সিলেট আদালত চত্বরে সাবেক বিচারপতি মানিককে ডিম-জুতা নিক্ষেপ

11

 

স্টাফ রিপোর্টার

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক হাইকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেছে পুলিশ। শনিবার বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে সিলেটের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ এর বিচারক আলমগীর হোসেনের আদালতে তাকে তোলা হয়। পরে আদালত তাকে ৫৪ ধারায় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে শুক্রবার ২৩ আগস্ট রাত ১১টার দিকে অবৈধভাবে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিচারপতি মানিককে আটক করে বিজিবি। বিজিবির সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাবেক বিচারপতি মানিককে আদালতে তোলার সময় ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করেন উত্তেজিত জনতা। এসময় কয়েকজন হামলার চেষ্টাও চালান। তখন কয়েকজন তাকে মারতে তেড়ে যান। তবে পুলিশি নিরাপত্তার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে তাকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। ৪ টা ২০ মিনিটে বিচারক তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, সিলেটে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা হয়নি। বিজিবি মামলা করবে বললেও পরে তা করা হয়নি। পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে হাজির করে। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
বিজিবির ১৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসাদুন নবী বলেন, অবৈধভাবে ভারতে পালানোর সময় কানাইঘাটের দনা সীমান্ত থেকে আমরা তাকে আটক করেছি। উনাকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাবেক এই বিচারপতির আটক হওয়ার সময়ের কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। এক ভিডিওর কথোপকথনে জানা যায়, তিনি সীমান্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তিনি টাকাপয়সা, মোবাইল খুইয়েছেন, পাশাপাশি বিধ্বস্ত চেহারা এবং কাপড়চোপড়ের অবস্থায় মনে হয়েছে তিনি শিকার হয়েছেন মারধরেরও। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্যান্ট ও হাফ শার্ট পরিহিত সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক শুয়ে আছেন জঙ্গল এলাকায় কলাপাতার ওপর। তার কোলের কাছে একটি টুপি। মুখে কয়েক দিনের না কাটা দাড়ি। পাশে রয়েছে ছোট কয়েকটি পোটলা। ওই ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, আমি তোমাদের পয়সা দিয়ে দেব। ক্যামেরায় দেখা না যাওয়া একজনকে তখন বলতে শোনা যায়, আচ্ছা ঠিক আছে। বিচারপতি মানিক বলেন, এই পয়সা আমি দেব, আমার ভাইবোন দেবে না, আমি দেব। ওই ব্যক্তিকে তখন বলতে শোনা যায়, আমাদের পয়সার কোনো প্রয়োজন নাই, ঠিক আছে? আপনি যদি সেইফটি, মানে। মানিক তখন বলেন, ওই ফালতু লোক দুইটারে আইনো না। আমি এই দেশে (ভারত) এত কষ্ট কইরা আইছি কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য?
কথোপকথন সূত্রে ধারণা পাওয়া যায়, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকতে পেরেছিলেন। সেখানে তিনি লুটপাটের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিজিবির হাতে আটক হওয়ার পর।
বিজিবি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মানিকের গলায় একটি গামছা, যেটা ধরে রেখেছেন একজন বিজিবি সদস্য। তখন জানতে চাওয়া হয়, বাড়ি কোথায়? তিনি উত্তর দেন: বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেন: আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। বিজিবি সদস্য তাকে প্রশ্ন করেন, আপনে ইনডিয়া পালাইতাছেন কেন, বলেন। উত্তরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ভয়ে পালাইতেছি। কার ভয়ে, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রশাসনের ভয়ে।
আওয়ামী লীগের সরকার পতনের কয়েক দিন আগে চ্যানেল আইয়ের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে একজন সঞ্চালককে রাজাকারের বাচ্চা বলে সমালোচিত হন সাবেক বিচারপতি মানিক। সেই প্রসঙ্গ ধরে বিজিবি সদস্য প্রশ্ন করেন, ওই একটা মেয়েরে যে বলছিলেন ইয়ের বাচ্চা। মানিক তখন বলেন, ওইটা আমি ক্ষমাও চাইছি। এইযে দেখেন আমি বলি, আমি ইয়ের রোগী। বলতে বলতে নিচের শার্ট উপরে তুলে দেখাতে চান তিনি। পাশে থাকা বিজিবি সদস্য তখন বলেন, মিডিয়াতে তো খুব সুন্দর সুন্দর। এরপর শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আটক করার সময় তার সঙ্গে কী কী ছিল। উত্তরে তিনি বলেন, তার সাথে ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলা পাসপোর্ট, টাকা আর কয়েকটি ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, শুক্রবার আটক হওয়ার সময় ৪০ হাজার টাকা ছিল তার সঙ্গে। বিজিবি সদস্য তখন প্রশ্ন করেন, কালকে যে দুজন টাকা নিছে, ওদের কাছে কত টাকা ছিল? উত্তরে সাবেক বিচারপতি মানিক বলেন, ওরা নিছে ধরেন, ৬০, সত্তরের মত নিছে। বিজিবি সদস্য প্রশ্ন করেন, ষাট সত্তর লাখ? উত্তরে মানিক বলেন, “হ্যাঁ। তখন প্রশ্ন করা হয়, নৌকাওলা আর ওই দুজন নিছে? উত্তর আসে, না ওই দুই ছোকরা নিছে। বিজিবি সদস্য জানতে চান, উনাদের ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে? মানিক উত্তর দেন, না কিচ্ছু নাই, আমার ফোন নম্বর টোন নম্বর, সব নিয়ে গেছে। বিজিবি সদস্য প্রশ্ন করেন, আপনি কত টাকা চুক্তিতে আসছেন? উত্তরে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, আমি ১৫ হাজার টাকা ওদের বলছিলাম। ওইটা আমি দিছি। কিন্তু পরে এই দুই ছেলে আমারে মাইরা ধইরা সব টাকা নিয়ে গেছে।
পাশে থাকা আরেকজন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় প্রশ্ন করেন, মাইরটা কুনজাগাত মারছে ভাইয়া? বর্ডারে আনিয়া মারছে?” শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, না ভিতরে ইনডিয়ার ভিতরে। বিজিবি সদস্য প্রশ্ন করেন, আপনি তো বাংলাদেশে অনেকের বিরুদ্ধে অন্যায় করছেন, জুলুম করছেন, এইটা সঠিক? সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, আমি জুলুম করি নাই, আমি বিচারপতি হিসেবে যেগুলো রায় দেওয়ার আমি দিছি।
সম্প্রতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় মানিকের নামে নোয়াখালীর আদালতে মামলা হয়েছে। একই অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার ২২ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালতে আইনজীবী মো. জিয়াউল হক বাদী হয়ে আরেকটি মামলার আবেদন করেন। আদালত অভিযোগটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারপতি মানিক নানা বিতর্কিত মন্তব্য ও কর্মকাÐের কারণে আলোচিত-সমালোচিত। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে উপস্থাপিকার সঙ্গে অত্যন্ত বাজে আচরণ করে তিনি ব্যাপক আলোচনায় আসেন। পরে তিনি ওই উপস্থাপিকার কাছে লিখিত ক্ষমা চান।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেন সাবেক বিচারপতি মানিক। তিনি বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন পাকিস্তানের চর। জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পরিচয়ে মিথ্যাচারসহ কালিমা লেপনের হীন উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মানহানিকর বক্তব্য দেন তিনি। যা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। তার এমন মন্তব্যে জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের সম্মান ক্ষুণœ হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন জীবন শুরু করা এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হন। ২০০১ সালে তাকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক করে নেয় সরকার। কিন্তু পরে বিএনপি সরকার এসে তাকে বাদ দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর হাইকোর্টের একটি রায়ে বিচারকের আসনে ফেরেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ২০১৩ সালে তাকে পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগের বিচারক করা হয়। ২০১৫ সালে অবসরে যাওয়ার আগে তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে বার বার শিরোনাম হয়েছেন বিচারপতি মানিক। সে সময় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছিলেন। অবসরের পর তাকে নিয়মিত টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে দেখা যেত। বরাবরই তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন।