ইসলাম ও পরিবেশে হেমন্তের উৎসব

137

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

বাংলাদেশের সর্বত্র সবুজ ধানের ক্ষেতে হলুদ আভার হাতছানি। একই সাথে শীতের আগমনী গান বাজছে প্রকৃতিতে। শিশির বিন্দু সাজিয়ে দিচ্ছে ধানের শীষকে। প্রকৃতি সেজেছে যেন নতুন রূপে। অগ্রহায়ণ ধান কাটার মৌসুম। সর্বত্র পাকা ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ। দিগন্ত জোড়া পাকা ধানের হলুদ হাসি দেখে কৃষকের মনও আনন্দে নেচে ওঠে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সারা বছর যে পরিশ্রম করেছে মাঠভরা ফসলের দৃশ্য দেখে সে কষ্ট নিমেষেই ভুলে যায় কৃষক। বাংলার গ্রামে গ্রামে ধান কাটার ধুম পড়ে এ মাসে। দল বেঁধে কৃষকরা রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কেটে করে ঘরে ফিরে। ধান ভানার গান ভাসে বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় ঢেঁকির শব্দ কিছুটা কমে গেলেও এখনো হারিয়ে যায়নি বটে। অগ্রহায়ণে বাংলার অপরূপ রূপে মাতোয়ারা হয়ে কবি জীবনানন্দ দাস লিখেন তার অমর পঙতি, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে। অগ্রহায়ণ মাসে শুরু হয় বাঙালির প্রাণের নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে কৃষকের আঙিনা। কৃষাণীর কাজের কোন শেষ নেই। ধান মাড়াই করা, সিদ্ধ করা বা রোদে শুকানো। দিন-রাত কাজ। কিন্তু কোন ক্লান্তি নেই। অভিযোগ নেই। বরং আনন্দের হিল্লোল সবার মনে।
নতুন ধান ঘরে ওঠার পর শুরু হয় নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের পিঠা উৎসব বসে ঘরে ঘরে। পাকন, চিতুই, ভাপা, পাটি সাপটাসহ বিচিত্র সব নকশি পিঠা তৈরি হয় গ্রামে গ্রামে। নতুন চালের সাথে খেজুর রস মিশিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু পায়েস। নবান্নের সময় বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। নতুন ধানের ভাত মুখে দেয়ার আগে মিলাদ পড়ানো হয়। মসজিদে শিন্নি দেয়ার রেওয়াজও আছে গ্রামে। হিন্দু পরিবারে চলে পূজোর আয়োজন। সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন, সবার ঘরে ঘরে।’
কীভাবে এলো অগ্রহায়ণ? অঘ্রান বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ। ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম আর ‘হায়ণ’ অর্থ মাস। আবুল ফজলের আইন ই আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর ১৫৫৬ সালে যখন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন তখন অগ্রহায়ণই ছিল প্রথম মাস। ধান কাটার মধ্যদিয়েই বাঙালি জাতি তাদের বছর শুরু করতো। পরবর্তীকালে হিজরী সালের সাথে বাংলা সালের মিল রাখতে গিয়ে বৈশাখ মাসকে প্রথম মাস ধরা হয়। হিজরী সাল শুরু হয় মহররম মাস দিয়ে। সে সময়টাতে বাংলায় হয় বৈশাখ।
এভাবে মাসের পরিবর্তন হলেও বাঙালির সত্যিকার বর্ষবরণের শুরু হয়; কিন্তু অগ্রহায়ণেই। কারণ, তখন কৃষকের ঘরে থাকে প্রাচুর্য-সুখ। নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো মেলা। হরেকরকম দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলা। শুধু গ্রামের নয়, শহরেও ব্যাপকভাবে আয়োজন হয় মেলার। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, খেলনা পুতুল, মাটির জিনিসপত্র। কৃষক মেলা থেকে ফসল বিক্রির টাকায় বউয়ের জন্য তাঁতের শাড়ি, মেয়ের জন্য আলতা আর ছেলের জন্য কেনে বাঁশি। সেই সাথে মুড়ি-মুড়কি, সন্দেশ-মুড়ালি কেনা হয়। মেলাকে ঘিরে গ্রাম-গঞ্জে সব শ্রেণীর মানুষের ঢল নামে। মানুষে মানুষে মুখরিত হয় মেলাঙ্গন। দৃঢ় হয় মানুষের বন্ধন।
মজার ব্যাপার হলো, এতো কাল অগ্রহায়ণ ছিল গ্রামের উৎসব। কৃষকের উৎসব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নগর সংস্কৃতিতেও নিজের শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে অগ্রহায়ণ। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে এখন বেশ জাঁকজমকের সাথে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। প্রতিবছর দেশের প্রথমসারির সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো একত্রে জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদের ব্যানারে আয়োজন করে নবান্ন উৎসব। মেলা বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায়। বাঙালির পল্লীগীতি আর দেশজ গানের সুরে সুরে শিল্পীরা মাতিয়ে তোলে শহুরে শ্রোতাদের। চারুকলায় বসে পিঠামেলা। হরেক রকম পিঠা চেখে দেখে শহরের সংস্কৃতিমোদি নাগরিকরা। এভাবে অগ্রহায়ণ বিনি সুতোর মালা গেঁথে শহর আর গ্রামের মানুষকে নিয়ে আসে একই বৃত্তে। সবার প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির মাহাত্ম্য। একই সুর বাজে সবার মনে। ঐক্যের চেতনায় দীপ্ত হয় বাঙালির চিত্ত।
অগ্রহায়ণে কৃষকের গোলা ভরে উঠবে আমন, আউশ আর ইরি ধানে। নতুন হৈমন্তিক ধানের গন্ধে মৌ মৌ করা চারপাশে কেমন উৎসবের আমেজ। বাড়ি বাড়ি নতুন চালের পিঠা। রাত জেগে মা-চাচিদের উঠোন আলো করে পিঠা বানানোর আয়োজন। বাংলার প্রধান কৃষিজ ফসল কাটার ক্ষণ হেমন্ত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। অঘ্রাণে আমন ধান পাকার পর সাধারণত এ উৎসব পালন করা হয়। নবান্ন হেমন্তের প্রাণ। স্মরণাতীতকাল থেকে ১ অগ্রহায়ণকে বলা হয়ে থাকে ‘বাৎসরিক সুদিন’। ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম। আর ‘হায়ণ’ অর্থ মাস। এ থেকেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। ইসলাম অবশ্য আমাদের শিখিয়েছে, আল্লাহ তায়ালার দেয়া প্রতিটি দিনই সুদিন। সময়ের কোনো ভালো-মন্দ নেই। ভালো-মন্দ আমাদের কর্মে।
অঘ্রাণ এলেই বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়ে বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আসে। ঘরে ঘরে পিঠা, পুলি, পায়েস, ক্ষীর এবং আরও হরেক ধরনের মিষ্টান্নের মেজবানি। কুটুম আসে। এবাড়ি-ওবাড়ি পিঠা দেয়া-নেয়া হয়। উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা এ সময় পুরো গ্রামবাংলা। নতুন চালের ভাত মুখে দেয়ার আগে মসজিদে দোয়ার অনুষ্ঠান করা হয়। শিরনি হাতে বাড়ি ফেরে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই। প্রতিবেশীকে মিষ্টিমুখ করিয়ে নির্মল আত্মতৃৃপ্তিতে ভরে ওঠে কৃষকের মন। ইসলামে যে অতিথি আপ্যায়ন ও প্রতিবেশী তুষ্ট করার শিক্ষা দিয়েছে- এ যেন তারই প্রায়োগিক রূপ। নবান্নের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন মেলা। এ সময় গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। ছেলে-বুড়ো সবাই দল বেঁধে মেলায় যান। দাদা-নানার হাত ধরে অঘ্রাণের গ্রামীণ মেলায় যাওয়ার স্মৃতি আমাদের অনেকেরই আছে। এসব মেলায় নানা ধরনের নকশা করা পিঠা, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, মন্ডা-মিঠাই, সন্দেশ, নাড়ু, তক্তি, নারিকেলসহ কত কী যে পাওয়া যায়, তার ইয়ত্তা নেই। শখের মৃৎশিল্প; মাটির তৈরি তৈজসপত্র, কাঠ-বাঁশ-বেতের হস্তশিল্প কেনার হিড়িক পড়ে মেলাজুড়ে। নবান্নের মেলা গ্রামের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের পদভারে মুখরিত হয়।
নবান্ন আমাদের ঐতিহ্যের শস্যোৎসব। আল্লাহর নেয়ামত ভোগের উৎসব। আল্লাহর বাণী আমাদের স্মরণীয়, ‘হে আদম সন্তান, তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা গ্রহণ করো আর খাও এবং পান করো। তবে অপব্যয় করো না, তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)। তেমনি হেমন্ত আমাদের অনুভবের ঋতু। এ সময় আল্লাহর নেয়ামত উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত হতে হবে। তার নির্দেশানুযায়ী জীবন পরিচালনার শিক্ষা ও প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। সব কিছুর নিপুণগ্রষ্টা দাতা ও দয়ালু আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, আল্লাহ তোমাদের যেসব হালাল ও পবিত্র বস্তু দিয়েছেন, তা তোমরা আহার করো এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদতকারী হয়ে থাকো।’ (সূরা নাহল : ১১৪)।
১২ মাসের ছয় ঋতু নিয়ে আমাদের এ বাংলাদেশ। কালের আবর্তনে, প্রকৃতির বিবর্তনে সবুজের চাদরে নেমে আসে ষড়ঋতুর অনুপম রূপবৈচিত্র্য। ছয়টি প্রকৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ছয়টি অনিন্দ্য শিল্পকর্ম। সুন্দরপিয়াসী মনে নিয়ে আসে চঞ্চলতা। বোধের দিগন্তে হেসে ওঠে অনন্ত রূপের আধার ও রূপ-রস-ছন্দ-আনন্দের মালিকের অলোক সক্ষমতা। ঘোরলাগা অনুভবে ভাবুকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর/না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর…’
এ সময়ের পালাবদলে প্রকৃতিতে আসে হেমন্তকাল। হেমন্ত হলুদের কাল, সবুজের কাল, মৌ মৌ আমন ধানের আগমনীর কাল। হলুদ চাদরে ঢাকা প্রকৃতির কাল। প্রভাতে সূর্যের কিরণে ধান গাছের সুচালো অগ্রে শিশির নামা হিরক দানার আনন্দ কাল। মায়াবি প্রকৃতির মনোলোভা রূপে পৃথিবীর সজীবতার কাল। ছয় ঋতুর অন্যতম সুন্দর ও আরামদায়ক একটি হলো হেমন্ত। কবির ভাষায় ঋতুরানী। শুভ্র শরতের পরেই প্রকৃতিকে দৃষ্টিসুখ আনন্দে হাসাতে মাটির প্রতিবেশে জেগে ওঠে সরষে হলুদ হেমন্ত। কার্তিক আর অগ্রহায়ণের এ সময় দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে শুভ্রসজাগ থাকে রূপালি তারকারাজি। শুক্লপক্ষের চাঁদের নীলাভ জোছনা দেয় মন ভালো করা অনুভূতি। পূর্ণিমা হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রূপার থালা। মৃদু ছন্দ তুলে শিশির নেমে আসে ঘাসের ডগায়। সবুজ ধানের ক্ষেতে শুরু হয় শিশির আর দুধ-সাদা জোছনার মাখামাখি ভালোবাসা। প্রভুর প্রেমিক পুরো প্রতিবেশে শুনতে পায় রব্বে আলার গুণগান। শিশিরের ছন্দ-শব্দে মূর্ত হয় সুরেলা জিকির। আল্লাহর গোলাম ছুটে যায় জায়নামাজে। অবনত কপাল নেমে আসে তাঁর উদ্দেশে শুকরিয়া সেজদায়। প্রশংসার অনিন্দ্য সঙ্গীত সুর তোলে যায় ইন্দ্রীয় থেকে ইন্দ্রিয়ান্তরে।
প্রভাতি সমিরণে শীতের আগমন ধ্বনি। ঘাসের ডগায় শিশিরকণা মুক্তাদানা হয়ে হেসে ওঠে। সবুজ ধানের ক্ষেত কুয়াশা স্পর্শে হয়ে ওঠে আরও সজীব সুন্দর। রকমারি ধানের নানা ঘ্রাণে মনের ভেতর শুরু হয় মোহঘোর আন্দোলন। পোলাও ধানের ক্ষেতের আলে দাঁড়ালেই পেটের ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কৃতজ্ঞ বান্দার মুখে ও মনে অজান্তেই উচ্চারিত হয় ‘আলহামদুলিল্লাহ’। মাঠের পর মাঠ সরিষার হলুদ ফুল দেখে মনে হয় প্রকৃতি তার হলুদ আঁচলের আদরে ঢেকে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশ। সবুজ ধান আর সরষে হলুদ দিয়ে শুরু হওয়া হেমন্ত এক সময় হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যের সোনালি রঙ সোপান। ধনী-গরীব সবার মুখে লেগে থাকে অকৃত্রিম হাসি। বাংলাদেশ জুড়ে নেমে আসে এক ঐশী সুখের সুবাতাস।
হেমন্তের শেষের দিনগুলোয় সবুজ মাঠ ক্রমে সোনালি রঙে আর হলুদ সরষে ধূসর রঙে বদল হতে থাকে। কাঁচা সবুজ ধান ও হলুদ সরিষার ফুলে ভর করে রিজিক। ধানের পেটে চালের বেড়ে ওঠা আর সরিষার পেটে তেলের বেড়ে ওঠায় কৃষকের আকর্ণ হাসির আড়ালে জেগে ওঠে মহামহিমের কৃতজ্ঞতা। কাস্তে হাতে কৃষকের ধান কাটার অপরূপ দৃশ্যে ছবি হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত হয়ে ওঠে চারপাশ। বাদামি খড়ের বিচালিতে পথ-ঘাট-মাঠ হয়ে ওঠে কুদরতের বিছানা। আমনের ফলনে রিজিকের ফয়সালা হয় মানুষ, পশু আর পাখির। ভোরের নাশতায় হেসে ওঠে শুভ্র খই। সেই সঙ্গে খেজুর গুড় ও রসের শুরু হয় আগমনী গান।
হেমন্তের আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ। শেষের দিকে শুরু হয় শীতের আগমন। রাত হতে থাকে দীর্ঘ। প্রেমিক বান্দার ঘুম ভেঙে যায় রাতের শেষে। গ্রীষ্মকালে রাত ছোট থাকায় অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন না। হেমন্ত আসতেই রাত দীর্ঘ হতে শুরু করায় তাহাজ্জুদের সুবর্ণ সুযোগ এটি। সমগ্র ভালোবাসার নৈবেদ্য নিয়ে হাজির হয় প্রভুর দরবারে। চোখের জলে নেমে যায় পাপের অতীত। মহান আল্লাহ বান্দাকে এমন নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতি দেয়ার একটা উদ্দেশ্য, বান্দা শান্তি ও আরামের সঙ্গে মশগুল হবে ইবাদতে।
যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন, কোরআন তাদের মুহসেন ও মুত্তাকি নামে অভিহিত করে। তাদের আল্লাহর রহমত এবং আখেরাতে চিরন্তন সুখ সম্পদের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুত্তাকি লোক বাগ-বাগিচায় এবং ঝরনার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে এবং যে নিয়ামত তাদের পরোয়ারদিগার তাদের দিতে থাকবেন, সেগুলো তারা গ্রহণ করবে। (কারণ) নিঃসন্দেহে তারা এর আগে (দুনিয়ার জীবনে) বড় পুণ্যবান ছিল। তারা রাতের খুব অল্প অংশেই ঘুমাত এবং শেষ রাতে এস্তেগফার করত। (কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইত)’। (সূরা জারিয়াত : ১৫-১৮)।
রাসূল (সা.) বলেছেন, রাতের শেষ সময়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার দিকে নাজিল হন এবং বলেন, ‘ডাকার জন্য কেউ আছে কি, যার ডাক আমি শুনব; চাওয়ার জন্য কেউ আছে কি, যাকে আমি দেব; গোনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে কি, যার গোনাহ আমি মাফ করব?’ (বোখারি)।
হেমন্তের আগমনধ্বনি যখনই নেমে আসে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে, তখনই অতিথি পাখিরাও আসতে থাকে। হাজার মাইল দূরের সেই পাখিদের আগমনীতে প্রতিভাত হয় আল্লাহর অনন্যতা। তিনি প্রকৃতিতে নিয়ে আসেন নানা অবস্থা। আবার সে অবস্থায় নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে দেন তিনিই। তাই পাখিরাও তীব্র শীত থেকে বাঁচতে কম শীতের বাংলাদেশে চলে আসে। মুখর হয়ে ওঠে বাংলার বিল-ঝিল-সরোবর। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ, প্রাণী, পশুপাখির জীবনযাত্রায় আসে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের একমাত্র ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে। তিনি এসব পরিবর্তনের মধ্যেই বান্দার জন্য রাখেন প্রভূত কল্যাণ আর ইতিবাচক শিক্ষা। বান্দার অভিব্যক্তি হিসেবে ভাষা পায় তা কোরআনে করিমে, ‘আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান।’ (সূরা আলে ইমরান : ২৭)। কালের এমন বিবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয় আসমানগুলো ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)।
হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। প্রতি রাতেই কোথাও না কোথাও বসে ইসলামী আলোচনার আসর। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পরপরই শুরু হয় হালকা গরম কাপড় কাঁধে বয়স্কদের মাহফিলের দিকে হেঁটে চলা। চলতে থাকে কিশোর-যুবারাও। বৃষ্টি ও ঝড়ের সম্ভাবনা না থাকায় এ সময়ই আমাদের দেশে বসে নানা আনন্দ-উৎসবও। হেমেন্তের সমাপনী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নেমে আসে নবান্ন উৎসবের আনন্দ। রকমারি পিঠার আয়োজনে মেতে ওঠে পুরো দেশ। আল্লাহর গোলাম এসব আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যায়। সেজদায় অশ্র“পাতে দেয় শুকরিয়ার নজরানা। ষড়ঋতুর অন্যতম এ হেমন্ত আরাম-শান্তি-সুখ আর ইবাদতের ঋতু হয়ে ওঠুক আমাদের সবার মনে-অন্দরে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।