সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বজ্র নিরোধক যন্ত্রের তদারকি নেই

3

কাজির বাজার ডেস্ক
সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটনিং অ্যারেস্টার মেশিন) বসানো হয়েছে। তবে যন্ত্রটি কতটা বজ্রপাত নিরোধক তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরে যন্ত্রটি বসানোর পর আর কেউ খোঁজ নেননি। অন্যদিকে মৌসুম শুরুর পর থেকে প্রায়ই কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
বজ্রপাতের প্রবণতা ও মৃত্যুহার বিবেচনায় সরকার ২০১৬ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করে। এরপর দেশের বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলাকে চিহ্নিত করে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটনিং অ্যারেস্টার মেশিন) স্থাপন শুরু হয়। তামা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুর বৈদ্যুতিক রোধের মাত্রা অনেক কম। তাই এ ধরনের ধাতু দিয়ে বজ্র নিরোধক দÐ তৈরি করা হয়। এটি উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সহজে নিরাপদে মাটিতে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। ৩০-৪০ ফুট লম্বা দÐের তিন-চার ইঞ্চি জিআই পাইপ ও তামার তার থাকে। এছাড়া লাইটিং অ্যারেস্টার হচ্ছে একটি ডিভাইস, যা বসানো হয় বজ্র নিরোধক দÐের ওপর। এর মূল কাজ নির্ধারিত ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে নামিয়ে আনা। এতে মিটারের মতো কাউন্টার রয়েছে, কয়টি বজ্রপাত হলো তার হিসাবও সেখানে থাকে। সারাক্ষণই সক্রিয় থাকে এ যন্ত্র।
হবিগঞ্জ জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের সূত্রমতে, জেলায় চার বছরে বজ্রপাতে অর্ধশতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। প্রতি বছর প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে গড়ে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ জেলায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় বরাদ্দ দেয়া হয় ১৫ লাখ, নবীগঞ্জে ৩০, বানিয়াচংয়ে ৪৫, আজমিরীগঞ্জে ৩০, হবিগঞ্জ সদরে ১৫, লাখাইয়ে ২৫, শায়েস্তাগঞ্জে ১০, চুনারুঘাটে ১৫ ও মাধবপুরে ১৫ লাখ টাকা। ওই টাকা দিয়ে নয়টি উপজেলায় লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো ২০২৩ সালের বর্ষা মৌসুমের আগেই স্থাপন সম্পন্ন হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের বর্ষা মৌসুম শেষে চলতি বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও এর অগ্রগতি নিয়ে কোনো তথ্য নেই হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কাছে।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোছা. জিলুফা সুলতানা জানান, হাওরে লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন স্থাপনের বিষয়টি তার মোটেও জানা নেই। তিনি জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন। কিন্তু জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তার বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সুমি রানী বলকে কল করলেও রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে দেশের অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা সুনামগঞ্জে হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে গত বর্ষা মৌসুমের আগেই ১৮টি লাইটনিং অ্যারেস্টার মেশিন বসানো হয়। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু ছয়টি উপজেলায় স্থাপনের পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি। মেশিনগুলো কার্যকর আছে কিনা, সেটাও জানেন না জেলা দুর্যোগ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।
সুনামগঞ্জ জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের সূত্রমতে, ২০২৩ সালে জেলায় বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৩ জন। ২০২২ সালে প্রাণ হারান ২৪ জন। এর আগে ২০২১ ও ২০২২ সালে মৃত্যু হয় ১১ জন করে। ২০২০ সালে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। চলতি বছরে গত সোমবার পর্যন্ত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা দুর্যোগ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে ছয়টি উপজেলায় ১৮টি বজ্র নিরোধক মেশিন স্থাপন করা হয়। এর কার্যকারিতা কতটুকু সেটা তার জানা নেই। গত বর্ষা মৌসুম পাওয়ার পরও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেশিনে মিটারের মতো কাউন্টার রয়েছে, কয়টি বজ্রপাত হলো তার হিসাবও সেখানে থাকে। তবে যাওয়া হয়নি বলে কতটা বজ্রপাত প্রতিরোধ করতে পেরেছে তা জানা যায়নি।’
নেত্রকোনায় প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে শতাধিক জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বিশেষ করে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি। এসব এলাকায় মাঠে থাকা কৃষক, মাছ শিকারে থাকা জেলে, বাড়ি ফেরার পথে ও গোসল করার সময় বজ্রপাতে বেশি মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে এরই মধ্যে জেলা সদরে ২১ হাজার তালের চারা রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া ১০ উপজেলায় বজ্রপাত নিরোধক দÐ স্থাপন করা হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ৩ বছরে জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খালিয়াজুরী উপজেলার রাজঘাট হাওরে গত ৭ এপ্রিল কাজ করার সময় বজ্রপাতে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চলতি বছর এ জেলায় আরো একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে জেলে ও কৃষক, তাদের কাছে আমরা বজ্রপাতের পূর্বাভাস পৌঁছাতে পারছি না। তারাও নিশ্চয়ই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের কাজে বাইরে যাচ্ছেন এবং যাওয়ার পরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ জানান, বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি এমন স্থানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বজ্রপাত নিরোধক দÐ স্থাপন করা হয়েছে। তাল গাছের চারা রোপণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া হাওর এলাকার বিভিন্ন স্থানে হিজল গাছের চারা রোপণ করা হবে।