শাবিতে আতঙ্কের আরেক নাম সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব

21

তুচ্ছ বিষয় গড়াচ্ছে সংঘর্ষে

শাদমান শাবাব, শাবি থেকে
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্ব যেন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর ফলে তুচ্ছ বিষয় রীতিমতো রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষ-সংঘাতে। এতে করে ‘সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্ব’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে এখন আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে এখন থেকেই উদ্যোগী না হলে ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে।
গত ১১ মে রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হলের সি-বøকের ২২৪ নম্বর কক্ষে আবাসিক হলে ভর্তি হওয়া নিয়ে শাবি শাখা ছাত্রলীগের একটি গ্রæপের নেতা ও ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আজিজুল ইসলাম সীমান্তের সঙ্গে তারই অনুসারী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রহমানের বাগবিতÐা হয়। এর জের ধরে রাতেই সীমান্তের বিরুদ্ধে হল প্রভোস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর অভিযোগ দেন মিজানুর। পরেরদিন ১২ মে সকালে ছাত্রলীগের ওই গ্রæপের সিনিয়র নেতারা বিষয়টির মীমাংসা করে দেন। ওই দিন দুপুরে শাহপরাণ হলের প্রভোস্ট তাদের দু’জনকে প্রভোস্ট কক্ষে ডাকেন। সেখানে দুই জনের সাথে কথা বলে অভিযোগের বিষয়টি পুনরায় মিটমাট করে দেন প্রভোস্ট। এরপরে প্রক্টর বরাবর দেওয়া পূর্বের অভিযোগটি তুলে নিয়েছেন জানিয়ে লিখিত দেন মিজানুর। পরে ১২ মে সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার আর মিজানুরের পাশাপাশি দাঁড়ানো ছবি দিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেন সীমান্ত। সেই পোস্টে দু’জনের মধ্যকার বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে জানিয়ে সীমান্ত লিখেন, ‘ভাই ভাইয়ের কাজ করেছে। কুকুরেরা কুকুরের কাজ করেছে।’
সীমান্তের দেওয়া এ পোস্টে কিছু ‘আপত্তিকর’ শব্দ আছে উল্লেখ করে গত শনিবার (১৩ মে) সন্ধ্যায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুডকোর্টে ডাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি গ্রæপের চারজন নেতা। তারা হচ্ছেনÑ সাবেক পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খলিলুর রহমান, সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক ও বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সজিবুর রহমান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সহসভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মামুন শাহ এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের যুগ্ম সম্পাদক ও লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমন মিয়া।
এ নিয়ে সীমান্তের সঙ্গে ওই চারটি গ্রæপের নেতাদের কথা-কাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে গত শনিবার দিবাগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হলে সীমান্তের সমর্থক ও বাকি চার গ্রæপের নেতাদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকে জিআই পাইপ হাতে মহড়া ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়তে দেখেন। পরে প্রক্টর ড. মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী ও শাহপরাণ হলের প্রভোস্ট মিজানুর রহমান খান এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারিতেও সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রæপের কর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নয়াবাজারে চায়ের দোকানের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসা নিয়ে শাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক খলিলুর রহমানের অনুসারী ও জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রব নাঈম ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক সুমন মিয়ার অনুসারী ইংরেজি বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রিশাদ ঠাকুরের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে রিশাদ ঠাকুরের নেতৃত্বে কয়েকজন নাঈমকে স্টাম্প দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। এতে নাঈমের মাথা ফেটে যায়।
এর আগে গত বছরের ১৪ অক্টোবরও সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে লঙ্কাকান্ড করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের অনুসারীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন দুপুরে সৈয়দ মুজতবা আলী হলের চতুর্থ তলার এক বাথরুমে যাওয়া নিয়ে শাবি ছাত্রলীগের সাবেক উপ-দপ্তর সম্পাদক সজিবুর রহমানের অনুসারী ও পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শিমুল মিয়ার সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সহ-সভাপতি মামুন শাহ’র অনুসারী ও বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুসলিম ভ‚ঁইয়ার তর্ক হয়। পরে দুই পক্ষের কর্মীরা হাতাহাতি ও ভাঙচুর চালায়। এসময় লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শোডাউনও করে দু’পক্ষের কর্মীরা।
সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্বকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের এমন সংঘর্ষ-সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের সকলের জন্য উদ্বেগের বলে জানিয়েছেন শাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ্ মোহাম্মদ আতিকুল হক। এই সমাজ বিশ্লেষকের মতে, বিভাগের শিক্ষকসহ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী হিসেবে দেশ ও জাতির জন্য তাদের যে একধরনের দায়বদ্ধতা আছে-সেই বার্তাটি শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিতে হবে।