সড়ক দুর্ঘটনা রোধ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

12

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
২য় প্রকাশ, ১৩৯১হি.), খ.৩.পৃ.২৭৭”
খতবী শীরনীনী (মৃ. ৯৭৭হি) বলেন, কোচোয়ান এমন কাজ করবে না যা করা তার জন্যে অস্বাভাবিক বলে গণ্য হবে। যেমন কাদার মাঝে তীব্র গতিতে গাড়ি চালানো। ড্রাইভার নিয়মের ব্যত্যয় করার কারণে যদি কারো ক্ষতি হয় তবে ড্রাইভার ক্ষতিপূরণ দেবে। জনসমাবেশে তীব্র গতিতে গাড়ি হাঁকানো কাদার মাঝে তীব্রগতিতে গাড়ি চালানোর মতই। “মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ খতীব শীরবীনী, মুগনী মুহতাজ (বৈরুপ: দারুল মা‘রিফা ১৪১৮হি.) খ.৪.পৃ.২৭০-২৭১”।
সিগন্যাল অমান্য করা : কোন সন্দেহ নেই, রাস্তায় সিগন্যাল রাখা হয় ক্রসিং পয়েন্টে রাস্তা পরিবর্তন করার সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্যেই। এই সিগন্যাল দেখে চালক বুঝবে, কখন সে চলবে আর কখন সে থেমে থাকবে। সিগন্যাল এড়িয়ে যাওয়া ট্রাফিক আইনের মারাত্মক লঙ্গন। কারণ সাধারণ সিগন্যাল অমান্য করা হয় অন্যদের চলা শুরু হওয়ার আগ দ্রুত অতিক্রম করার জন্যে। আর এর অবস্থাতে অন্যপাশ থেকে সবুজ সিগন্যাল পাওয়ার কারণে হঠাৎ কেউ বা কোন গাড়ি অতিক্রম করতে চাইলে অন্য পাশের মানুষ বা গাড়ি সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়।
সিগন্যাল অমান্য করার বিষয়ে শায়খ ইবনু উছাইমীন (রহ.) বলেন “সিগন্যাল অমান্য করা জায়েয নেই। শাসকশ্রেণী যদি কোন সংকেত নির্ধারণ করে চালককে থামতে বলে, আর কোন কোন সংকেত চালককে চলতে বলে, তাহলে এই সংকেতগুলো শাসকের পক্ষ থেকে মৌখিক নির্দেশের মত। যেন শাসক তাকে বলছে, চলো বা থেমে যাও। আর শাসকের নির্দেম মানা আবশ্যক। অন্য লেনগুলো ফাঁকা থাকুক বা অন্য লেনে এমন কেউ থাকুক যার জন্যে লেন ফাঁকাা রাখা দরকার, উভয় অবস্থায় বিধান অভিন্ন। “ইবনু উছাইমীন, ফাতাওয়া ও তাওজীহাত ফীল ওয়ার রিহলাত, পৃ.৮০।”
অননুমোদিত স্থানে গাড়ি দাঁড় করানো ঃ দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ, অননুমোদিত স্থানে গাড়ি দাঁড় করানো। যার ফলে চলাচলের রাস্তা বন্ধা হয় অথবা অন্যের উপকার নষ্ট হয় অথবা কোন গাড়ির সামনে দাঁড়ানো, যার ফলে অন্য গাড়িটি বের হতে হলে তার সরে যাওয়ার অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়। নি:সন্দেহে এমনটি করা বিধেয় নয়। পরিস্থিতি, বাস্তবতা ও কষ্টের বিবেচনায় এ আচরণের গোনাহে পার্থক্য হবে।
এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, হজ্জের সময়ে ভীড়ে অন্যদের কষ্ট না দেয়ার দিকে খেয়াল করে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন না করে দূর থেকে ঈশারা করার নির্দেশ দেয় হয়েছে। অথচ বাইতুল্লাহ তাওয়াফের সুন্নত আমল এই চুম্বন। সুতরাং কোন অননুমোদিত বিষয়ে কীভাবে অন্যকে কষ্ট দেয়া জায়েয হতে পারে?
অন্যান্য কারণ : দুর্ঘটনার ঘটার এছাড়া আরো কারণ রয়েছে, যেগুলো থেকে সর্তক হওয়া প্রয়োজন। যেমন তন্দ্রা, খেলনার ছলে “এর আরবী ভাষা তাফহীত। এটি নবআবিষ্কৃত বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। এর অর্থ গাড়িকে অবহেলা ভরে চালানো, যা বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন কোন কোন যুবক করে থাকে। ইঞ্জিনে এমনভাবে চাপ দিয়ে রাখে, যে কারণে গাড়ি দ্রুত গতিতে চলতে থাকে, আর গতি থাকে এ পর্যায়ে যে, সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে তা থেকে কর্কশ আওয়াজ বের হয় এবং মাটির সাথে তীব্রভাবে ঘর্ষন খায় ও এটি তীব্র গতিতে অন্যান্য গাড়ির দিকে ছুটে যেতে থাকে।” অবহেলার সাথে গাড়ি চালানো এবং গাড়ির ফিটনেসের প্রতি যতœ না নেয়া, বিশেষত গাড়ির ব্রেক ইত্যাদি। এ সবগুলোর প্রত্যেকটিই নির্মম দুর্ঘটনার ঘটার কারণ হয়ে থাকে, যার ফলে বিপুল জানমালের ক্ষতি হয়। এ কারণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা চালকের কর্তব্য। এগুলো এড়িয়ে না চললে এর দায় ও গোনাহ চালককেই বহন করতে হবে, যেহেতু তার অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণেই দূর্ঘটনা ঘটেছে।
ক্ষতির দায় বহন : ড্রাইভিং থেকে সৃষ্ট সড়ক দুর্ঘটনার দায় বহন সংক্রান্ত আলোচনার পূর্বে ইসলামে দৃষ্টিতে অন্যের ক্ষতি করার বিধান ও এ বিষয়ক মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। মহান আল্লাহ মাবন জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি বলে: “আর আমি বনী আদমকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে উত্তম রিযক দিয়েছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি এমন অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি”। “আল কুরআন, ১৭:৭০”
এ আয়াতে বর্ণিত পরিভাষা মানুষকে সম্মানিত করার অর্থ হলো, মানুষের জন্যে আল্লাহ এমন বিধান দিয়েছেন, যা তার জীবন ও প্রাণ রক্ষা করবে। পাশাপাশি তার সম্পদ রক্ষা করবে, যেহেতু সম্পদ মানুষের জীবন নির্বাহের মাধ্যম। তদ্রুপ জীবন ও সম্পদে যে কোন অন্যায় হস্তক্ষেপকে অপরাধরুপে গণ্য করেছেন, যা আখেরাতে শাস্তি আর দুনিয়াতে ও বিভিন্ন প্রকার সাজা ও ক্ষতিপূরণ আবশ্যক করে। “ড. আব্দুল আযীয উমর আল খতীব, “মাসউলিয়্যাতু সাই‘কিস সাইয়্যারা ফী দুইল ফিকহিল ইসলামী” মাজাল্লাগু আল আদল, আইন মন্ত্রণালয়, সৌদি আরব, সংখ্যা ৩২, রজব ১৪২৭ হি.পৃ.১৫৩”।
এমন কোন প্রাণ বা সম্পদ নেই, ইসলামে যার কোন মূল্য নেই বা যা নষ্ট হলে কারো কোন দায় নেই এবং কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এ কারণেই দুটি বিষয়ের সংরক্ষনকে ইসলাম মৌলিক পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেগুলো সংরক্ষন শরীআহর উদ্দেশ্য তথা মাকাসিদুশ শরীআহ হিসেবে গণ্য। “আশশাতিবী, আল মুওয়াফাকাত (কায়রো: দারুল হাদীস, ২০০৬ খ্রি.) খ.পৃ. ১০”। ক্ষতির বিনিময় প্রদানের আওতায় প্রাণহানির ক্ষতির বিনিময়ও অন্তর্ভুক্ত। যার কিছু নির্ধারিত যেমন দিয়াত (প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ) কিছু অনির্ধারিত যেমন আরশ “শব্দটি এর বহুবচন। অর্থ জখমের দিয়্যাত (আহমদ আল-ফাইয়ূমী, আল-মিসবাহুল মুনীর (বৈরুপ: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাাহ, ১৪১৪ হি.), মাদ্দা: আরশ)”। (অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিপূরন)। এ ছাড়া বিভিন্ন বস্তু ক্ষতিগ্রস্থ হলে এর বদলা যা হবে তা ও এর অর্ন্তভূক্ত। “ফায়যুল্লাহ, নায়ারিয়্যাতুযযামান, পৃ.১৪”।
সুতরাং অন্যের জানমালে যে কোন ক্ষতি সাধন হারাম ও তার ক্ষতিপূরন আবশ্যক হওয়া কুরআন ও হদীসের বিভিন্ন নস দ্বারা সাব্যস্ত দীনের একটি মূলনীতি। হাদীস ও ফিকহের ইমামগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, শরীআহে মানুষের জানমাল সম্মানিত। মানুষের জানমালের ক্ষেত্রে মূলবিধান হলে এগুলোর ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ। আর ন্যায়সঙ্গত কোন কারণ ছাড়া কারো প্রাণ ও সম্পদ অন্যের জন্যে হালাল নয়। “ইবন কুদামাহ, আল মুগনী, খ.৭.পৃ.৩৬০ও খ.১১.পৃ.৪৪৩; আবু আবদুর রহমান দিমাশকী, রহমাতুল উম্মাহ ফী ইখতিলাফিল আইম্মা (বৈরুপ: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ ১৪০৭হি.) পৃ.১৭৩।”
এ সম্পর্কিত কিছু ফিকহী মূলনীতি ও তার ব্যাখ্যা নিম্নে দেওয়া হলো: কারো ক্ষতি করা যাবে না এবং কারও ক্ষতির অনুরুপ বদলাও গ্রহন করা যাবে না’। “এ মূলনীতিটি একটি হাদীছে উদ্ধৃত হয়েছে। দ্রষ্টব্য: মুহাম্মদ ইবন ইয়াযীদ ইবন মাযাহ, আসসুনান (ইস্তম্বুল : আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, সনবিহনি) বাবু মান বানা ফী হাক্কিহি মা ইয়াদুররু বিজারিহি, খ.২.পৃ.৭৮৪, হাদীস নং ২৩৪০ ও ২৩৪১।” মূলনীতিতে বর্ণিত শব্দদুটির মধ্যে অর্থগত ব্যবধান কী তা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন “অন্যের ক্ষতি করা” আর (যের দিয়ে) অর্থও অন্যের ক্ষতি করা। সুতরাং দ্বিতীয় শব্দ প্রথম শব্দকে কেবল অর্থগত দৃঢ়তা দান করছে। তবে এ বিষয়ক মতসমূহের মধ্যে উত্তম মত হলো ‘অন্যের যেকোন ক্ষতি সাধন করা’। আর প্রতিশোধ হলো ও বদলা হিসেবে অন্যের ক্ষতিসাধন। “ইবনুল আছীর, আন নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীস (বৈরুপ: দারুল ফিকর, সনবিহীন), খ.৩.পৃ.৮১; ইবন মানযুর লিসানুল আরব (বৈরুপ: দারু সাদির ১৪১০হি.) খ…পৃ…: মাদ্দাহ (যারার)।”
এ মূলনীতি ইঙ্গি করে, কোন ক্ষতির বদলা হিসেবে অনুরুপ ক্ষতিসাধন শরীআহর দৃষ্টিতে কাম্য নয়। (তবে কিসাস বা এ জাতীয় বিধান এই মূলনীতির আওতাভুক্ত নয়)। বরং যার ক্ষতি হয়েছে তার কর্তব্য হল ক্ষমা করা অথবা ক্ষতির বিনিময় গ্রহন করা। সুতরাং ইচ্ছাকৃত ভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো গাড়ি যদি অন্যের গাড়ির ক্ষতিসাধন করে সে অবস্থায় অপর গাড়িকে আঘাত করার অধিকার এ গাড়ির মালিকের নেই। বরং তার কর্তব্য হলো ক্ষমা করা অথবা নিজ গাড়ি আগের অবস্থায় চলে আসা পরিমান ক্ষতিপূরণ আদায় করা।
ফকীহদের সর্বসম্মতিক্রমে এ মূলনীতি এমন সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যেখানে শরীআহ ক্ষতির বদলা হিসেবে ক্ষতি করার অনুমতি দেয়নি। সুতরাং কিসাস, হদ্দ ও তাযীর ও মূলনীতির আওতাভুক্ত নয়। এ গুলোতে যদিও বাহ্যিক ক্ষতি হয়েছে; কিন্তু সমাজের নিরাপত্তা বিধানে স্বার্থে ও জনমালের অধিকার রক্ষার্থে এগুলোকে কার্যকর করাই শরীআহর কাম্য। তাছাড়া উপকার সাধনের তুলনায় ক্ষতিরোধ করার বিষয়টি অগ্রগণ্য। উপরন্ত, ক্ষতিরোধ করার স্বার্থেই শরীআহ দন্ডগুলো অনুমোদন করেছে। “শায়খ আহমদ যারকা, শরহুল কাওয়াঈদিল ফিকহিয়্যাহ (বৈরুপ: দারুল গারব আল ইসলামী ১৪০৩হি.)পৃ.১১৩।” ক্ষতি দূর করা আবশ্যক ঃ “আবদুর রহমান আসসুয়ূতী, আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর ফী ফুরুয়িশ শাফিঈয়্যাহ (কায়রো: মাকতাবাতু মুস্তফা আল বাবী আল হালাবী ১৩৭৮ হি.), পৃ.৮৩.ইবনু নুজাইম, আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর (বৈরুপ: আল-মাকতাবাতুল আসবিয়্যাহ ১৯৯৮ খ্রি.), পৃ.১০৫।
এটি অতীব তাৎপর্যবহুল একটি মূলনীতি। কেননা ফিকহের এমন প্রতিটি অধ্যায়েই এটি প্রযোজ্য, যেখানে নিশ্চিত বা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে এমন ক্ষতি দূর করার বিষয় রয়েছে। এ মূলনীতি অনুসারে সে ক্ষতি দূর করা এবং ক্ষতি হয়ে গেলে ক্ষতির প্রভাব দূর করে বস্তুকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা আবশ্যক। যেমন সর্ব সাধারণের চলার পথে যদি কেউ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে, যার কারণে চলমান গাড়ি অথবা চলাচলকারী পথিকের কষ্ট হয়, তবে দুর্ঘটনার আশংকা দূর করার নিমিত্তে গাড়ি দাঁড় করে রাখার অনুমতি দেয়া হবে না।
এ থেকে ফকীহগণ বলেছেন, সর্বসাধারণের চলার পথের দিকে কেউ বৃষ্টির নালা উন্মুক্ত করে রাখে অথবা পথের অন্যায় ব্যবহার করে উঁচু কোন স্থান নির্মাণ করে, যার ফলে পথচারীদের চলতে কষ্ট হয়, তাহলে বৃষ্টির নালা বা উঁচু স্থান নির্মাাণের অনুমতি দেয়া হবে না। আর যদি নির্মান করে ফেলে তাহলে অন্যদের ক্ষতি রোধ করার স্বার্থে নির্মিত উঁচু স্থান বা নালা ভেঙ্গে ফেলা হবে। বরং এই নির্মানের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মালিক ক্ষতিপূরণ দেবে। “ইবনুল আবিদীন, আদ দুররুল মুখতার, খ. ৬.পৃ.৫৯২; মুহাম্মদ বিন উরফাহ আদ দাসূকী, হাশীআহ আলা আশ শারহুল কাবীর (বৈরুপ: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ ১৪১৭ হি.) খ.৫, পৃ.৩৫; রামলী, নিহায়াতুল মুহতাজ, খ.৭.পৃ, ৩৫৭ ইবন কুদামাহ, আল মুগনী, খ.১২, পৃ.৯৮।”
ব্যক্তিগত অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ মূলনীতি প্রয়োগের নমুনা হলো, যদি কেউ গাড়ি দিয়ে কোন মানুষ বা বস্তুকে আঘাত করে যার ফলে কোন প্রাণ বা সম্পদের ক্ষতি হয়, তবে সে তার ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা এ ক্ষতির প্রভাব দূর করে তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা আবশ্যক। বদলা দেয়া ছাড়া ক্ষতি দূর করা সম্ভব নয়। ইসলামী ফিকহে কারো ক্ষতিসাধন সে তিন কারণের একটি, যেগুলোর কারণে ক্ষতিপূরণ দেয়া আবশ্যক হয়। “হায়দার, দুরারুল হুক্কাম, খ. ১, পৃ. ৩৭; ফায়যুল্লাহ, নাযাবিয়্যাতুয যামান, পৃৃ.১৯।”
রাস্তায় চলাচল করা বৈধ শর্ত হল যে ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব সেগুলো সংঘটনের আশংকামুক্ত থাকা। একাধিক ফকীহগ এ শব্দে এ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ক্ষতির সরাসরি সংঘটক দায় বহন করবে, যদিও সে অন্যায় না করে” কাছাকাছি শব্দে ফকীহগণ এ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তবে মূল বিষয়ে সকল ফকীহ একমত। “ইবনু আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.৬০৩;শিহাবুদ্দীন আহমাদ আল ক্বারাফী, আয যাখীরা (বৈরুত: দারুল গারব আল-ইসলামী, ১৯৯৪ খ্রি:) খ.পৃ.২৫৯; যারকা, শরহুল কাওয়াঈদিল ফিকহিয়্যাহ, পৃ.৩৮৫।”
এ মূলনীতি সমর্থনে মাজাল্লাতুল আহকামিল ‘আদলিয়্যা-র ৯২ নং ধারায় বলা হয়েছে; ক্ষতিকারক ক্ষতিপূরণ দেবে, যদি ও সে অন্যায় না করে। এখানে শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য অন্যায় ব্যবহার। এ ব্যাখ্যা করার কারণ হল, সম্পদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছা অনিচ্ছা সমান। পার্থক্য এই যে, অনিচ্ছায় ক্ষতি করলে এর কারণে গোনাহ হবে না। কিন্তু ক্ষতিপূরনের ক্ষেত্রে উভয় অবস্থা সমান। বর্ণিত আছে এক ব্যক্তি তিনজনকে বাগান খনন করার জন্যে মজদুর নিয়োগ করল। তখন তারা একসাথে দেয়ালের মুলভিতে আঘাত করল। এরপর দেয়াল ধ্বসে তাদের একজন মারা গেল। তারা কাযী শুরাইহ “নাম আবু উমাইয়্যা, শুরাইহ বিন হারিস বিন কায়স আল কিন্দী। পূর্বপুরুষ ইয়ামেনী বংশোদ্ভুত। ইসলামের প্রসিদ্ধ কাযীদের অন্যতম। ওমর ওসমান আলী ও মুআবিয়া রা. এর শাসনামলে পঁচাত্তর বছর মেয়াদে কুফার বিচারক ছিলেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। বিচারক হিসেবে দোষমুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ জীবন লাভ করেন এবং আটাশি হিজরীতে কুফায় মৃত্যুবরন করেন। (আবূ নু’আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া, খ.৪.পৃ.১৩২; ইবনুল ইমাদ, শাযারাতুয যাহাব (বৈরুত: দারু ইয়াহইয়াউত তুরাছিল আরাবী, সনবিহীন), খ.১, পৃ, ৮৫।” এর দরবারে মোকাদ্দমা নিয়ে গেল। তিনি অবশিষ্ট দুজনের দায়ে এক তৃতীয়াংশ করে দিয়াত ধার্য করলেন। “ইবনু আবী শায়বা, আল মুসান্নাফ ফীল আহাদীস ওয়াল আছার (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৬ খ্রি;), খ.৫, পৃ.৪৪৭হা. নং: ২৭৮৬৬।”
সুতরাং জন্তু বা বাহনের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি সাধনকারী নিঃশর্তভাবে ক্ষতিপূরণ বহন করবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি করুক বা অনিচ্ছায়, অন্যায়ভাবে চালাক বা যথাযথভাবে চালনা করুক- বিধান অভিন্ন। সুতরাং কেউ যদি কোন জন্তু বা বাহনের পিঠে বিভিন্ন জিনিষ বোঝাই করে সর্বসাধারনের বাজার অতিক্রম করে, সে সময় পিঠ থেকে কোন কিছু পড়ে কারো প্রাণহানি ঘটে বা কারো কোন সম্পদ নষ্ট হয়, তাহলে সে ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা সে ক্ষতির সংঘটক আর ক্ষতির দায়ভার বহন করে। যদি রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় বাহনের চাকা খুলে যায়, এরপর কাউকে বা কোন বস্তুতে আঘাত করে তাহলে সে ক্ষতিপূরণ দেবে। কেননা চাকা খুলে যাওয়া প্রমাণ করে, চালক মজবুতভাবে চাকা লাগায়নি। তাছাড়া সে ক্ষতির সংঘটক। আর সংঘটক নিঃশর্তভাবে ক্ষতিপূরণ বহন করে “ইবন আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, খ.পৃ.৬০৩;ফায়যুল্লাহ, নাযারিয়্যাতুয যামান, পৃ.১৮৪।
সরাসরি ক্ষতি সংঘটন ও সংঘটনের কারণ : ফকীহগণ সরাসরি সংঘটনের অর্থ এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, যে কাজ ও ক্ষতির মধ্যে অন্য কারো ইচ্ছাকৃত কোন কাজ সংঘটিত হয় না। “আল-হামুভী, গামযু উয়ূনিল বাছাইর [ইবনু নুজাইম কৃত আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর এর ভাষ্যগ্রন্থ], (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৯৮৫ খ্রি.) খ.১, পৃ, ৪৬৬; ক্বালয়ূবী ও আমীরা, আলা শরহুল মিনহাজ, খ.২, পৃ.২৮ ও খ.৪.পৃ.৯৮; শায়খ মুস্তাফা আহমদ যারকা, আল মাদখালুল ফিকহিয়্যুল আম, (দামিশক; দারুল ফিকর, ১৯৬৯ খ্রি.) খ.২, পৃ, ১০৪৪।” যদি ব্যক্তির কাজ ও ক্ষতি সংঘটনের মাঝে অন্য কারো কাজ অর্ন্তভুক্ত হয়ে যায়, তাহলে ঐ ব্যক্তির মাধ্যমে ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে বলা যাবে না। সুতরাং প্রথম ব্যক্তি তখন ক্ষতির দায় বহন করবে না। এর উদাহরণ হল, একজন গাড়ি চালিয়ে কারো গায়ে ঘষা দিলে লোক একপাশে পড়ে গেল। আরেকটি গাড়ি এসে তাকে পিষ্ট করলে লোকটি মারা গেল, এমতাবস্থায় প্রথম ব্যক্তির উপর হত্যার দায় বর্তাবে না বরং দ্বিতীয় জনের উপর হত্যার দায়ভার বর্তাবে। অথচ প্রথমজন এখানে হত্যার কার্যকারণ ঘটিয়েছে। কিন্তু ফকীহগণ বলেন, যখন কোন দুর্ঘটনায় দুজন একত্রিত হয়, যার একজন সরাসরি দুর্ঘটনা সংঘটন করে আর অপরজন ক্ষতি সংঘটনের কারণ হয়, তখন দুর্ঘটনার বিধান (অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ) আরোপিত হবে যে ক্ষতি সংঘটিত করেছে তার উপর। ক্ষতি সংগঠন ও ক্ষতির কারণের মাঝে পার্থক্য করা হলে ক্ষতি সংঘটনের ক্ষেত্রে কারণের ভূমিকা থাকে না, যেমনটা আমরা উদাহরণে আলোচনা করছি।
ক্ষতি সংঘটনের ক্ষেত্রে মুকাল্লাফ(প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন) হওয়া শর্ত নয়। সুতরাং যদি চালক অপ্রাপ্তবয়স্ক হয় আর যদি কোন প্রাণহানি ঘটায় বা সম্পদের ক্ষতি করে, তাহলে সে যা ক্ষতি করেছে তার দায় বহন করবে। কেননা ক্ষতির দায় বহন করার ক্ষেত্রে দায় বহন করার যোগ্যতা শর্ত নয়। বরং ক্ষরিত দায় বহন করার জন্যে তার বদলা আবশ্যক হওয়ার উপযোগিতা থাকাই যথেষ্ট। “যারকা, আল মাদখালুল ফিকহীয়্যুল ‘আম, খ.২, পৃ. ৭৪৪।” যুহরী ও কাতাদা রহ. এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও পাগলের ইচ্ছাকৃত হত্যার প্রতিবিধান হল দিয়্যাত (রক্তমূল্য)। “আব্দুর রাযযক আস সান’আনী, আল মুসান্নাফ (করাচী: আল মাজলিসুল ইলমী, ২য় সংস্করণ ১৪১৬ হি.) খ.১০, পৃ.৭০, হাদীছ নং ১৮৩৯১।” অর্থ্যাৎ তাদের থেকে কিসাস (জীবনের বিপরীতে জীবন) আদয় করা হবে না। বরং ভুলবশতকৃত হত্যার ন্যায় তাদের থেকে দিয়্যাত নেয়া হবে। তবে বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতিকে গভীরভাবে বিবেচনা ও পর্যবেক্ষণ করা উচিত যে, দূর্ঘটনা কারো সরাসরি হস্তক্ষেপ ঘটেছে না কোনো কারণবশত।