ভয়াবহ ভূমিকম্প : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

46

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে ল-ব- হয়ে যায় কয়েক হাজার অবকাঠামো। তুরস্কের রাজধানী আম্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন ভূমিকম্পের ভয়াবহ বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ভোরে যখন ভূমিকম্প আঘাত হানে বাড়িতেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল এই কাঁপুনি কখনো থামবে না। তিনি বলেন, আমি আতঙ্কে শুধু পায়জামা পরে বের হয়েগিয়ে ছিলাম। আধা ঘণ্টা বৃষ্টির মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর কম্পন থামলে ঘরে গিয়ে কোট আর জুতা পরে নেন। তিনি বলেন, চোখের সামনে ভবনের জানালাগুলো সশব্দে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখেছি। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলি, তুমি কি কাঁপছ? তিনি বলেন, আমি ল্যাম্পের (বাতি) দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল ল্যাম্পটি ভেঙে যাচ্ছে। চোখের সামনে আফটার শকে একটি ভবনের জানালাগুলো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ভূমিকম্পে ওজগুলদের ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের আশপাশের পাঁচটি ভবন ধসে গেছে। সব লোক এখন রাস্তায় অবস্থান করছেন। তারা কী করবে, তা নিয়ে বিভ্রান্ত।
সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, ভূমিকম্পে তুরস্কের সাতটি প্রদেশের অন্তত দশটি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরগুলো হলো গাজিয়ান্তেপ, কাহরামানমারাস, হাতে, ওসমানিয়া, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানলিউরফা, দিয়ারবাকির এবং কিলিস। এছাড়া সিরিয়ার আলেপ্পো, হামা এবং লাকাতিয়া শহরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ভূমিকম্পে। এ পর্যন্ত তুরস্ক ও সিরিয়া আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।
মহান আল্লাহ তার বান্দাদের সতর্ক করেন যাতে করে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। কেন এত ভূমিকম্প সংগঠিত হয়? এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়- সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, এবং শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের, তাঁর পরিবারের উপর, তাঁর সাহাবাদের উপর এবং তাদের উপর যারা তাদের অনুসরণ করেন। মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, তাঁর ইচ্ছা এবং তিনি যা কিছু প্রেরণ করবেন সে সকল বিষয়ে তিনিই সবকিছু জানেন এবং তিনি সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সর্বাধিক অবহিত তাঁর আইন-কানুন ও আদেশ সম্পর্কে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের নিদর্শন সৃষ্টি করেন এবং বান্দার উপর প্রেরণ করেন যাতে করে তারা মহান আল্লাহ কর্তৃক তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও ভীত হয়। বান্দারা মহান আল্লাহর সাথে যা শিরক করে (অর্থাৎ, ইবাদত করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব করে) এবং তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি এই নিদর্শনসমূহ প্রেরণ করেন যাতে করে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাদের বোধোদয় হয় এবং তাদের রবের দিকেই একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করে।
মহান আল্লাহ বলেন : “(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই” (সূরা ইসরা : ৫৯) “অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দিবো), যতোক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই (কুরআনই মূলত) সত্য; একথা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার মালিক সবকিছু সম্পর্কে অবহিত?” (সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৫৩) “বল : আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।” (সূরা আল আনআম : ৬৫)
আল-বুখারী তার সহীহ বর্ণনায় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : যখন “তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে)” নাযিল হলো তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”, অথবা যখন, “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম” নাজিল হলো, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : “আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”। (সহীহ আল বুখারী, ৫/১৯৩) আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের তাফসিরে বর্ণনা করেন, “বল : আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে)” যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম”, যার ব্যাখ্যা হলো, ভূমিকম্প এবং ভূমি ধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া। নিঃসন্দেহে বর্তমানে যে সকল ভূমিকম্পগুলো ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাহদের ভয় দেখিয়ে থাকেন।
এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দুর্যোগগুলো সংগঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে; এই দুর্যোগগুলো আসার কারণ হচ্ছে, শিরকী কার্যকলাপ (ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেন : “(হে মানুষ) যে বিপদ-আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) মাফ করে দেন।” (সূরা আশ শূরা : ৩০) “যে কল্যাণই তুমি লাভ কর (না কেন, মনে রেখো), তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার উপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে”। (সূরা আন নিসা : ৭৯)
মহান আল্লাহ অতীত জাতির উপর প্রেরিত আজাব সম্পর্কে বলেন : “অতপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচ- ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচ- পাথরের বৃষ্টি) {যেভাবে লূত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে {যেভাবে শুআইব (আ.)-এর জাতির উপর আঘাত হেনেছিল}, কাউকে আমি জমিনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে কারুন জাতিদের উপর এসেছিল}, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ জাতী ও ফেরাউন ও তার লোকদেরকে যেভাবে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল}, (মূলত) আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর জুলুম করেছেন, জুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে”। (সূরা আল আনকাবূত : ৪০) এখন মুসলমানদের এবং অন্যান্যদের খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর নিকট তওবা করা উচিত, আল্লাহর কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব শিরকী কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন যেমন: (নামাজ পরিত্যাগ না করা, জাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ পান না করা, ব্যভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজসমূহ ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা। এটা হতে আসা করা যায়, তারা এই দুনিয়া ও পরবর্তীতে কঠিন আজাব থেকে মুক্তি পাবে এবং আল্লাহ তাদের আজাব থেকে নিরাপদে রাখবেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: “অথচ যদি সেই জনপদের মানুষগুলো (আল্লাহ তাআর উপর) ঈমান আনতো এবং (আল্লাহ তাআলাকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের উপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু (তা না করে) তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, সুতরাং তাদের কর্মকা-ের জন্য আমি তাদের ভীষণভাবে পাকড়াও করলাম”। (সূরা আল আ’রাফ : ৯৬) এবং আল্লাহ আহলে কিতাবধারীদের সম্পর্কে বলেন: “যদি তারা তাওরাত ও ইনজিল (তথা তার বিধান) প্রতিষ্ঠা করতো, আর যা তাদের উপর তাদের মালিকের কাছ থেকে এখন নাজিল করা হচ্ছে (কুরআন) তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো, তাহলে তারা অবশ্যই রিজিক পেতো তাদের মাথার উপরের (আসমান) থেকে ও তাদের পায়ের নীচের (জমিন) থেকে”। (সূরা আল মায়িদা : ৬৬) এবং আল্লাহ আরো বলেন : “(এ) লোকালয়ের মানুষগুলো কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে (তারা মনে করে নিয়েছে), আমার আজাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে!
ক’দিন পরপরই মৃদু কম্পনে সারাদেশ কম্পিত হয়ে উঠছে। এইতো গত ৪ জানুয়ারি ভোর ৫টা ৫ মিনিটের দিকেও ঢাকাসহ সারাদেশেই এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৬ দশমিক ৮ এবং উৎপত্তি স্থল ভারতের মনিপুর। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সারাদেশের মানুষ। ঘুম থেকে ভূকম্পন অনুভূত হবার পর লোকজন দিগ¦বিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। রাজধানীবাসীর বেশিরভাগই বাসার ছাদে কিংবা রাস্তায় নেমে যায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে। সিদ্ধার্থ সিধু নামে এক সাংবাদিক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘পুরো ভবনটাই কাঁপছিল, ভয়াবহ এক অনুভূতি’। প্রথমে মনে করেছিলাম আমি নিজেই মনে হয় পা নাড়াচ্ছি। কিন্তু ক্রমশ কম্পন এতো বেশি হতে লাগলো যে, আশপাশে মানুষ চিৎকার করা শুরু করেছে। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো বড় একটা কম্পন আসার আগে সতর্ককারী কম্পন।
মহান আল্লাহ তার বান্দাদের সতর্ক করেন যাতে করে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। কেন এত ভূমিকম্প সংগঠিত হয়? এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়- সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, এবং শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের, তাঁর পরিবারের উপর, তাঁর সাহাবাদের উপর এবং তাদের উপর যারা তাদের অনুসরণ করেন। মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, তাঁর ইচ্ছা এবং তিনি যা কিছু প্রেরণ করবেন সে সকল বিষয়ে তিনিই সবকিছু জানেন এবং তিনি সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সর্বাধিক অবহিত তাঁর আইন-কানুন ও আদেশ সম্পর্কে।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের নিদর্শন সৃষ্টি করেন এবং বান্দার উপর প্রেরণ করেন যাতে করে তারা মহান আল্লাহ কর্তৃক তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও ভীত হয়। বান্দারা মহান আল্লাহর সাথে যা শিরক করে (অর্থাৎ, ইবাদত করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব করে) এবং তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি এই নিদর্শনসমূহ প্রেরণ করেন যাতে করে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাদের বোধোদয় হয় এবং তাদের রবের দিকেই একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করে।
মহান আল্লাহ বলেন : “(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই” (সূরা ইসরা : ৫৯) “অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দিবো), যতোক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই (কুরআনই মূলত) সত্য; একথা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার মালিক সবকিছু সম্পর্কে অবহিত?” (সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৫৩) “বল : আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।” (সূরা আল আনআম : ৬৫)
আল-বুখারী তার সহীহ বর্ণনায় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : যখন “তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে)” নাযিল হলো তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”, অথবা যখন, “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম” নাজিল হলো, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : “আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”। (সহীহ আল বুখারী, ৫/১৯৩)
আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের তাফসিরে বর্ণনা করেন, “বল : আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে)” যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম”, যার ব্যাখ্যা হলো, ভূমিকম্প এবং ভূমি ধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া। নিঃসন্দেহে বর্তমানে যে সকল ভূমিকম্পগুলো ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাহদের ভয় দেখিয়ে থাকেন।
এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দুর্যোগগুলো সংগঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে; এই দুর্যোগগুলো আসার কারণ হচ্ছে, শিরকী কার্যকলাপ (ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেন : “(হে মানুষ) যে বিপদ-আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) মাফ করে দেন।” (সূরা আশ শূরা : ৩০) “যে কল্যাণই তুমি লাভ কর (না কেন, মনে রেখো), তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার উপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে”। (সূরা আন নিসা : ৭৯)
মহান আল্লাহ অতীত জাতির উপর প্রেরিত আজাব সম্পর্কে বলেন : “অতপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচ- ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচ- পাথরের বৃষ্টি) {যেভাবে লূত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে {যেভাবে শুআইব (আ.)-এর জাতির উপর আঘাত হেনেছিল}, কাউকে আমি জমিনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে কারুন জাতিদের উপর এসেছিল}, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ জাতী ও ফেরাউন ও তার লোকদেরকে যেভাবে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল}, (মূলত) আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর জুলুম করেছেন, জুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে”। (সূরা আল আনকাবূত : ৪০) এখন মুসলমানদের এবং অন্যান্যদের খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর নিকট তওবা করা উচিত, আল্লাহর কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে
দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব শিরকী কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন যেমন: (নামাজ পরিত্যাগ না করা, জাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ পান না করা, ব্যভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজসমূহ ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা। এটা হতে আসা করা যায়, তারা এই দুনিয়া ও পরবর্তীতে কঠিন আজাব থেকে মুক্তি পাবে এবং আল্লাহ তাদের আজাব থেকে নিরাপদে রাখবেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: “অথচ যদি সেই জনপদের মানুষগুলো (আল্লাহ তাআর উপর) ঈমান আনতো এবং (আল্লাহ তাআলাকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের উপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু (তা না করে) তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, সুতরাং তাদের কর্মকা-ের জন্য আমি তাদের ভীষণভাবে পাকড়াও করলাম”। (সূরা আল আ’রাফ : ৯৬) এবং আল্লাহ আহলে কিতাবধারীদের সম্পর্কে বলেন: “যদি তারা তাওরাত ও ইনজিল (তথা তার বিধান) প্রতিষ্ঠা করতো, আর যা তাদের উপর তাদের মালিকের কাছ থেকে এখন নাজিল করা হচ্ছে (কুরআন)
তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো, তাহলে তারা অবশ্যই রিজিক পেতো তাদের মাথার উপরের (আসমান) থেকে ও তাদের পায়ের নীচের (জমিন) থেকে”। (সূরা আল মায়িদা : ৬৬) এবং আল্লাহ আরো বলেন : “(এ) লোকালয়ের মানুষগুলো কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে (তারা মনে করে নিয়েছে), আমার আজাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে!
অথবা জনপদের মানুষগুলো কি নির্ভয় হয়ে ধরে নিয়েছে যে, আমার আযাব তাদের উপর মধ্য দিনে এসে পড়বে না- তখন তারা খেল-তামাশায় মত্ত থাকবে। কিংবা তারা কি আল্লাহ তাআলার কলাকৌশল থেকেও নির্ভয় হয়ে গেছে, অথচ আল্লাহ তাআলার কলাকৌশল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত জাতি ছাড়া অন্য কেউই নিশ্চিত হতে পারে না।” (সূরা আল আ’রাফ : ৯৭-৯৯) আল-আল্লামা ইবনে আল-কাইউম (রহ.) বলেন : “মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়; এইটা মানুষগুলোকে ভীত করে, তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম করা ছেড়ে দেয়, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়”।
আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলতেন: “মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সতর্ক করছেন”। মদীনায় যখন একবার ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তার জনগণকে ভাষণে বললেন : “যদি আরো একবার ভূমিকম্প সংগঠিত হয় তাহলে আমি এখানে তোমাদের সাথে থাকবো না।” সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকদের কাছে এরকম আরো অনেক ঘটনার বিবরণ রয়েছে। যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তাওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং মা প্রার্থনা করা যেভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন: “যদি তুমি এরকম কিছ দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট মা প্রার্থনা কর।” (আল-বুখারী ২/৩০ এবং মুসলিম ২/৬২৮) দরিদ্র ও মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের দান করা উচিত, কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “দয়া প্রদর্শন কর, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে”। (ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, ২/১৬৫) “যারা দয়া প্রদর্শন করে মহান দয়াশীল আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া দেখাবেন। পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর, এবং স্বর্গে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন।” (আবু দাউদ কতৃক বর্ণিত ১৩/২৮৫, আত-তিরমিজী : ৬/৪৩) “যারা দয়া প্রদর্শন করবে না তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে না”। (আল-বুখারী : ৫/৭৫, মুসলিম ৪/১৮০৯ কর্তৃক বর্ণিত) বর্ণিত আছে যে, যখন কোন ভূমিকম্প সংগঠিত হতো, উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রহ.) তার গভর্নরদের দান করার কথা লিখে চিঠি লিখতেন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা মানুষকে বিপর্যয় (আজাব) থেকে নিরাপদে রাখবে তাহলো, যারা মতায় আছে (অর্থাৎ যারা দেশ পরিচালনা করছে) তাদের উচিত দ্রুততার সাথে সমাজে প্রচলিত অন্যায় থামিয়ে দেয়া, তাদের শরিয়া আইন মেনে চলতে বাধ্য করা এবং সে অনুযায়ী চলা, ভালো কাজের আদেশ দেয়া এবং খারাপ কাজ নিষেধ করা।
মহান আল্লাহ বলেন : “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা হচ্ছে একে অপরের বন্ধু। এরা (মানুষদের) ন্যায় কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, (জীবনের সব কাজে) আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের (বিধানের) অনুসরণ করে, এরাই হচ্ছে সে সব মানুষ; যাদের উপর আল্লাহ তাআলা অচিরেই দয়া করবেন; অবশ্যই আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী, কুশলী।” (সূরা আত তাওবা : ৭১) “আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন যে আল্লাহ তাআলার (দ্বীনে) সাহায্য করে, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। আমি যদি (মুসলমান) এদের (আমার) জমিনে (রাজনৈতিক) প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহলে তারা (প্রথমে) নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, (দ্বিতীয়ত) জাকাত আদায় (এর ব্যবস্থা) করবে, আর (নাগরিকদের) তারা সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে, তবে সব কাজেরই চূড়ান্ত পরিণতি একান্তভাবে আল্লাহ তাআলারই এখতিয়ারভুক্ত।” (সূরা আল হজ্ব : ৪০-৪১) “যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে (সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার) একটা পথ তৈরি করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন রিজিক দান করেন যার (উৎস) সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই; যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।” (সূরা আত তালাক্ব : ২-৩) এই বিষয়ে এরকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন : “যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দিবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন।” (আল-বুখারী ৩/৯৮, মুসলিম ৪/১৯৯৬) এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “যে ব্যক্তি, এই পৃথিবীতে একজন বিশ্বাসীর দুশ্চিন্তা দূর করে দিবে, মহান আল্লাহ তাকে পুনরুত্থান দিবসের দুশ্চিন্তা থেকে নিরাপদে রাখবেন। যে ব্যক্তি, কারো কাজকে সহজ করে দিবে (যে কঠিন কাজে নিয়োজিত), মহান আল্লাহ তার দুনিয়া ও পরকালের কাজকে সহজ করে দিবেন। যে ব্যক্তি, একজন মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে মহান আল্লাহ দুনিয়া ও পরকালে তার দোষ গোপন রাখবেন।