ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গি ছিনতাই, ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে জঙ্গিরা। এ সময় পুলিশ সদস্যদের চোখে ক্ষতিকর স্প্রে করে মোটরসাইকেলে করে পালায় তারা। তবে এমন ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ এর ২০ নভেম্বরের পার্থক্য প্রায় নয় বছর। তবে ঘটনা একই রকম।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত। দীর্ঘ সময় নিয়ে জেএমবি সদস্যরা ওই অপারেশনের ছক আঁকে। এজন্য জেএমবির শীর্ষ তিন নেতাকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার দিনকেই বেছে নেওয়া হয়।
৯ বছর পর, ২০ নভেম্বর ২০২২। অন্যান্য দিনের মতো ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। তবে বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আদালতের আশপাশে কিছু অপরিচিত লোকের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।
বেলা ১২টার দিকে একটি মামলায় শুনানি শেষে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়ার পথে দুই জঙ্গির সহযোগীরা দায়িত্বরত পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে, কিল-ঘুষি মেরে আনসার আল ইসলামের দুই সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর তারা একটি লাল রঙের মোটরসাইকেলে রায়সাহেব বাজার মোড়ের দিকে পালিয়ে যায়।
তবে পালাতে ব্যর্থ হয় দুজন। ওই দুই জঙ্গি হলেন মো. আরাফাত ও মো. সবুজ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে হাজির করে হাজতখানায় নেওয়ার সময় চারজনের মধ্যে দুজনকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, আসামিদের ছিনিয়ে নিতে আসা একজনের কাছে স্প্রে ছিল। স্প্রে ছিটানোর সময় চিৎকার শোনা যায়।
সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা যায়
জঙ্গিদের মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যাওয়ার দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পেয়েছে। এতে দেখা যায়, ১ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনের রায় সাহেব বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে লাল রঙের একটি মোটরসাইকেলে তিনজন পালিয়ে যান। তাদের পিছু পিছু আরও কয়েক যুবক দৌড়াচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের হাতে হেলমেট, দুজনের হাতে ব্যাগ ও দুজন খালি হাতে ছিলেন।
আইল্যান্ডে বেধে পড়ে যান পুলিশ সদস্যরা
আদালত প্রাঙ্গণে থাকা জাকির ফার্মেসীর মো. মাসুদ বলেন, ১২টার দিকের ঘটনা। আদালত থেকে চারজন দৌড়ে আদালতের গেট পার হয়ে সড়কের দিকে আসে। পুলিশ সদস্যরাও তাদের ধরতে পেছনে দৌড়াতে থাকেন। কিছু দূর যেয়ে আইল্যান্ডে বেধে পড়ে যান তারা। এরপর আসামিরা ১৫ নম্বর কারকুন বাড়ি লেন জামে মসজিদের সামনে চলে যান। আসামিদের সহযোগীদের মোটরসাইকেল মসজিদের সামনে ছিল। মসজিদের সামনে থেকে চারজন আসামির মধ্যে দুজনকে ধরে ফেলে পুলিশ।
তিনি বলেন, এ সময় আসামি ও পুলিশের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। আসামিরা পুলিশকে কিল-ঘুসি মারে।
আদালত প্রাঙ্গণের একটি গলির মুখে পান বিক্রি করছিলেন শিউলি বেগম নামে এক নারী। তিনি জানান, অনেক মানুষ একসঙ্গে দৌড়াতে দেখেছি। রাস্তায় তখন অনেক গাড়ি চলছিল। এ সময় আইল্যান্ডে বেধে পুলিশরা পড়ে গেলে আসামিরা দৌড়ে গলি দিয়ে চলে যায়।
১ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনের এডভোকেট মো. লুৎফর রহমানের চেম্বারের শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাব্বুল ইসলাম বলেন, আনুমানিক দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ করে দেখি কয়েকজন ছেলে দৌড়ে পালাচ্ছে। আমরা প্রথমে ভাবছি মোবাইল চুরি করে দৌড়াচ্ছে। পরে দেখি পেছনে পেছনে পুলিশ। তাদের মধ্যে এক পুলিশের মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
ছিটানো হয় পিপার স্প্রে
আদালত প্রাঙ্গণে দায়িত্বরত পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্যান্য দিনের মতো আজকেও ডিউটিরত ছিলাম। হঠাৎ পিপার স্প্রে ছিটানোর পরে চারদিকে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, আদালতের শুনানি শেষে প্রথমে চারজনকে নিচে নামিয়ে আনা হয়। দুটি হাতকড়া দিয়ে দুজনকে আটকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাকি আসামিরা তখন উপরে ছিল।
তিনি বলেন, চারজনের মধ্যে মইনুল হাসান ও আবু সিদ্দিককে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তবে মো. আরাফাত ও মো. সবুজকে নিতে পারেনি।
আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
জঙ্গিদের আদালতে আনার দিন নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।
আদালতের নিরাপত্তার ঘাটতি আছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে পারবে। তবে অবশ্যই নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার হওয়া উচিত ছিল। তাদের কীভাবে নামিয়ে আনা হয়েছিল তা জানি না।
আদালত এলাকা পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়েছি। আমাদের ডিবির প্রত্যেকটা টিম কাজ করছে। আশা করছি তাদের (পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি) দ্রুত গ্রেফতার করতে পারবো।
‘জঙ্গিরা বিভিন্ন কৌশল নিয়ে কাজ করে। এবার তারা নতুন একটি কৌশল নিয়েছে। আমরা শুনেছি আদালতের গেটে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের চোখে স্প্রে করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে অপর জঙ্গিরা। চোখে স্প্রে করার কারণে দায়িত্বরতরা কিছু দেখতে পারেননি।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।
কারও গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা
আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় কারও গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
তিনি বলেন, বিচারের মাধ্যমে দুই জঙ্গির ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ দুজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তাদের আনা হয়েছিল, কোর্ট হাজতে তাদের রাখা হয়েছে, তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে প্রডিউস করার পর আবার নির্দিষ্ট রুমে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা জানলাম যে পুলিশরা তাদের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ওপর কেমিক্যাল ছুড়ে, অজ্ঞান করে কয়েকজন তাদের সমর্থকদের নিয়ে পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা রেড অ্যালার্ট জারি করেছি। আমাদের পুলিশ তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে, তাদের খুব শিগগির ধরতে পারবো বলে আমরা বিশ্বাস করছি। আমরা বর্ডার এলাকাগুলোতেও বলে দিয়েছি, তারা যেন দেশ থেকে পালিয়ে যেতে না পারে।
‘এ ঘটনাটি দুঃখজনক। আমরা মনে করি যদি কারও অবহেলা থাকে, যদি কারও গাফিলতি থাকে যদি কেউ ইচ্ছা করে এ কাজটি ঘটিয়ে থাকেন, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করবো।’
আসাদুজ্জামান খান বলেন, এটা নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা তদন্ত কমিটি করবো। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। সচিব, কারা মহাপরিদর্শক, ডিএমপি কমিশনার সবাই এটা নিয়ে মিটিং করছেন। আমরা খুব সহসাই পরবর্তী নির্দেশনা জানাবো।
রাজধানীতে রেড অ্যালার্ট
আদালত থেকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারে রাজধানীতে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীর প্রতিটি থানা ও অন্যান্য ইউনিটকে চেকপোস্ট বসানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ২০ লাখ
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুস্কারের ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি, প্রতিবেদন তিনদিনের মধ্যে
দুই জঙ্গি পালানোর ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে সভাপতি করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। রোববার (২০ নভেম্বর) ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির সভাপতি হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম আ্যন্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার।
কমিটির সদস্যরা হলেন ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস), যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি), লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ও ডিএমপির সিআরও’র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার। তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
২০১৪ সালের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটলো আজ। তখনকার পুরো ঘটনায় পুলিশ ও কারাগারের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল বলে পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।
তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ) নাজিম উদ্দীন চৌধুরীর পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কারাগারে জ্যামার নষ্ট থাকার অজুহাতে দুর্ধর্ষ আসামিরা মোবাইলে নিয়মিত কথা বলছেন। ওই ঘটনার আগে জঙ্গিরা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ আসামি আদালতে আনা-নেওয়ার জন্য আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করে কমিটি।