কিশোরগঞ্জে বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়া ॥ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত থাকুন ॥ র‌্যাব খুনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে

73

banglanews24.comকাজিরবাজার ডেস্ক :
ক্ষমতায় নয়, জনগণের সঙ্গে থাকতে চান বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। বীরত্বের প্রতীক ঈশা খাঁর স্মৃতিধন্য কিশোরগঞ্জের জনসভায় তিনি বলেছেন, আমাদের আন্দোলন ক্ষমতায় যেতে নয়, দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে। দেশের মানুষ আমাকে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে। এখন আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমি দেশের তরুণ প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে চাই। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। দেশে গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরাই সেটা পারবো। ভবিষ্যতে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দেবো। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনে নতুন করে এগিয়ে যাবো। আমরা পরিবর্তন আনবোই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় পাচ্ছে, কারণ তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা জানে, ক্ষমতা থেকে নামলে দেশের মানুষ তাদের আর আস্ত রাখবে না। তারা রাস্তা দিয়ে চলতে পারবে না। এলাকায় যেতে পারবে না। এ সরকারের অবস্থা হবে এরশাদের মতো। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা ভোট পাবে না। এ সরকার কেবল অবৈধই নয়, তারা ব্যর্থ সরকার। সরকারি গুরুদয়াল কলেজ মাঠের জনসমুদ্রে খালেদা জিয়া বলেন, ঈশা খাঁর তরবারির কথা আপনাদের মনে আছে? সেটি ছিল প্রতিবাদ ও ন্যায়ের প্রতীক। যদি আরও বেশি নির্যাতন হয়, তবে ঢাল-তালোয়ার নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হলে আর বিকল্প পথ থাকবে না। তখন আমাদের কঠোর আন্দোলনে যেতে হবে। তিনি উপস্থিত জনতার প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনারা আমার ডাকে সাড়া দেবেন কি? এ সময় সমবেত জনতা হাত তুলে ও স্লোগান দিয়ে তাকে সমর্থন জানান। খালেদা জিয়া বলেন, দেশ নিয়ে তারা খেলা শুরু করেছে। এভাবে তাদের খেলতে দেয়া যাবে না। রক্তে অর্জিত এ দেশকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে নবাব সিরাজউদ-দৌলার যেমন জন্ম হয়েছিল তেমনি এ দেশে ছিল মীরজাফর। নব্য মীরজাফরদের বিদায় করে আমরা দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবো। মীরজাফরদের পরাজয় হবেই, হবে। এসময় বিগত আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার কথা স্মরণ করে কিশোরগঞ্জবাসীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি কিশোরগঞ্জের চন্দ্রাবতীর কথা স্মরণ করে বক্তব্য শুরু করেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যে তিনি সরকারের কড়া সমালোচনার পাশাপাশি কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও তুলেন ধরেন।
খালেদা জিয়া বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমরা সমাবেশ করছি। প্রতিটি জেলায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বড় বড় সমাবেশ হচ্ছে। তাই কোনটির চেয়ে কোনটি বড় সেটা বলতে পারবো না। এটা বলতে পারি, আমাদের সমাবেশে দিনদিন মানুষের সম্পৃক্ততা ও উপস্থিতি বাড়ছে। আমাদের দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। আজ সমাবেশের মাঠ ছাড়িয়ে পুরো শহর লোকারণ্য হয়ে পড়েছে। কারণ আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, মানবাধিকার রক্ষা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারে আন্দোলন করছি। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর দিনটিকে দেশের মানুষ নানাভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেন। আওয়ামী লীগ যখন দেশকে তাঁবেদার বানাতে চেয়েছিল তখন সেদিন দেশের সিপাহি-জনতা বিপ্লব ও সংহতির মাধ্যমে তা ব্যর্থ করে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার ৭ নভেম্বরকে মানুষের কাছে ভুলিয়ে দিতে চায়। এ জন্য জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আমাদের ৮ নভেম্বর সমাবেশ করতে দেয়নি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদেশীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, আপনারা র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেবেন না, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া যাবে না। র‌্যাবকে মিশনে নেবেন না। যারা দেশের মধ্যে মানুষ খুনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তারা মিশনে গেলেও বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণœ করবে। তিনি বলেন, র‌্যাব এখন মানুষ খুনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের কথা বলা হলেও সেখানে ১১ জনকে খুন করা হয়েছে। যে নৌকায় করে লাশগুলো নদীতে ফেলে দিতে নিয়েছিল সে নৌকার মাঝিকেও হত্যা করেছে। তিনি বলেন, মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে র‌্যাব কাউকে না কাউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তারা বলে, কিছুক্ষণ পরই ফিরে পাবেন। কিন্তু তাদের আর ফিরে যাওয়া যায় না। খালেদা জিয়া বলেন, সিলেটে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও বারবার নির্বাচিত এমপি ইলিয়াস আলীকে তুলে নেয়ার পর আর পাওয়া যায়নি। কুমিল্লার লাকসামের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুসহ দুই নেতাকে গুম করেছে। এলাকাবাসী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে দাবি জানানোর পরও তাদের ফিরিয়ে দেয়নি। র‌্যাব ধরে নিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। ২০দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আজ খুবই খারাপ। কারা এটা করছে জানেন? কেবল ছাত্রলীগ-যুবলীগ নয়, আরও রয়েছে পুলিশ। পুলিশ এখন সারা দেশে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও নিরীহ মানুষজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছে টাকা আদায় করে। অনেক গরিব মানুষ টাকা দিতে পাারে না। তখন পুলিশ তাদের শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। অনেকে আর বাঁচেও না। কিন্তু পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে প্রতিদিন মিছিল-মিটিং হচ্ছে। আর আমাদের কার্যালয়ের সামনে সবসময় পুলিশ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আমাদের নেতাকর্মীদের কোন শান্তিপূর্ণ মিছিল-মিটিং করতে দেয় না। আজ পুলিশের প্রতি দেশবাসীর কোন আস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানটি এখন একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। পদোন্নতি ও সুবিধাজনক বদলির আশ্বাসে পুলিশ এখন কন্ট্রাকে মানুষ খুন করছে। পুলিশকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি না করতে বিদেশীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিরোধীদলের উপর নির্যাতন ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি পুলিশের কাজ নয়। বিদেশীদের কাছে অনুরোধ- যারা বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়, তাদের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি করবেন না।
পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা বিশ্বজিতের নাম শুনেছেন? কারা তাকে হত্যা করেছে জানেন? সেদিন নিজেকে একজন হিন্দু এবং কোন রাজনীতি করে না বলেও জীবনে বাঁচতে পারেনি নিরীহ ছেলেটি। কিন্তু সে হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই আওয়ামী লীগের আমলে প্রতিদিন সারা দেশে খুন-গুমের ঘটনা ঘটছে। এ সময় তিনি দৈনিক মানবজমিনের একটি প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, হিন্দুদের মন্দিরের জায়গা দখল করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এটা আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির জন্য বিদেশে মামলা চলছে। আর বাংলাদেশে তাদের দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লুটেরাদের বলছেন, দেশপ্রেমিক।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন বলেছিল- তাদের বৈধতা দিলে আমাদের ক্ষমতায় বসানো হবে। আমি সেটা মেনে নিইনি। তাদের পরিষ্কার বলেছিলাম, তোমরা আমাকে ক্ষমতায় বসানোর কে? আমাকে ক্ষমতায় বসাবে দেশের জনগণ। খালেদা জিয়া বলেন, ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন বলেছিল- আপনারা দেশ থেকে চলে যান। আপনাদের কিছু হবে না। আমি বলেছিলাম, আমি কোন অন্যায় করিনি, কেন দেশ ছেড়ে চলে যাবো। দেশের বাইরে আমার কোন ঠিকানা নেই। আপনারা লক্ষ্য করবেন, আমি ১ বছর ৮ মাস কারাগারে ছিলাম। আমি দেশ ছেড়ে যাইনি। কিন্তু আরেকজন দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ তিনি অন্যায় করেছিলেন। তার চেক ধরা পড়েছিল। তার ভাই ও তার দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল তা স্বীকার করেছিলেন। সময় এলে ওই স্বীকারোক্তি প্রকাশ করা হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলায় তিনজন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তাদের ছেলেরা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন কিন্তু কিশোরগঞ্জের কোন উন্নয়ন হয়নি। রাস্তাঘাটের যে বেহাল দশা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। কিশোরগঞ্জে আমাদের সময়ের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে বক্তব্য দেয়ার সময় পাবো না। কিন্তু আমরা দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছি, সবার জন্য সমান দৃষ্টিতে উন্নয়ন করেছি। কোন জেলায় আমাদের মন্ত্রী-এমপি আছে সেটা আমরা দেখিনি। কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ফজলুর রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। এ জন্য তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে না। অথচ প্রতিদিনই সরকারি দলের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য দিচ্ছেন। এখন জামিন পাওয়া যায় না, অনেক কষ্টে ফজলুর রহমান জামিন পেয়েছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মির্জা আলমগীর বলেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার মিথ্যে মামলা দেয়া হয়েছে। এ মামলার এজাহারে তারেক রহমানের নাম ছিল না। পরে তিন তিন বার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে তারেক রহমানের নাম জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জনসভার সমন্বয়কারী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এম ওসমান ফারুক বলেন, শেখ হাসিনাকে বলতে চাই, আন্দোলন কাকে বলে কিশোরগঞ্জের সমাবেশে এসে দেখে যান। লাখ লাখ মানুষ আপনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। সভাপতির বক্তব্যে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শরীফুল আলম বলেন, ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে প্রতিরোধ আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে রাজপথে প্রতিরোধ গড়েছিল কিশোরগঞ্জের জনগণ। আগামীতে ২০ দলীয় জোট নেত্রী আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করলে তার চেয়েও বেশি প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। জনসভায় ২০ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীরবিক্রম, খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মো. ইসহাক, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, এনডিপি চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোস্তফা, মুসলিম লীগের সভাপতি এইচএম কামরুজ্জামান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রি. জে. (অব.) হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দারসহ বিএনপি ও জোটের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন।