত্বে ঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ ও আদি হ কার রক্ষিত এবং রূপতত্ত্বে কর্মকারকে ‘ক’, অধিকরণে ‘ত’ বিভক্তি এবং সকর্মক ক্রিয়া অতীতকালের প্রথম পুরুষে ‘লে’ যথা দিলে। পদক্রমে উত্তর বঙ্গের কোনও কোনও উপভাষায় ক্রিয়ার পূর্বে ‘ন’ বসে। হইতে পারে প্রাচীন বাংলা ভাষার একটি স্রোত উত্তরবঙ্গ হইতে পূর্ব অভিমুখে আসামে প্রবেশ করে। পরে সেই স্রো আসাম হইতে দক্ষিণ অভিমুখে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এককালে বাংলাদেশের এই পূর্ব প্রান্তের ভাষা বোধ হয় আসামীর সহিত একরূপ ছিল; কিন্তু পূর্ব বঙ্গের উপভাষার প্রভাবে তাহার বৈশিষ্ট্য লোপ হইয়া পূর্ববঙ্গের উপভাষা গোষ্ঠীর শামিল হইয়াছে। সিলহেটী উপভাষায় এবং ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে ‘তাই’ শব্দ তাহার প্রাচীনত্ব রক্ষা করিয়াছে। ‘‘ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ (প্রধান সম্পাদক), পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা, বাঙলা একডেমী, ১৯৬৫।’’
বাংলাদেশের উপভাষা নিয়ে আরো কাজ করেছেন,- গোপাল হালদার নোয়াখালি, পূর্ববঙ্গ এবং চট্টগ্রামের; ড. মুহম্মদ এনামুল হক চট্টগ্রামের; কৃষ্ণপদ গোস্বামী ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং উত্তর-পূর্ব বাংলার, শম্ভুনাথ চৌধুরী রংপুর ও উত্তর বাংলার; সুধীর করণ দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার; শিব প্রসন্ন লাহিড়ী সিলেটীর, মুহম্মদ আবদুল হাই ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের; মুনীর চৌধুরী পূর্ববঙ্গের; অমলেশ চন্দ্র সেন পূর্ববঙ্গীয়; অনিমেষ কান্তি পাল ঢাকার; জ্যাক এ ড্যাব্স পূর্ব বাংলার, নারিহিকো উসিদা চট্টগ্রামের; নীলমাধব সেন বাংলাদেশের কয়েকটি উপভাষার এবং মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির সন্দ্বীপ উপভাষার। উল্লিখিশত আলোচনাগুলোর মধ্যে হুমায়ুন কবিরের সন্দ্বীপ উপভাষার সামাজিক-ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছাড়া সবগুলোই বাংলাদেশে বাংলাভাষার আঞ্চলিক রূপ বৈচিত্র্যের বিশ্লেষণ, দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে ভৌগোলিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আংশিকভাবে হলেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের প্রয়াস রয়েছে। বাংলাদেশের উপভাষা বিশ্লেষণ প্রধানত ভৌগোলিলক এবং প্রচলিত ব্যাকরণের পদ্ধতিতে করা হয়েছে। এ কথা বলা যায় না যে আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের উপভাষাসমূহ সনাক্তকরণ বা বিভিন্ন উপভাষার পূর্ণাঙ্গ ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হয়েছে। আজ অবধি বাংলাদেশের একটি উপভাষা মানচিত্র প্রণীত হয়নি, ইতোমধ্যে বাইরের পৃথিবীতে উপভাষাতত্ত্ব আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি অতিক্রম করে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও ভাষার নৈচিত্র্য অনুসন্ধান কেবলমাত্র ভাষাতাত্ত্বিলক ভূ-গোলের মধ্যে সীমিত না রেখে সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়া উচিত। আর উপভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাকরণও সাংগঠনিক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটিভ পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট। (সমাপ্ত)