স্বাধীনতার পথ রচনায় মওলানা ভাসানী

3

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৭ নভেম্বর। ৯৬ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানীকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। সর্বশেষ পাসপোর্ট অনুযায়ী মওলানা ভাসানীর জন্ম তারিখ ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ওরফে মওলানা ভাসানী হচ্ছেন রূপকথার নায়ক তুল্য বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমিত-তেজা বিমূর্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন উপ-মহাদেশের আজাদী আন্দোলনের অন্যতম নির্ভীক সিপাহ্সালার। দেশ-জাতি ধর্মের মর্যাদা রক্ষা, জনগণের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর। ইসলামের এক অনাড়ম্বর খাদেম ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও সত্য কথা বলাই উত্তম জিহাদ’ হাদিসটির তিনি ছিলেন এক জীবন্ত প্রতীক। তার রাজনৈতিক জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, আজীবন তিনি রাজনীতি করলেও ক্ষমতার রাজনীতি থেকে সব সময় ছিলেন দূরে। অপরকে ক্ষমতায় পাঠিয়ে তাদের দিয়ে তিনি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইতেন। দুর্লভ এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিত্বকে বাংলার মানুষ এ জন্যেই অধিক স্মরণ করে।
জাতীয় যেকোনো দুর্যোগ মুহূর্তে এ কারণেই অবলীলাক্রমে সকলের মুখে উচ্চারিত হতে দেখা যায়- ‘‘এ সময় দরকার, ভাসানী জননেতার।’ জাতির এই দরদী নেতা বাংলাদেশের বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের ধনগড়া নামক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানীর পিতা মরহুম হাজী শারাফত আলী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তার পেশা ছিল চাষাবাদ। মওলানা ভাসানী চাষী পরিবারে জন্মলাভ করে চাষীদের পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন, গড়ে ওঠেন, যেই চাষীরা বেঁচে থাকার তাগিদে অপরিসীম কষ্ট, পরিশ্রম ও সংগ্রাম সাধনার মধ্যে নিজেদের সদা নিয়োজিত রাখেন। যুবক ভাসানীর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে পরিবেশগত তার এ অবস্থান সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।
মুসলিম পারিবারিক শিক্ষার ঐতিহ্যগত ধারা অনুযায়ী মওলানা ভাসানী প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। তবে তিনি সৌভাগ্যক্রমে শাহ্ সূফী নাসিরুদ্দীন বাগদাদীর ন্যায় একজন আধ্যাত্মিক নেতার সংসর্গ লাভ করেছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষার পাদপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং উপমহাদেশের অন্যতম সুপরিচিত রাজনীতিক, আজাদী সংগ্রামের নির্ভীক সেনানী মরহুম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর সাহচর্যেও মরহুম মওলানা ভাসানী দু’বছর অতিবাহিত করেন। শাহ সূফী বাগদাদীর ন্যায় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের সংসর্গ এবং কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানে পরিপক্ব মহা পন্ডিত ও বুজর্গ মাওলানা মাদনীর সাহচর্য ভাসানী চরিত্রকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় বৈশিষ্ট্যে করেছিল বিমন্ডিত। রাজনৈতিক ভবিষ্যত: বর্তমান শতকের প্রথম দশকে মওলানা ভাসানী ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত থেকে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসাবে তিনি আজাদী সংগ্রামে রত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে খেলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলীর সাথে কাজ করার তার সুযোগ ঘটে। খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারণে মওলানা ভাসানী বৃটিশ শাসকদের দ্বারা কারানির্যাতন ভোগ করেন।
১৯২৩ সাল থেকে খেলাফত আন্দোলন অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুতে (১৯২৫) স্বরাজ পার্টির নীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই দুটি ঘটনার পর রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল অবহেলিত বাংলা আসামের গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক। ১৯৩০ সালে মওলানা ভাসানী বাংলা-আসামের লাখ লাখ কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯২৪ সালে ভাসানচরে অনুষ্ঠিত বাংলা-আসামের জিরাতিয়া প্রজাদের এক ঐতিহাসিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলনের সূচনা করেন। শোষক সামন্তবাদী জোতদার মহাজন শ্রেণীর বিরুদ্ধে মুসলিম চাষী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৯৩০ সালে বাংলা-আসামের মুসলমানদের এক বিরাট সম্মেলনের আয়োজন করেন। তৎকালীন বৃহত্তর মোমেনশাহী জেলার সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ সালে ডাইরেক্ট একশনের লক্ষ্যে চাষী সাধারণকে সংগঠিত করেন। এসব তৎপরতার কারণে ১৯৩২ সালের প্রথম দিকে বৃটিশ সরকার এ জেলায় তার তৎপরতা বন্ধ করে দেয়। ১৯৩৭ সালে অল ইন্ডিয়া লক্ষ্ণৌ কনফারেন্সের অব্যবহিত পূর্বে মুসলিম লীগ নেতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং রাজা গজনফর আলীর অনুরোধে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে মিলিত হয়েছিল। গণভোটে সিলেটবাসী যাতে আদৌ কোনো ভুল না করেন, সেজন্য মওলানা ভাসানী সারা সিলেটে ঝটিকা সফর করে পাকিস্তানের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। ‘৪৭-এর আজাদী আন্দোলনে এই সংগ্রামী নেতার রয়েছে অসামান্য অবদান। ১৯৪৮ সালে তিনি উত্তর টাঙ্গাইল থেকে বিনা প্রতিদ্বনিদ্বতায় পূর্ব-পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তাদের দলীয় মেনিফেস্টো মোতাবেক কাজ না করায় তিন মাস পর তিনি তার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন। এক বছর পর তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার প্রতিবাদে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র দু’টি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এভাবে স্বায়ত্তশাসিত দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ধারণা থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার জনগণ থেকে ভোট আদায় করলেও পশ্চিম পাকিস্তানেই এর রাজধানী স্থাপন করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা অর্থনৈতিক ও অন্য নানান বৈষম্যের শিকার হয়।
মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে লাহোর প্রস্তাবকেন্দ্রিক মতবিরোধের ফলে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৪৯ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এই নবগঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তার এ সংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি এবং বাগদাদ প্যাক্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজদলীয় সহকর্মীদের সাথে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। এ কারণে আবারও তিনি নিজ দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ সাথে তার রাজনৈতিক যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই দলই আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জিত হয়।
১৯৫৭ সালে তিনি নতুন দল ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ গঠন করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হিসেবেও মওলানা ভাসানীকেই নির্বাচিত করা হয়। উল্লিখিত বছরগুলোয় মওলানা ভাসানী দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃষকদের স্বার্থেই কাজ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ‘কৃষক সমিতি’ নামে এদেশের কৃষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংগঠন কায়েম করেন। কৃষক সমিতিরও সভাপতি মওলানা ভাসানীই ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মওলানা ভাসানী পাকশীতে এক বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উক্ত সম্মেলনে প্রায় আড়াই লাখ কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি প্রায় অনুরূপ আরেকটি বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন ১৯৭০ সালে। এই সম্মেলনেও দু’লাখ কৃষক অংশ নেয়। একই সালে তিনি মহিপুরেও এক বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। মহিপুরের কৃষক সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ কৃষক সমবেত হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা প্রদান: মওলানা ভাসানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদের আহবান জানান। তিনিই ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা না দেয়ায় ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা প্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানী লক্ষ্য করেন যে, ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিবেশী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটির চাপে জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি অনুসরণ করতে পারে। তাই তিনি আর নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। নিজের সকল আরাম হারাম করে বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে আবার রাজপথে নেমে পড়েন। তিনি দেখলেন এর ফলে সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মুসলিম প্রধান এ দেশের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় সকল মূল্যবোধ ধ্বংসের কারণ হতে পারে। যদ্দরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত প্রভু ও পতাকা বদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন মওলানা ভাসানী ৩০ জুন ১৯৭৪ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তাঁর অনুসারীদের সংগঠিত করেন। কিন্তু সরকার মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রাখে, যেন তিনি আন্দোলনে কোথাও বের হতে না পারেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানী লক্ষ্য করেন, ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিবেশী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটির চাপে জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি অনুসরণ করতে পারে। তাই তিনি আর নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। নিজের সকল আরাম হারাম করে বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে আবার রাজপথে নেমে পড়েন। তিনি দেখলেন এর ফলে সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মুসলিম প্রধান এদেশের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় সকল মূল্যবোধ ধ্বংসের কারণ হতে পারে। যদ্দরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত প্রভু ও পতাকা বদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন মওলানা ভাসানী ৩০ জুন ১৯৭৪ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তার অনুসারীদের সংগঠিত করেন। কিন্তু সরকার মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রাখে, যেন তিনি আন্দোলনে কোথাও বের হতে না পারেন।
হুকুমতে রাববানী সোসাইটি ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী যখন বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ে হুকুমতে রাববানী সোসাইটি গঠন করেন, তখন এই পদক্ষেপ তার জীবনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে তার নবগঠিত দল ‘হুকুমতে রাববানী সোসাইটি’ গঠনের মূল দর্শন ব্যাখ্যা করেন। রাজনৈতিক তৎপরতার সাথে সাথে মওলানা ভাসানী তাঁর জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দর্শনের অনুকূলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বিষয় চিন্তা করেন। মূলত মওলানা ভাসানী কর্তৃক টাঙ্গাইলের সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি তার শিক্ষাসংক্রান্ত চিন্তাধারা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নেরই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে আসেন। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ : মওলানা ভাসানীর সংগ্রামমুখর জীবনের সর্বশেষ ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ। বাংলাদেশে মরু প্রক্রিয়া সৃষ্টিকারী ‘ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দাও, উড়িয়ে দাও’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৬ ও ১৭ মে রাজশাহী থেকে হাজার হাজার লোক নিয়ে ভাসানী লংমার্চ শুরু করেন। সেই লংমার্চের উদ্দীপনাপূর্ণ স্মৃতি প্রতিটি মানুষকে এখনও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে। খোদায়ী খেদমতগার দল : মওলানা ভাসানীর জীবনের সর্বশেষ সংগঠনটি ছিল ‘খোদায়ী খেদমতগার দল’। তিনি ১৯৭৬ সালের ১ অক্টোবর সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে এটির ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে সন্তোষস্থ তার দরবার স্থলে সব খেদতমতগারের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন সেটিই ছিল এই নেতার জীবনের সর্বশেষ ভাষণ। সেদিন মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল, ‘আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে- যতসব দলই বদল করি না কেন, কোনো ফলোদয় হবে না, যদি না শাসকবর্গ চরিত্রবান হয়, আর চরিত্রবান লোকেরাই কেবল আল্লাহর শাসন কায়েম করতে পারে। আমি তাই হুকুমতে রাববানীয়ার আশ্রয় নিয়েছি। দোয়া করি, আল্লাহর মর্জি হোক, বিশ্ব মানবতার জয় হোক’।
ইন্তেকাল: ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সন্তোষে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ভাসানী জীবনের শিক্ষা : যেকোনো সমাজে কোনো আদর্শ বাস্তবায়নের দ্বারা ওই সমাজের কল্যাণ সাধন করতে হলে সেই আদর্শকে প্রথমে সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের কাছে পরিচিত করতে হয়। উক্ত আদর্শকে পরিচিত করতে হয়, প্রথমে সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের কাছে ওই আদর্শের বাস্তবায়ন দ্বারা জনগণের কি কি কল্যাণ সাধিত হয়, সেটা বোধগম্য ভাষায় তাদের সামনে তুলে ধরতে হয়। অন্যথায় আদর্শের ধারক-বাহকরা সংশ্লিষ্ট সমাজের কল্যাণকামী হলেও জনগণ কখনও তাদেরকে নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে না। তাদের প্রতি বাহ্যিকভাবে সম্মান জানালেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আসনে বসার সুযোগ তাদেরকে কখনও দিতে চায় না। আদর্শের প্রচারকদের কর্তব্য হলো নিজের কথা, আচার-আচরণ ও একই সঙ্গে চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা জনচিত্তকে জয় করা। বলা বাহুল্য, মওলানা ভাসানী তার গোটা সংগ্রামমুখর জীবনে জনপ্রিয়তার যেই উত্তুঙ্গ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন, এর পেছনে তার উল্লিখিত গুণাবলীই অধিক কাজ করেছিল। সমাজের সাধারণ গণমানুষ সব সময় এই অনাড়ম্বর মহান ব্যক্তিত্বকে দেখেছে নিজেদের আপন মানুষ হিসেবে। তাদের দুঃখ-দুর্গতির কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে এবং এ জন্য দায়ী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে তাকেই জনগণ সব সময় কাছে পেয়েছে। তারা দেখেছে, ক্ষমতায় না গিয়েও এই‘আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে- যতসব দলই বদল করি না কেন, কোনো ফলোদয় হবে না, যদি না শাসকবর্গ চরিত্রবান হয়, আর চরিত্রবান লোকেরাই কেবল আল্লাহর শাসন কায়েম করতে পারে। নিঃস্বার্থ মজলুম জননেতাকে সকল সময় তাদের সমস্যাবলী নিয়েই দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত সভা করে বেড়াতে এবং অত্যাচারী শাসকদের সন্ত্রস্ত করে রাখতে।
সবচাইতে বড় কথা হলো, মওলানা ভাসানী এদেশের মানুষের কল্যাণে তাদের বোধগম্য ভাষায় যে কথা বলতেন, তারা সে কথা বুঝতো। পক্ষান্তরে একই ‘মওলানা’ লকবে ভূষিত আরও বহু আলেম যারা নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা নিঃস্বার্থভাবে এ দেশ-জাতির সেবা করে আসছেন এবং তাদের ইহ-পারলৌকিক মুক্তির সন্ধান দিচ্ছেন, তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশবাসীর হৃদয় সে রকম জয় করতে পারেননি; যেমনটি পেরেছিলেন মওলানা ভাসানী। অথচ তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও বৈষয়িক বড় বড় এমন পন্ডিতও ছিলেন ও আছেন; যাদের ইলমের পরিধি হয়তো মওলানা ভাসানীর চেয়েও ব্যাপক ছিল। এর কারণ সম্ভবত সাক্ষাৎ জনসেবামূলক কাজ ভাসানী অধিক করেছেন আর যা বলেছেন জনগণের জীবনঘনিষ্ঠ সাক্ষাৎ সমস্যাবলীর সমাধানে তাদের বোধগম্য ভাষায় বলছেন ক্ষমতায় যাবার জন্য নয়, জনগণের জন্য কথা বলে তিনি জেল খেটেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এদেশের গরিব জনগণের হৃদয় কাঙ্ক্ষিতভাবে জয় করতে ভাসানীর অনুরূপ অন্য ইসলামপন্থীরা আশানুরূপ সফল হননি। তাদের ব্যর্থতার এই ছিদ্রপথেই আমাদের দেশজাতির বড় সর্বনাশটি সাধিত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, নাস্তিকতাবাদী ও খৃস্টান মিশনারি সংস্থাগুলো এদেশের কোটি কোটি তওহীদি জনতার সাক্ষাৎ সমস্যাবলীর সূত্র ধরে এ দেশের মুসলমানদের ওলামা নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেউ লক্ষ্যে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, কেউ হয়েছে অলক্ষ্যে। এভাবেই আমাদের দেশের ওলামাসমাজ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও পরে অবহেলিত হয়ে পড়েন; আর এ সুযোগে আজ জাতির ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। যা কিনা দেশের লক্ষ্য লক্ষ্য তালাবা ও আলেমানের পক্ষেও এখন তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়ে উঠছে না, পরন্তু এ সুযোগে ইসলামের আন্তর্জাতিক বৈরীশক্তি তার সুযোগ নিতে তৎপর হয়ে উঠেছে শান্তিকামী এই মুসলিম সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি করে গোটা জাতির সর্বনাশ সাধনে তারা তৎপর হয়েছে। এই আলোকে চিন্তা করলেও সংগ্রামী নেতা মওলানা ভাসানীর জীবন নিঃসন্দেহে বিরাট এক শিক্ষণীয় জীবন। সুতরাং, আজাদী আন্দোলনের নির্ভীক সেনানী এবং ইসলামী সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অগ্রপথিক, এ দেশের রাজনৈতিক গগনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর এই আলেম জননেতা মওলানা ভাসানীর সংগ্রামমুখর জীবন থেকে আজকের ইসলামী আন্দোলনের ওলামা, আধুনিক শিক্ষিত সকলেরই এমন অনেক কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, যেগুলোর অভাবে তারা এ দেশবাসীর অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েও এখনও মওলানা ভাসানীর ন্যায় মানুষকে আপন করে নিতে পারেননি। বিশেষ করে জনজীবনের সাক্ষাৎ সমস্যাবলী যেগুলোর কারণে সাধারণ মানুষ জর্জরিত হচ্ছে, তাদের ঐসব সমস্যা সমাধানে সম্ভাব্য বস্তুগত সাহায্য সহানুভূতি নিয়ে তাদের দ্বারে পৌঁছুতে হবে। তাদের জীবন মান উন্নয়নে, তাদের সাহায্যার্থে সাহায্য সংস্থা গঠন করতে হবে। নিছক বেশি বেশি উপদেশাবলী শোনানোর দ্বারা যতদূর না তাদের চিত্ত জয় করা সম্ভব, ঐ বাস্তব সেবাকর্মের দ্বারা স্বল্প উপদেশই তাদের অধিক সাড়া মিলতে বাধ্য।
সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম আর্থিক তাগিদ দিয়েছে নানাভাবে। অন্ন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসা বঞ্চিত কর্ম সংস্থানহীন ক্ষুধাক্লিষ্ট লাখো মানুষের সামনে খাদ্য-বস্ত্র ও ওষুধের প্যাকেট রাখা কিংবা সেই আয়োজনই প্রধান কর্তব্য। তাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের চিত্ত জয় সহজ হবে, অন্যপন্থায় তা ততটা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ এই জন্যেই সূরা মাউনে বলেছেন, ‘‘তুমি কি দ্বীনের অস্বীকারকারীদের দেখেছ? তারা হচ্ছে সেই সকল মানুষ যারা এতিম (অসহায়-দুর্বল)দের বঞ্চিত করে তাদেরকে অবজ্ঞা করে চলে আর অন্ন বস্ত্রহীন অভাবী-ক্ষুধাক্লিষ্টদের খাবার দানে উদ্যোগী হয় না ও অপরকে উদ্যোগী করে তোলে না? ঐ সকল নামাজীর জন্যেও দুর্ভোগ, যারা নিজেদের নামাজের (তাৎপর্য সম্পর্কে) গাফিল-উদাসীন। শুধু লোক দেখানোর জন্যই তা করে এবং অপরকে প্রয়োজনীয় তুচ্ছ জিনিসদানেও নিষেধ করতে দ্বিধা করে না। (সূরা মাউন)’’ তেমনি মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘সে ব্যক্তি খাঁটি মুমিন নয় যে নিজে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধায় মরে।’’ এ মর্মেই তিনি স্বাবলম্বিতা অর্জন এবং অপরের কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্যে বলেছেন, ‘‘উপরের হাত তথা দাতার হাত উত্তম নিচের অর্থাৎ গ্রহিতার হাত থেকে।’’ সত্যি কথা বলতে কি, আল-কুরআনে উল্লিখিত, মানবজীবনের অতীব জরুরি বিষয় খাদ্য সমস্যার সমাধানের প্রতি আমাদের ধর্মীয় মহলের যেরূপ গুরুত্ব দেয়া জরুরি ছিল, এ বিষয়টি এই গরীব দেশে তাদের দ্বারা অতীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে সেরূপ গুরুত্ব পায়নি। কুরআনের পারলৌকিক বিষয়াদিকে যেরূপ অধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, সে তুলনায় ইহলৌকিক এ বিষয়কে খুব কমই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর জনদরদসিক্ত সংগ্রাম মুখরজীবন আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিশেষভাবে ধর্মীয় নেতৃত্বের জন্যে নিঃসন্দেহে এক অনুপ্রেরক দৃষ্টান্ত। আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় ভাসানীর স্মৃতি সকলকে উদ্বুদ্ধ করুক, এটাই সময়ের দাবি।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক।