আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রæয়ারি

5

 

কাজির বাজার ডেস্ক

ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক ভাষার মাস ফেব্রæয়ারি তার যাত্রা শুরু করল। মাসটি আসলেই মনে পড়ে যায় কত ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং রক্তে পথ রঞ্জিত হওয়ার করুণ আখ্যান। আবার অনেক কিছু অর্জন করারও নতুন সম্ভাবনা। এই অনবদ্য যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক ছিল না। মায়ের ভাষাকে আপন শৌর্যে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে বীর বাঙালী বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিতও ছিল না। ভাষা যে কোন জাতির নিজস্ব বৈভব। প্রতিদিনের চর্চায় যা আরও মহীয়ান হয়ে ওঠে। আবহমান বাংলার চিরায়ত সম্পদ তার সমৃদ্ধ মাতৃভাষা। যুগ থেকে যুগান্তরের নানামাত্রিক সাংস্কৃতিক বোধে ভাষা নিজস্ব দ্যোতনায় জনগোষ্ঠীর জীবন ও মননে স্থায়ীভাবে আসন গাড়ে। বৈষয়িক সম্পদ আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে চিরায়ত বাংলা ছিল এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি। অবিভক্ত ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটাই অগ্রগামী সমৃদ্ধ বাংলা ভিনদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ, স্বদেশী কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি দ্যোতনার অনুষঙ্গ হয়েছে। বাংলা আপন ঐশ্বর্যে মহীয়ান, তার কর্তৃত্ব অনুপমই নয় এক অজেয়, অপ্রতিহত শক্তিময়তায় অভিষিক্তও। শুধু কি তাই? ধর্মের কঠিন নিগড় থেকেও অনেকটাই মুক্ত ছিল বলে রবীন্দ্রনাথের ধারণা। নদীমাতৃক বাংলার উর্বর পলিমাটি সামগ্রিক অবয়বে যে নমনীয়তা এবং কোমলতার স্পর্শ জাগায় তাও এই দেশকে নিজস্ব সম্ভারে সমুজ্জ্বল করে। সেই বাঙালী জাতি যখন ’৪৭-এর দেশ বিভাগকে কোনভাবে মেনে নেয়, সেখানে তার সাংস্কৃতিক বোধগুলো চিরস্থায়ী মর্যাদায় অটুট ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ কোনটাই চেতনাসমৃদ্ধ বাঙালীর জন্য কাক্সিক্ষত ছিল না। সেটা প্রমাণিত হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। বাংলা ও বাঙালীর জীবনে অপ্রাসঙ্গিক দেশভাগ এক কঠোর শৃঙ্খলের রূপ নিয়ে যে উন্মাদনার পরিবেশ তৈরি করে সেখানে বাঙালী দুর্বিনীত, দুর্দমনীয় প্রতিরোধে সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করতে পিছপা হয়নি। কট্টর এক শৃঙ্খলে সংগ্রাম করে সেখান থেকে বের হয়ে আসাও এক অপরিহার্য দাবি। উন্মুক্ত প্রতিরোধে তাজা রক্তে রঞ্জিত যাত্রাপথও বাঙালীকে তাড়িত করেছে। ১৯৪৮ সালে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন কায়েদে আযম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স তখন ২৮ বছর। যৌবনের স্বর্ণদ্বারে দাঁড়ানো এক টকবগে যুবক। স্বভাবসুলভ তর্জনী উঁচিয়ে প্রতিবাদে মুখর হলেন। উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন- না, বাংলাও হবে পাকিস্তানের আর একটি রাষ্ট্রভাষা। এর আগে নতুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সোচ্চার হন বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল হক এবং সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। সারা পাকিস্তানে মাতৃভাষার দিক থেকে এগিয়ে ছিল বাঙালীরা। সুতরাং বাংলা ভাষায় কথা বলার মানুষ যখন বেশি সেখানে উর্দুর পাশে ইংরেজী ভাষা বাদ দিয়ে বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা অধিক সঙ্গত বলে মনে করলেন বিশিষ্ট প-িত ও বিজ্ঞজনেরা। ড. শহীদুল্লাহ দাবি তুললেন- বাঙালীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সরকারী ভাষা অবশ্যই বাংলা ভাষা হবে। তবে উর্দুকে ২য় ভাষা হিসেবে রাখাও যৌক্তিক। সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দেশের দৃষ্টান্ত হাজির করে বললেন, এমন কয়েক দেশ আছে যেখানে একাধিক রাষ্ট্রভাষা চলমান। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে এসব প-িত আপোসহীন বাঙালী পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই জোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে অনেক ওজর-আপত্তির মধ্যেই জিন্নাহ তার অভিব্যক্তি ঘোষণা করলেন সরকারীভাবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ভাষার প্রশ্নে আপোসহীন লড়াই আর জাতির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এক ও অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর নিজের জবানীতে রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামী ইতিবৃত্ত যে মাত্রায় লিপিবদ্ধ আছে, সেখান থেকেই অনুমেয় ভাষার প্রশ্নে তাঁর দৃঢ়তা। সেটা নির্ভীক ও দুঃসাহসিক প্রতিবাদে জ্বলে উঠতেও সময় লাগেনি। ভাষার প্রশ্নে সেদিন জিন্নাহর মুখের ওপর বক্তব্য দিতে পারাটাও এক অজেয় ব্যক্তিত্বের অবধারিত স্ফুরণ। সেই শুরু বাঙালীর মুখের ভাষাকে নিয়ে টানাপোড়েন। যা পরবর্তীতে একুশে ফেব্রæয়ারির রক্ত রঞ্জিত স্রোতের মধ্যে একাকার হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর তখন ছাত্রজীবন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগেরও এক সক্রিয় কর্মী। সে সময়ের উদ্দীপ্ত ছাত্র নেতারা ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ফেব্রæয়ারি মাস তার আগমনী খবর জানান দিলে ভাষার মাসের যাত্রা শুরুর মধ্যেই অনিবার্যভাবে চলে আসে ভাষাকে নিয়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ক‚টকৌশল। আর ইতিহাসের যাত্রাপথকে বিচ্ছিন্ন রেখে আন্দোলন সংগ্রাম তার তাৎপর্য থেকে অনেকটা দূরে সরে যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন বাস্তব প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারা বাংলাদেশে সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা ছড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু নিজেই ফরিদপুর জেলায় দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যান। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ভোর থেকে শত শত ছাত্রকর্মী রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। তাদের ওপর পুলিশী আক্রমণ হতেও খুব বেশি দেরি হয়নি। পুলিশের লাঠিচার্জও সমান তালে চলতে থাকে। ছাত্রদের মিছিলে নিয়ন্ত্রণ আনতে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধুসহ পঁচাত্তর জনকে আটক করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। মাতৃভাষার দাবিতে বঙ্গবন্ধু প্রথম আটক হলেন আরও অনেকের সঙ্গে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপনে ভাষা আন্দোলনের আবেদন যুগান্তকারী। আর জাতির জনক সূচনালগ্ন থেকেই মাতৃভাষার লড়াইয়ে নিজেকে উজাড় করে দেন। ওই দিনের মধ্যে সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই শুরু ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক যাত্রাপথ। ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে তার দুরন্ত অভিযাত্রা দুঃসাহসিক মনোবলে গতিশীল হয়। যা ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরিতে অনবদ্য ভ‚মিকা রাখে। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক লড়াই বাঙালীর অংশগ্রহণে ভাষা আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। ২১ ফেব্রæয়ারিতে যখন বাংলা ভাষার দাবিতে ঢাকায় মিছিল বের হয় তখন বঙ্গবন্ধু আটক ছিলেন ফরিদপুর জেলে। সংগ্রামী চেতনায় দুঃসহ যাত্রাপথে জীবন কখনও সুস্থির আর নির্বিঘœ ছিল না। অস্বস্তিকর পরিবেশে জেলখানায় অসুস্থ হবার মতোই দুর্ভোগও পোহাতে হয়েছে। ফেব্রæয়ারি মাস প্রতি বছরই অনন্য আবেদনে বাঙালীকে তার অস্তিত্ব সঙ্কটের ঐতিহাসিক যাত্রাপথকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামটিও ওতপ্রোতভাবে জড়ানো থাকে। ফরিদপুরের কারা কক্ষে বসে বঙ্গবন্ধু অনুমান করতে পারছিলেন- ঢাকার রাজপথ পুলিশী হামলায় তছনছ হওয়ার উপক্রম। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তায় দিন পার করাও এক অসহনীয় যন্ত্রণা। কারা অন্তরীণে বেতারের মাধ্যমে সব খবরই জানতে পারলেন। মিছিলের ওপর পুলিশী আক্রমণে কয়েকজনের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে সমুন্নত রেখে পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু তখন জেলহাজতে অনশনব্রতে কোন কিছু মুখেই তুলছেন না। পরের দিন সংবাদপত্রের খবর হলো- পাকিস্তান সরকারের হঠকারিতা এবং অপরিণামদর্শিতায় কিভাবে ঢাকার রাজপথে রক্তগঙ্গা বইয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বিশ্ব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলার দামাল ছেলেরা ভাষার জন্য নিজের মূল্যবান প্রাণটুকু বিসর্জন দিতে কার্পণ্যও করেনি। ফেব্রæয়ারি মাস শুধু যে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক মাইলফলক তা কিন্তু নয়। বরং একুশের চেতনায় ‘অমর গ্রন্থমেলা’ শুরু করারও এক সম্ভাবনাময় শুভক্ষণ। কিন্তু করোনার সুতীব্র আঁচড়ে বইমেলা সময় মতো শুরু করাও এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি গ্রন্থমেলার আনুষ্ঠানিক পর্বটাই ছিল সর্বশেষ আয়োজন। মার্চ মাস থেকে করোনার মারাত্মক সংক্রমণে জনজীবনে যে অবরুদ্ধতার জাল বিস্তৃত হয় সেটা এখনও চলমান। করোনা কিছুটা নিম্নগামী হয়ে আবার মাথাচাড়া দিতে প্রবল বেগে ছুটে আসছে। এবারও আমাদের বহু কাক্সিক্ষত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রায় অনিশ্চিত। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী চত্বরে অমর একুশের বইমেলার যে আয়োজন সেটা শুরু করার কথা ১৫ ফেব্রæয়ারিতে। নতুন ওমিক্রন যে মাত্রায় তার দাপট অব্যাহত রেখেছে শেষ অবধি কি হবে বলা মুশকিল। তবে প্রকাশনা সংস্থার আর্থিক যোগসাজশের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। ২০২০-২১ সালে প্রকাশনা শিল্পের যে সঙ্কট দৃশ্যমান তাতে যে ক্ষতির মুখোমুখি সেটাও সার্বিক অর্থনীতির জন্য শুভযোগ নয়। সৃজন ও মনন চেতনায় যদি অবরুদ্ধতার জাল ঘনীভ‚ত হয়, তাহলে জ্ঞানচর্চার বিশাল পরিসরটিও তার মর্যাদা হারায়। আর যারা অগণিত পাঠক সারাবছর অপেক্ষা করে নতুন বই হাতে পাবার আকাক্সক্ষায় তাদের দুরবস্থাও উপেক্ষণীয় নয়।