বিএনপিকে দমনের অবিচল অবস্থানে সরর্কা ॥ আল্লাহ খালেদা জিয়াকে সুমতি দিক-প্রধানমন্ত্রী

37

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপিকে ছাড় দেবে না সরকার। ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জিরো টলারেন্স ও বিএনপিকে দমন করার অবিচল অবস্থানে থেকেই এই সরকার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তির ইতিহাস তৈরি করতে চাইছে। এই জন্য যতো কঠোর হওয়া দরকার তা হবে। ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত নীতিনির্ধারক মন্ত্রীদেরও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দল ও সরকারের পক্ষে সবাইকে আশ্বস্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা কাজও করছেন।
ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে কোনো ভুল করেছেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে এটা মনে করেন না। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী তার করা নির্বাচন বৈধ আর ওই নির্বাচন করেই যে সরকার গঠন করেছেন সেই সরকারও শতভাগ বৈধ বলেই মনে করেন। এই কারণেই তিনি বিএনপি ও সব আন্তর্জাতিক মহলের চাপকে উপেক্ষা করছেন। কোনো চাপের কাছে তিনি ২০১৩ সালে নতি স্বীকার করেননি আর করবেনও না। ২০১৩ সালে বিএনপির সাথে সমঝোতা করার ব্যাপারে চাপ ছিল ভিন্ন। আন্তর্জাতিক মহল বলেছিল বিএনপিকে নিয়ে ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে। এ জন্য সরকারও চিন্তা করেছিল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নয় বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন করতে হবে। সেই জন্য শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। দাওয়াত দিয়েছিলেন। বিদেশিদের সাথে আলোচনা করতেও তার নেতাদের অনুমতি দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতাদের সাথেও আলোচনা করার অনুমতি দেন। বিএনপি কি চায় সেটাও লিখিত নেন। কিন্তু বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার একগুঁয়েমির কারণে ওই সময়ে সমঝোতা হয়নি। খালেদা জিয়া সমঝোতার কথা বললেও পূর্ব শর্ত দিয়েছিলেন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেই কেবল আলোচনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান ছিল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ঘোষণা করতেই হয় তাহলে তো আলোচনার প্রয়োজন থাকে না। সরকারের অবস্থান ছিল অনির্বাচিত কারো হাতে ক্ষমতা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বর্তমান সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই সংবিধান বহির্ভূত কোনো অবস্থানে যাবেন না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় সফল হন। সব বাধা উপক্ষো করে ওই সময়ের ভারত নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক মত দেয় এবং নির্বাচন যথা সময়ে করার তাগিদ দেয়। সেই সময় সরকার নির্বাচনও করে ফেলে। কিন্তু এখন আর সরকারের উপর সেই ধরনের চাপ নেই। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার পর ২০১৩ সালে যে অবস্থা হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল এখন তা নেই। বিএনপি ২০১৪ সালে তেমন কোনো চাপ তৈরি করতে না পারায় ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে যে চাপ তৈরির চেষ্টা করছে সরকার সেটা নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ গত ৩৪ দিনের আন্দোলনে বিএনপি বর্তমান সরকারের উপর বিশেষ কোনো চাপ তৈরি করতে পারছে না। অবস্থাও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমন ধরনের কোনো অবস্থা না হওয়ার কারণে সরকার ধরেই নিয়েছে বিএনপি এখন আর কিছুই করতে পারবে না। যতোই আন্দোলন করুক না কেন আর সমঝোতা করবেন না। কারণ হিসেবে সরকার মনে করছে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট এখন যা করছে তা সম্পূর্ণ অর্থেই সন্ত্রাস-নৈরাজ্য এবং মানুষ হত্যা। আর এই অবস্থায় আলোচনা বা সংলাপের উদ্যোগ নিলে তা হবে হত্যা-নৈরাজ্যের কাছে নতি স্বীকার করা। যা করলে ভবিষ্যতে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য এবং হত্যাযজ্ঞই প্রতিষ্ঠিত হবেÑ যা কোনো অবস্থাতেই কোনো সুস্থ সমাজে হতে পারে না এবং যা হবে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করে আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে ফিরে যাওয়া। কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না।
আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক গতকাল বলেন, এখনো আমি নিশ্চিত করেই বলতে চাই, বিএনপি যতো আন্দোলন করুক একদিনের জন্য সরকার এখন আর বিএনপির সাথে কোনো সংলাপ ও সমঝোতা করবে না। বিএনপিকে সংলাপ ও সমঝোতা সত্যিকার অর্থে চাইলে নমনীয় হতে হবে। সন্ত্রাস নৈরাজ্যের কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে। সংলাপের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে। সমঝোতা হতে পারে ২০১৯ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে। তবে সেটা অবশ্যই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনেই করতে হবে। সেটা তাদের মেনে নেয়ারও মানসিকতা থাকতে হবে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না। আর সংবিধানের এই বিধানেও কোনো পরিবর্তন তিনি আনবেন না। যদি তারা এটা মেনে না নেয় এখনই সরকারের পতন চায় তাহলে বিএনপিকে মনে রাখতে হবে তাদের আন্দোলন ২০১৩ সালের মতোই ফলশূন্য হবে। আর শূন্য হাতেই খালেদা জিয়াকে অফিস থেকে বাসায় যেতে হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, আমরাও দেখতে চাই খালেদা জিয়ার জেদের দৌরাত্ম্য কতোখানি। আর কি করতে পারেন তিনি । তাকে মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী যা করছেন তা কোনোটিই অসাংবিধানিক নয়। তিনি বলেন, বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করছে। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ সবার কাছেই দেশের ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যে তথ্য দিচ্ছে। আর এতে করে তারাও ওই তথ্যের ভিত্তিতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। সরকারকে বিএনপির সাথে সমঝোতা করতে বলছে। এটা আসলে তারা বলে কি করবে। এইভাবে কি বিদেশিদের দিয়ে তারা সরকারের পতন ঘটাতে পারবে। বাংলাদেশ স্বাধীন। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে আমরাই সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবো। বিদেশিদের দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে দিয়ে সংলাপে ও সমঝোতায় বসানোর চেষ্টা সফল হবে না। তিনি বলেন, বিদেশিরা কি বলতে চান সেটা শুনতে সমস্যা নেই। তাদের কথা শুনে আমাদের কথাও তাদের বলতে হবে। না বললে তারা বিএনপির ভুল তথ্যগুলো বিশ্বাস করবে। কিন্তু কেউ দেশের ইমেজ নষ্ট করবে সরকার হিসেবে আমরা সেটা সহ্য করবো না। এই কারণেই তাদের আমরা প্রকৃত অবস্থা জানানোর চেষ্টা করছি। তাদেরও মনে রাখতে হবে একটি দেশের সংবিধানই বড়। সেখানে অসাংবিধানিক কোনো কিছু করানোর চেষ্টা কিংবা সরকারকে চাপ দেয়া তাদের সমুচিত হবে না। তারা যে এই দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, সেটাতো তারা পারেন না।
গতকাল রবিবার ধর্ম মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বলেছেন, ধ্বংস করা, পুড়িয়ে ফেলা, লাশ ফেলা ছাড়া আর কোনো অর্জন তাদের নেই। এটা করে যদি মনে করেন বিরাট কিছু করে ফেলেছেনÑ তাহলে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের। কারণ এরা দেশের নেতৃত্ব দেবে। এরা ক্ষমতায় ছিল। আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সে ক্ষমতা মানুষের লাশের ওপর দিয়ে কেন? সেটাই আমার প্রশ্ন। তিনি বলেন, ক্ষমতায় যেতে হলে গণতান্ত্রিক উপায়েই যেতে হবে। দশম সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খালেদা জিয়া, নির্বাচনে যায়নি। এর খেসারত জাতি কেন দেবে? মানুষ পুড়িয়ে মেরে সেই লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় যাবেন? এটা কোন ধরনের বিবেচনা? কী ধরনের কাজÑ আমি জানি না। আল্লাহ তাদের সুমতি দিক। শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নেত্রী বোধহয় উন্মাদ। নইলে বাড়িঘর ছেড়ে অফিসে থেকে কোনো বিপ্লব ঘটাচ্ছেনÑ আমার কাছে তা বোধগম্য নয়। এতে উনি কি পাবেন আমি জানি না। আল্লাহ এদের সুমতি দিকÑ মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ করুক, ছেলেমেয়েরা যাতে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারে। সব কিছু একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে এসেছি সেই সময় এই হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা। অবরোধের মধ্যে আবার হরতাল, অর্থাৎ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে এসব করে যাচ্ছে। জানি না বিএনপি নেত্রীর কি উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, মানুষ লেখাপড়া শিখুক, মানুষ হয়ে উঠুক, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোকÑ তা তিনি চান না। জামায়াত-শিবিরও আবার হরতাল ডাকে। লেখাপড়া শিখলে তো বিভ্রান্ত করতে পারবে না। তাই তারা দেশের মানুষকে লেখাপড়া শিখতে দিতে চায় না। এটাই বোধ হয় তাদের উদ্দেশ্য। শুক্রবার-শনিবার আবার হরতাল দেয় কিনাÑ এদের বিশ্বাস নেই। এরা তো ধর্মের নামে ব্যবসা করে। দেখা গেলো শুক্রবারও হরতাল দিয়ে দিলো। মানুষ মারার এ আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত জোটের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, দিনের পর দিন মানুষ পুড়িয়ে মেরে তাদের অর্জনটা কি? এতোগুলো মানুষকে পঙ্গু করে, হাজার হাজার গাড়ি পুড়িয়ে তারা তো জনগণের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, খালেদা জিয়া মনে করেছেন তিনি জেদ করে তার অফিসে বসে আন্দোলন কর্মসূচি দিনের পর দিন চালিয়ে যাবেন আর সেটা সবাই মেনে নেবে। তিনি দেশের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটার সুযোগ দিচ্ছেন। এতে করে তিনি ইচ্ছে করেই দেশের ক্ষতি করে চলেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই এটা মেনে নেয়া হবে না।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন মন্ত্রী গতকাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার প্রতি তার ছেলের মৃত্যুর পর সহানুভূতি জানাতে গেছেন। কিন্তু তার সহানভূতি তিনি নেননি। আর তাকে অফিসের বাইরে থেকে বিদায় দিয়েছেন। এতে ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি এই অপমানও সহ্য করতে পারছেন না। একজন প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করার ধৃষ্টতাও খালেদা জিয়া দেখিয়েছেন। কিন্তু এটা মেনে নেয়া যায় না। ওই মন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া মনে করছেন বিদেশিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করলে আর দেশের বিরুদ্ধে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বললেই তারা চাপ তৈরি করবে। আর সেই চাপের কারণে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করবে। বিএনপি এখন নতুন করে মধ্যবর্তী নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তারা এটা জানেন না যে সরকার শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। তার একদিন আগেও বিএনপির দাবির প্রেক্ষিতে ক্ষমতা ছাড়বে না।
এটা বিএনপি যদি মনে রাখে তাহলে তাদের লাভ হবে। অন্তত এই আন্দোলন চার বছর টেনে নিয়ে দেশের ক্ষতি করবে না। এদিকে সরকারের আরো একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের শেষ দিকেও নমনীয় ছিলেন। তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজে অ্যাবের মতো একটি আগাম নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন এই বছরের মার্চ থেকে নভেম্বরে। যদিও লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসবে। বিএনপি ওই ধরনের একটি নির্বাচন হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারতো। কিন্তু এখন বিএনপি যে আন্দোলন শুরু করেছে সেখানে তারা সরকারের পতন চাইছে এইভাবে সরকারের পতন হবে না। এখানে রাজনৈতিক প্রশ্ন। বিএনপি এখন যা করছে তারা মনে করছে সরকারের পতন ঘটাবে। তবে সরকার দেখেছে জনগণ এখনো সরকারের বিপক্ষে নয়। জনগণ যদি এই সরকারকে না চায় সেই ক্ষেত্রেই জনগণ রাজপথে নেমে আসলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। কিন্তু সব দিক থেকে সরকারের কাছে রিপোর্ট আসছে, জনগণ মাঠে নামবে না। সে জন্য সরকার এ সব বিষয় গুরুত্ব দিচ্ছে না।