বিভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতিতে ভোজ উৎসব

285

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

ধর্মের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তিতে আনন্দঘন পরিবেশে খাবার-দাবারের আয়োজন। এ আয়োজনে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা পিছিয়ে নেই। তাদের বড় উৎসবের অন্যতম হলো বড়দিনের আয়োজন। ২৫ ডিসেম্বর ‘বড়দিন’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায় আনন্দে মেতে ওঠে এবং ব্যাপক ভোজনের আয়োজন করা হয়। অ্যাভেজনলিক খ্রিস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে প্রতি শনিবার প্রার্থনার শেষে ভোজের আয়োজন করার রেওয়াজ আছে। বড়দিনের পরের দিন অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর বক্সিং ডে-তেও অনেকেই ঘরে অবস্থান করেন এবং বিত্তবানরা তাদের আনন্দ সমাজের গরিবদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। এ উপলক্ষেও সামাজিকভাবে খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়। কোনো কোনো উপদল জিসাসের ক্রোসিফাইড হওয়ার দিনকে স্মরণ করে ডিনারের আয়োজন করে থাকেন। খ্রিস্টপ্রধান দেশে হলোইন ডেসহ খ্রিস্ট ধর্মবিশ্বাসী গৃহে সন্তানের জন্ম ও মৃত্যুর পরও ধর্মীয় নিয়মানুসারে বিভিন্ন আচারের আয়োজন করা হয়।
বলা হয়ে থাকে, হিন্দু ধর্মে ‘বারো মাসে তের পার্বণ’। সন্তান জন্মের পর পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও বাচ্চার মুখে খাবার দেয়ার সময় অন্নপ্রাসন অনুষ্ঠান সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে হিন্দুধর্মে প্রচলিত রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক কর্মে এবং গরীবদের অন্নদানের ব্যবস্থা এবং মন্দির ও আশ্রমে বিভিন্ন ধর্মীয় আচারে ধর্মীয়ভাবে খাবারের আয়োজন করা হয়। মৃতদেহের শেষকৃত্যের পর বিদায়ী আত্মার শান্তির জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়। অবতার মনুর মতে, ‘খাদ্য সর্বদাই প্রার্থনার ন্যায়। কেননা এটা শক্তি ও চেতনা দেয়, এর প্রতি অভক্তি সব কিছু নষ্ট করে।’ অবশ্য হিন্দু সমাজে একটি বড় অংশ ভেজিটেরিয়ান হওয়ায় পারিবারিক ও সামাজিক ভোজের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ভেজিটেরিয়ানদের মতে, ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনো প্রাণী হত্যায় তোমাকে ব্যবহার করো না, মানুষ, প্রাণী কিংবা অন্য যে কোনো কিছু হোক।’
বৌদ্ধ বিশ্বাসে সামাজিকতায় খাবারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। উপমহাদেশের প্রাচীনত্বের উত্তরাধিকারী ও মহামতি বৌদ্ধের প্রবর্তিত ধর্মটির ধর্মীয় আচার অনেকটাই মঙ্ক-এর নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়। সন্ন্যাসবাদ ও প্রাণী হত্যাকে নিরুৎসাহিতকারী এ ধর্মের অনুসারীরা অনেকটাই ভেজিটারিয়ান। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রতিদিন তাদের নিজের এবং আশ্রমের জন্য অনুসারীদের কাছ থেকে নিজ ইচ্ছায় ভক্তিসহকারে স্বত্বত্যাগী দান গ্রহণ করেন, যা দিয়ে আশ্রমে জমায়েত ভিক্ষু, ধর্মানুসারীসহ সবাই তাদের প্রয়োজনীয় আহার সম্পন্ন করেন। অবশ্য বিভিন্ন উপদল ও ধারায় বিশ্বাসীরা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে কাজটি সম্পন্ন করেন। জাপানি মঙ্করা নির্দিষ্ট সময়ে ঃধশঁযধঃংঁ আবেদনের মাধ্যমে, আবার বর্তমানের অনেক দেশেই ফড়হধঃরড়হ আবেদন করেন। সারা বছরই বিভিন্ন পর্বে ও অনুষ্ঠানাদিতে খাবারের ব্যবস্থা থাকে, এসব পর্ব অবশ্য দল, উপদল অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন। মহায়ানা ও দেরাবাদা ধারার অনুসারীদের অনেকেই ভোজের সময় রসুন, পেঁয়াজ ও ঝাঁঝ জাতীয় ‘পঞ্চ ঝাঁঝ’ পরিত্যাগ করেন। আর খাবারের পূর্বে পাঁচটি বিষয় দৃঢ়চিত্তে স্মরণ করেন। ১. খাবার যিনি দিয়েছেন ২. খাবারের ব্যাপারে ধ্যানগত চুক্তির দৃষ্টি ৩. আত্মিক ধ্যান, যা হিংসা, ক্রোধ ও প্রবঞ্চনা থেকে রক্ষা করে ৪. উত্তম খাবার, যা শরীর ও মনকে পবিত্র করে এবং ৫. জীবনধারায় ধর্মীয় চেতনা অব্যাহত রাখা।
বিয়েশাদি উপলক্ষে আমাদের সমাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একমাত্র বিবাহবন্ধন সমাপনান্তে পাত্রের পক্ষ থেকে ওলিমা নামক যে অনুষ্ঠানটি করা হয়, তা সরাসরি ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। ওলিমার অনুষ্ঠানটি ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভোজ অনুষ্ঠান। রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের (রা.) বিবাহের খবর জানতে পেরে তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি একটি বকরি দিয়ে হলেও ওলিমা করো।’ (বোখারি, মুসলিম)। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের বিবাহেও ওলিমা করেছেন। জয়নব (রা.) এর সঙ্গে সম্পাদিত বিবাহে তিনি একটি বকরি জবাই করে ওলিমা করেছিলেন।
দাম্পত্য জীবনে নতুন সন্তানের আগমনে কোরবানির মতো কোনো পশু জবাই করে আকিকা নামক অনুষ্ঠান তো সন্তানের নিরাপত্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী রীতি। এক্ষেত্রে ভোজ অনুষ্ঠানটি একটি উত্তম কাজ, পালনীয় সুন্নত।
খাৎনা উপলক্ষে কেউ যদি মেহমানদারির আয়োজন করে, তা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবন থেকে প্রাপ্ত না হলেও অধিকাংশ মাজহাবের ইমাম কর্তৃক সমর্থিত। অনুরূপ কোনো বিশেষ সফর থেকে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক মেহমান ভোজের ব্যবস্থা করার কথা বর্ণিত আছে। আর শিক্ষাগত কোনো স্তরে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কখনও কখনও যে মেহমান খাওয়ানোর রীতি দেখা যায়, ইসলামের প্রথম যুগে এরূপ অনুষ্ঠান ছিল কোরআন হিফজ করার ক্ষেত্রে। তখন কারও সন্তান কোরআন হিফজ করলে সামর্থ্যানুযায়ী বকরি জবাই করে মেহমানদারির আয়োজন করা হতো। এছাড়া কোনোরূপ সুসংবাদে, খুশির প্রেক্ষাপটে এবং শুভ সূচনায় মেহমানদারির আয়োজনও ইসলাম সমর্থিত। মূলত ইসলামে যেসব ভোজ অনুষ্ঠানের প্রতি উৎসাহ বা অনুমতি দিয়েছে, তার প্রতিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যই হলো সজ্জনদের সঙ্গে আনন্দের ভাগাভাগি করা। বিবাহোত্তর যে অনুষ্ঠানকে আমরা ওলিমা বলি তার তাৎপর্যগত অর্থও তাই। এজন্য আরব সমাজে সব ধরনের ভোজ অনুষ্ঠানকে ঢালাওভাবে ওলিমা বলে। কমিউনিটি সেন্টারের নামকে মারকাজুল ওলায়েম বলে।
এজন্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু উপলক্ষে বিয়েবাড়ির আয়োজনের মতো কোনো অনুষ্ঠান ইসলামে উৎসাহিত করা হয়নি। কেবল সওয়াবের আমল হিসেবে মিসকিনদের আহার করানো বা কিছু মেহমানকে কোনো কোনো সময় আপ্যায়ন করার বিধান রয়েছে। তা দোয়া বা কোরআন খতমের মতো আমলের সঙ্গে না করা ভালো। কারণ এক্ষেত্রে আমলের বিনিময়ে খাদ্যদান কিংবা গ্রহণের ব্যাপারটা সরাসরি প্রকাশ পায় বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাস্তবে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির জন্য কোনো আমলের আয়োজনের সঙ্গে কোনোরূপ আহারের আয়োজন না থাকলে লোক সমাগমেও দৈন্যতা প্রকাশ পায়।
এবার আসা যাক অনুষ্ঠান আয়োজনের বিধান সম্পর্কে। এক্ষেত্রে ইসলাম কতগুলো নীতিমালা বেঁধে দিয়েছে, যার মধ্যে নেতিবাচক দিকে রয়েছে অপচয়, বাহুল্য, রেওয়াজ-রুসুম ও লৌকিকতা বর্জন। এর প্রতিটি বিষয়ে ইসলামে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ অপচয়ের কথা বলা যায়, অপচয়কারীকে কোরআনে সূরা আম্বিয়ায় শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। এছাড়া গান বা রঙ্গ-রসের আসর, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মেয়েদের সৌন্দর্য প্রদর্শন, ছেলেমেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও বেহায়া-বেহেল্লাপনাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বলা বাহুল্য, নৈতিক অবক্ষয়ের যেসব কর্মকান্ড সমাজে বাসা বাঁধে, এ ধরনের অনুষ্ঠান থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেতে তার সূত্রপাত ঘটে থাকে। অনুরূপভাবে মদের মতো কোনো হারাম উপাদান বা সুদ-ঘুষের মতো কোনো অবৈধ উপার্জনের উপাদানের মাধ্যমে আয়োজিত ভোজ ব্যবস্থাও ইসলামে সর্বৈব নিষিদ্ধ। ধনী-গরীবের তারতম্য তা যে কোনো উপায়ে হোক না কেন, ইসলাম তা সমর্থন করে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি বাণীতে বলা হয়েছে, নিকৃষ্টতম ভোজ হলো যেখানে দরিদ্রদের পরিহার করা হয়। (বোখারি, মুসলিম)।
অপরদিকে ইতিবাচক দিকে রয়েছে, মেহমানদারিতে মেহমানদের সম্মান রক্ষা করা। হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে সে যেন মেহমানকে সম্মান করে। সুতরাং মেহমান খানায় মেহমানদের জন্য সাধ্যানুযায়ী সম্মানজনক খাবারের আয়োজন করা যাতে তৃপ্তির কারণে আনন্দের প্রতিফলন ঘটে।
অনুরূপ আমন্ত্রিত মেহমানদের ক্ষেত্রেও ইসলামের সুস্পষ্ট বিধানের মধ্যে রয়েছে, বিবাহোত্তর ওলিমার দাওয়াতে কোনোরূপ ওজর বা বেশরিয়তি কাজের আশঙ্কা না থাকলে দাওয়াত রক্ষা করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ থেকে অনেক শক্ত বাণী রয়েছে, এর মধ্যে একটি হলো যে ওলিমার দাওয়াত পেয়ে উপস্থিত হলো না, সে আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানি করল। (বোখারি)। এমনকি রোজা আদায় অবস্থায় হলেও উপস্থিত হয়ে দোয়া করে আসতে হবে। আর নফল রোজা হলে রোজা ভেঙে দেয়াকে উত্তম গণ্য করা হয়েছে। দাওয়াত পেলে যেমন রক্ষা আবশ্যক, তেমনি বিনা দাওয়াতে হাজির হওয়াও গর্হিত। আবার মেহমানকে যেমন ভালো খাওয়ানোর মাধ্যমে খুশি করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, ঠিক তেমনি ভালোভাবে তৃপ্তিসহ খেয়েও মেজবানকে আনন্দ দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তবে কোনোভাবে মেজবানকে বেকায়দায় ফেলা, তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায় বা বিরক্তির কারণ হয় এমন আচারণ করা থেকেও নিবৃত্ত থাকতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে হজরত জয়নব (রা.) এর সঙ্গে বিবাহ উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আয়োজিত ওলিমা প্রসঙ্গে আল কোরআনে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এসব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘হে ঈমানদাররা! নবীগৃহে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করো না, খাবার সময়ের অপেক্ষায়ও থেকো না। হ্যাঁ, যদি তোমাদের খাবার জন্য ডাকা হয়, তাহলে অবশ্যই এসো কিন্তু খাওয়া হয়ে গেলে চলে যাও, কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। তোমাদের এসব আচরণ নবীকে কষ্ট দেয় কিন্তু তিনি লজ্জায় কিছু বলেন না এবং আল্লাহ হক কথা বলতে লজ্জা করেন না।’ (সূরা আহজাব : ৫৩)।
জয়নব (রা.) এর বিবাহের ওলিমা : রাসূল (সা.) যখন জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.) কে বিবাহ করেন, তখন তিনি ওলিমা অনুষ্ঠান করেন। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, নবী (সা.) রুটি ও গোশত দ্বারা জয়নব বিনতে জাহাশের ওলিমা করেন। আমাকে খাওয়ার জন্য লোকজনকে ডাকতে পাঠানো হলো, এরপর একদল করে লোক আসে ও খাওয়া-দাওয়া করে বের হয়ে যায়। আমি লোকজন ডাকতে থাকি, এমনকি আর কোনো লোক ডাকতে বাকি ছিল না। (বোখারি)।
সাফিয়া (রা.) এর বিবাহোত্তর ওলিমা : রাসূল (সা.) সাফিয়া (রা.) এর বিবাহের পরও ওলিমা করেন। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) খায়বর ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে তিন রাত অবস্থান করেন। এ সময় তিনি সাফিয়া (রা.) এর সঙ্গে বাসর করেন। অতঃপর আমি মুসলমানদের তার ওলিমা অনুষ্ঠানে ডাকি। এ ওলিমাতে কোনো রুটি বা গোশত ছিল না। বরং দস্তরখানা বিছানোর নির্দেশ দেয়া হলো। অতঃপর তিনি দস্তরখানায় খেজুর, পনির ও মাখন রাখলেন। এগুলো দিয়ে তার এ ওলিমা হলো। (বোখারি : ৫০৮৫)।
জাবের (রা.) এর বাড়িতে : জাবের (রা.) বলেন, খন্দক যুদ্ধের সময় আমি রাসূল (সা.) এর কাছে এলাম এবং তাকে চুপিসারে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমরা একটা ছোট ছাগল জবাই করেছি এবং সামান্য পরিমাণ যবের রুটি তৈরি করেছি। আপনারা কিছু লোক আসুন। তখন নবী (সা.) যুদ্ধরত উপস্থিত সব সাহাবিকে ডাকলেন, তারা সংখ্যায় ছিলেন ১ হাজার। তারা সবাই তৃপ্তি সহকারে খেলেন। (বোখারি : ৪১০২)।
আবু তালহার বাড়িতে : আবু তালহা (রা.) রাসূল (সা.) কে দাওয়াত করলেন। রাসূল (সা.) এর সঙ্গে ৭০ বা ৮০ জন সাহাবি ছিলেন। তিনি সবাইকে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন। ১০ জন করে লোক বাড়িতে প্রবেশ করলেন এবং খাওয়া সেরে চলে যেতে লাগলেন। এভাবে সবাই তৃপ্তি সহকারে খেলেন। (বোখারি : ৩৫৭৮)।
খায়বর যুদ্ধের সময় : সুয়াইদ ইবনে নোমান (রা.) বলেন, আমরা খায়বার অভিমুখে রওনা হলাম। এরপর সাহাবা নামক স্থানে পৌঁছলাম। রাসূল (সা.) খাবার নিয়ে আসতে বললেন। তখন তাঁর সামনে শুধু ছাতু পেশ করা হলো। এরপর আমরা তা খেলাম। (বোখারি : ৫৩৮৪)।
আবু শুয়াইব (রা.) এর বাড়িতে : আনসার সাহাবি আবু শুয়াইবের গোশত বিক্রেতা গোলাম খাবারের আয়োজন করলেন এবং রাসূল (সা.) সহ পাঁচজনকে দাওয়াত করলেন। (বোখারি : ৫৫৩৪)।
ইহুদি মহিলার দাওয়াত : খায়বরের এক ইহুদি মহিলা বিষ মিশিয়ে একটি ছাগল ভুনা করল। এরপর তা রাসূল (সা.) কে হাদিয়া দিল। রাসূল (সা.) এবং কয়েকজন সাহাবি তা খেলেন। (আবু দাউদ : ৪৫১০)।
তাবুক যুদ্ধের সময় : তাবুক যুদ্ধের দিন সাহাবারা প্রচন্ড ক্ষুধার্ত হলেন। ওমর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকদের তাদের অবশিষ্ট খাবার আনতে বলুন। এরপর আল্লাহর কাছে বরকতের জন্য দোয়া করুন। রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তখন তিনি একটি দস্তরখানা বিছাতে বললেন। এরপর লোকরা তাদের অবশিষ্ট খাবার আনল। এরপর রাসূল (সা.) বরকতের দোয়া করলেন। তারা সবাই পরিতৃপ্তি সহকারে খেল ও তাদের পাত্র ভরে নিল। (মুসলিম : ৪৫)।
এক মৃত সাহাবির বাড়িতে : এক আনসার সাহাবি বলেন, আমরা রাসূল (সা.) এর সঙ্গে এক জানাজায় গেলাম। জানাজা শেষে মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি দাওয়াত করল। তিনি দাওয়াত কবুল করলেন। আমরা তার সঙ্গে ছিলাম। এরপর খাবার নিয়ে আসা হলো। তখন তিনি খাবারে হাত দিলেন। এরপর লোকজনও হাত দিল। লোকরা খেল। কিন্তু আমরা রাসূল (সা.) কে দেখলাম তিনি একটি লোকমাই মুখে চিবাচ্ছেন। তিনি বললেন, আমার মনে হচ্ছে এটা এমন এক ছাগলের গোশত যা তার মনিবের অনুমতি ছাড়াই নেয়া হয়েছে। এরপর ঘটনার সত্যতা পেলে রাসূল (সা.) বললেন, এ খাবার বন্দিদের খাওয়াও। (আবু দাউদ : ৩৩৩২)।
আনসারি সাহাবির বাড়িতে : রাসূল (সা.), আবু বকর, ওমর (রা.) তিনজনে ক্ষুধার্ত অবস্থায় এক আনসারি সাহাবির বাড়িতে গেলেন। সাহাবি তখন বাড়িতে ছিলেন না। সাহাবির স্ত্রী তাদের স্বাগত জানালেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অমুক (সাহাবি) কোথায়? স্ত্রী বললেন, তিনি আমাদের জন্য পানি আনতে গেছেন। এমন সময় আনসারি এলেন। তিনি রাসূল (সা.) ও তার সঙ্গীদের দেখে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজ আমার থেকে সম্মানিত মেহমান কারও নেই। তিনি একটি খেজুরের কাঁদি আনলেন এবং বললেন, আপনারা এগুলো খান এবং ছুরি নিলেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, দুধাল ছাগল থেকে বিরত থাকবে। এরপর আনসারি ছাগল জবেহ করলেন। তারা ছাগলের গোশত ও খেজুর খেলেন এবং পানি পান করলেন। যখন পরিতৃপ্ত হলেন তখন রাসূল (সা.) আবু বকর ও ওমরকে বললেন, ওই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অবশ্যই এ নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (মুসলিম : ২০৩৮)। ইসলামিক দৃষ্টিতে খানাপিনা শুরু এবং শেষে নিম্নলিখিত কার্যাদি বাংলায় আলোচনা করা হলো-
* খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলবে : ওমর ইবনে আবু সালামাহ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) আমাকে বললেন বিসমিল্লাহ বলো এবং ডান হাতে খাও। (বোখারি : ৫৩৭৬)।
* শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে : আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন কেউ খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে সে যেন বলে বিসমিল্লাহি আউয়ালাহু ওয়া আখিরাহু খাওয়ার শুরু ও শেষ সর্বাবস্থায় আল্লাহর নাম। (আবু দাউদ : ৩৭৬৭)।
* খাওয়া শেষ করে বলবে : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) যখন খাওয়া শেষ করতেন তখন বলতেন আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আতয়ামানা ওয়া সাকানা ওয়া জায়ালানা মুসলিমিন সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের পানাহার করিয়েছেন এবং আমাদের মুসলমান বানিয়েছেন। (আবু দাউদ : ৩৮৫০)।
* দুধ পানের সময় বলবে : ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন তোমাদের কাউকে দুধ পান করতে দেয়া হলে সে যেন বলে আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফিহি ওয়া জিদনা মিনহু হে আল্লাহ! আমাদের জন্য দুধে বরকত দান করুন এবং আমাদের দুধ বাড়িয়ে দিন। (আবু দাউদ : ৩৭৩০)।
* খাবার সামনে এলে বলবে : আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফিমা রাজাকতানা ওয়াকিনা আজাবান্নার হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যে রিজিক দান করেছেন তাতে বরকত দান করুন এবং আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন। (তাফসিরে ছায়ালাবি)।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।