সিলেটের হাওর এখনও পানিতে টইটম্বুর

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ধীরগতিতে পানি নামার কারণে শঙ্কায় রয়েছেন সিলেটের বন্যাকবালিত এলাকার মানুষ। জেলার বিভিন্ন উপজেলার রাস্তাঘাট হাট বাজার পানিমুক্ত হয়ে গেলেও হাওর এলাকা এখনও পানিতে টইটম্বুর। সুতরাং বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পেলেই সহজেই আবার বন্যার সৃষ্টি হবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এবারের বন্যার এমন দুর্গতির কারণ সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। বন্যা পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান নিয়ে সরকারের যথাযথ ও বাস্তব ভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। বন্যার ছোবলে গ্রামের গরিব শ্রেণীর অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গন প্রক্রিয়ায় ভিটেবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে। বন্যায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের গচ্ছা যাবে হাজার কোটি টাকা। এবারের বন্যায় যে সকল এলাকায় বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে, সেখানে চরম খাদ্য সঙ্কট বিরাজ করছে। বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল মানুষ খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। ১৮ বছর পর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুরমার দুই তীর উপচে ডুবিয়ে দেয় শহর ও গ্রামাঞ্চল। দীর্ঘদিন নদী খনন না করায় বেশি ভুগতে হচ্ছে শহর ও সে অঞ্চলের নদীতীরবর্তী মানুষকে। অথচ ১০ বছরে সিলেটের সুরমা নদী খননে চারটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনাগুলো (ডিপিপি) মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর তিনবার সমীক্ষাও চালানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুরমা খননে নেয়া কোন প্রকল্পই আলোর মুখ দেখেনি। ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগ সুরমা খননে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেটিও এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। তারও আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সুরমা খননে তিনটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। পাউবোর সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, ২০২১ সালে আমরা নদী খননের বিষয়টি বাঁধ দিয়ে ৪ হাজার কোটি টাকার আরেকটি ডিপিপি প্রেরণ করেছি। এটিও এখন সমীক্ষার পর্যায়ে আছে।
সিলেটে চলমান বন্যা ও গত মাসে হাওরে অকাল বন্যায় ফসলহানির পর ফের আলোচনায় এসেছে এই অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা খননের বিষয়টি। এই দুই বন্যার জন্যই সুরমার নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সিলেটের দুঃখ হয়ে উঠেছে ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া নদীটি। দীর্ঘদিনই ধরেই স্থানীয়রা নদী খননের দাবি জানিয়ে আসছেন। এবার উপর্যুপরি বন্যার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সুরমা নদী খনন করা হবে। বন্যার করাল গ্রাসে সিলেট অঞ্চল বিপর্যস্ত। সিলেট নগরের প্রায় অর্ধেক এলাকা এক সপ্তাহ ছিল জলমগ্ন। নদীর পার উপচে পানি ঢোকার আগেই তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় মহানগরে। উপজেলাগুলোর রাস্তাঘাট, ফসলি জমি তলিয়ে যায় বন্যার পানিতে। এবার বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েন প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এখন নদীর পানি কমতে শুরু করায় নগরের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও উপজেলাগুলোতে এখনও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। দিন দিন মানুষের দুর্ভোগের চিত্র ফুটে উঠছে। মানুষের এই দুর্ভোগের কারণ কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এর পেছনে দায় রয়েছে অব্যবস্থাপনার। পরিবেশ, প্রতিবেশের পরিচর্যা না করে অপরিণামদর্শী উন্নয়ন প্রকল্প এই দুর্যোগের অন্যতম কারণ। বর্তমান যুগে অবকাঠামো উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দৃশ্যমান উন্নয়নে মনোযোগ বেশি দিতে হয়। অথচ অবকাঠামো উন্নয়নে পানির প্রবাহ নষ্ট হচ্ছে কিনা, পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে হয় না তেমন কোন পর্যালোচনা।
তাছাড়া একাধিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে থাকে না কোন সমন্বয়। একটি এলাকার উন্নয়ন কর্ম ওই এলাকার বাস্তবতা অনুযায়ী হওয়া উচিত। প্রকল্প গ্রহণ, প্রাক্কলন সবই হওয়া উচিত স্থানীয় ভিত্তিতে। এলাকার চাহিদা অনুযায়ী। প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা সমস্যার কারণে নির্ধারিত সময়ে সকল এলাকায় যথাযথভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছেনা। এজন্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বছরের পর বছর মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। স্থানীয় উন্নয়ন কৌশলের আলোকে যদি জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়। তাহলে জোড়াতালির উন্নয়ন মানুষের দীর্ঘমেয়াদী উপকারের পরিবর্তে দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট ইত্যাদি প্রথাগত ধারণা বন্যানিয়ন্ত্রণ না করে বন্যা আরও দীর্ঘস্থায়ী করছে। নালা, ছড়া, খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ যত্রতত্র বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, অবৈজ্ঞানিক অদূরদর্শী প্রকল্প সমস্যাগুলোকে আরও ভয়াবহ করছে। বিভিন্ন সময় গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে অনেকাংশেই এর সমাধান সম্ভব হতো। সুরমা কুশিয়ারার পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে বন্যা ব্যবস্থাপনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল কালনী-কুশিয়ারা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। কেবল আন্তরিকতা ও সঠিক পদক্ষেপের অভাবে এই প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। সিলেট বিভাগের কালনী-কুশিয়ারা নদী ব্যবস্থা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম বড় নদী ব্যবস্থা। জকিগঞ্জের অমলসিদ থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত সুরমার দূরত্ব প্রায় ২০৪ কিলোমিটার। সুনামগঞ্জ থেকে পৈন্দা পর্যন্ত মূলধারাটিই সুরমা নামে পরিচিত। পৈন্দা থেকে দিরাই উপজেলার চানপুর হয়ে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মারকুলি এলাকায় কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয়েছে সুরমার এই প্রধান ধারা। এটি এখন মৃতপ্রায়-পুরান সুরমা নামে অভিহিত। এই ধারায় মিলিত হওয়ার আগে সুরমা নদীর এই শাখাটি দিরাই উপজেলার চানপুর হয়ে সুজানগর থেকে আজমিরীগঞ্জে গিয়ে আবার কালনী নদীতে মিশেছে। এই ধারাটি ‘মরা সুরমা’ নামে পরিচিত। সুরমার দ্বিতীয় শাখাটি পৈন্দা থেকে পশ্চিম দিকে নৌয়া নদী নামে আট কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে উত্তর-পশ্চিমে আরেকটু মোড় নিয়ে আরও ৯ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে। সেখানে জামালগঞ্জের লালপুরের কাছে বৌলাই নদীতে বাঁক নিয়েছে সুরমা। পরবর্তী সময়ে ঘোড়াউত্রা নাম নিয়ে দিলালপুরে গিয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই নদীপথের সুবিশাল জলরাশি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জলপ্রবাহ হারিয়েছে।
পুরান সুরমা ও মরা সুরমা এখন বলতে গেলে মৃতপ্রায়। সুরমা, কুশিয়ারা নাব্য হারিয়েছে। যে নদী পথে একসময় জাহাজ, বড় বড় স্টিমার চলতো সেই নদীপথগুলোতে এখন বড় নৌকা চলাচলই বাধাগ্রস্ত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে শুধু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নদীর গতিপথ নষ্ট হচ্ছে, নাব্য হারাচ্ছে নদীগুলো। উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে চর পড়ছে নদীগুলোতে। ইটাখলা, ডাউকিসহ শাখা নদীগুলো অস্তিত্ব হারিয়েছে। হাওড়গুলো ভরাট হয়ে গেছে। স্থানে স্থানে জেগেছে চর। নদীর পাড় ভরাট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে তীরও দখল করে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। পলি পড়ার কারণে নদীগুলো প্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রাক মৌসুমি বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, নদীর নাব্য হ্রাস এবং কৃষি ও জনবসতি ভাঙ্গনের সম্মুখীন হচ্ছে। এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল কালনী-কুশিয়ারা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা। নদীর দীর্ঘমেয়াদী সুস্থিত অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উন্নয়নের জন্য সুস্থিত পরিবেশ তৈরিকরণ। প্রাক মৌসুমি বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং বর্ষা উত্তর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষির ক্ষতি কমানো।
প্রকল্প এলাকায় ছিল কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলি উপজেলা সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর উপজেলা সিলেট জেলার সিলেট সদর, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলা। মৌলভীবাজার জেলার মৌলভীবাজার সদর ও হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ সদর ও লাখাই উপজেলা।
কালনী-কুশিয়ারা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প এলাকা সিলেটের দক্ষিণে এবং ভৈরব বাজারের পূর্বে অবস্থিত। দক্ষিণে কুশিয়ারা-বিজনা-রটনা-সুতাং নদী, উত্তরে পুরাতন সুরমা-ডাহুক নদী এবং জগন্নাথপুর সিলেট সড়ক, পশ্চিমে পুরাতন সুরমা বৌলাই এবং পূর্বে সিলেট-কাকটাই গ্রামীণ সড়ক দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রকল্পটি সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার ৩,৩৫,৬০০ হেক্টর এলাকাব্যাপী বিস্তৃত। প্রায় বারো বছর আগে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে সিলেট বিভাগে বর্তমানে বন্যা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তেমনটি হতো না।
সিলেট নগরে গত ১২ বছরে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও জলাবদ্ধতার সমাধান হয়নি। প্রায় চার দশকেও সুরমা নদী খনন হয়নি। তাতে তলদেশ ভরাটের সঙ্গে নদীতে জেগেছে ছোট ছোট অসংখ্য চর। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানি ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে সুরমা। যার কারণে নদী উপচে পানিতে ডুবেছে সিলেট নগরী। একই অবস্থা কুশিয়ারাসহ অন্য নদীগুলোরও।