উম্মাহ ইস্যু : বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব

13

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

অতীতে যারা বুদ্ধির চর্চা করেছেন তারা আল্লাহর দেয়া একটা বিধানের আওতায় অবস্থান করেছেন। মানুষের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এ কথাই বলে। হাজার হাজার বছরে দুনিয়ার দেশে দেশে অসংখ্য জাতির ও সভ্যতার উত্থান পতন হয়েছে। এশিয়ায় আফ্রিকায় ইউরোপে এরা বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। রাজনীতি চর্চা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় এদের পারদর্শিতা সভ্যতার রূপান্তর ঘটিয়েছে। এ সবই মানুষের বুদ্ধি চর্চার ফল। এক্ষেত্রে দার্শনিকের দর্শনচর্চা নবীদের নবুওয়তকে অতিক্রম করতে পারেনি। আজকের যুগে বুদ্ধিচর্চার যে প্রান্তে আমরা এসে পৌঁছেছি সেখানে এসেও আমরা এ সত্যটি পুরোপুরি উপলব্ধি করছি। বিগত শতকে পৃথিবীর একটা অংশে আল্লাহর বিধান অস্বীকার করার একটা দুঃসাহস আমরা দেখেছি। কিন্তু সত্তর বছরের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত পতন আবার সেই চিরন্তন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, “সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা অপসারিত হয়েছে। আর মিথ্যা অপসারিত হয়েই থাকে।”
আধুনিক যুগে আল্লাহর বিধানের আওতায় বুদ্ধিচর্চাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সক্ষম একমাত্র ইসলাম। ইসলাম শুরু থেকেই একদিকে যেমন আল্লাহর বিধানকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা চালিয়েছে আসছে তেমিন অন্যদিকে বুদ্ধিচর্চাকেও এই বিধানের আওতায় রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যার ফলে শুরু থেকে নিয়ে এক হাজার বছর পর্যন্ত ইসলামী চিন্তা বিশ্ব শাসন করেছে। এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? ইসলামে বুদ্ধিচর্চা গোড়া থেকেই আল্লাহর বিধানের আওতাধীন হয়েছে। আল্লাহর নবী নিজেই ছিলেন এই বুদ্ধিচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। কুরআন নিজেই যেখানে চিন্তা করার, ভেবে দেখার এবং গভীর অভিনিবেশ সহকারে বিচার বিবেচনা করার আহবান জানিয়েছে সেখানে আল্লাহর নবী তাঁর সাহাবাগণকে উৎসাহ যুগিয়েছেন আগামী দিনে পথ চলার ক্ষেত্রে উদ্ভূত নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের কৌশল উদ্ভাবনে। আল্লাহর বিধানের আওতায় বুদ্ধিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা অর্জনে মু’আযকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ামনের মতো একটা নতুন দেশে এবং একটা অগ্রসরমান সুসভ্য জাতির এলাকায় তোমাকে শাসক হিসেবে পাঠানো হচ্ছে; তারা নতুন কোনো সমস্যা নিয়ে আসলে কিভাবে তার সমাধান করবে?
জবাব দিলেন, যে আল্লাহর রসূল, প্রথমে কুরআনে খুঁজে দেখবো তার সমাধান। কুরআনে না পেলে আপনার হাদীস ও সুন্নাতে তার সমাধান দেখবো। সেখানে না পেলে আমার নিজস্ব চিন্তার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করবো। (আজতাহিদু বিরায়ী)।
আল্লাহর রসূল মু’আযকে সমর্থন দিলেন। চিন্তারা এগিয়ে চললো অহী ও নবুওয়তের ছত্রছায়ায়। প্রথমে কুরআন, তারপর হাদীস, তারপর আমার চিন্তা, অর্থাৎ আমার চিন্তা কুরআন ও হাদীসের পিছনে, তার আগে নয়। এক’শো দু’শো তিনশো বছর পর্যন্ত স্বাধীন চিন্তায় কোনো ক্লান্তি দেখা গেলোনা। নবী, সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের যুগ শেষ হয়ে গেলো। নতুন নতুন দেশ ও ভূখন্ড বিজিত হলো। নতুন সভ্যতা ও নতুন জাতিরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলো। নতুন নতুন সমস্যা ও জটিলতর সমস্যার সমধান করলো মুসলমানরা আল্লাহর বিধানের আওতায় নবীর অনুসৃত পথে। সৃষ্টি এবং কর্ম এই দুই নিয়ে আল্লাহর দুনিয়া গঠিত। সৃষ্টি আল্লাহ করেছেন। সৃষ্টি যেসব কর্ম করে তার প্রত্যেকটার পেছনে যেসব কার্যকারণ থাকে তাও আল্লাহর সৃষ্টি। বর্তমানের নতুন সমস্যার অতীতের ব্যবস্থায় যার কোনো সমাধান বিধৃত নেই তার পেছনে যে কার্যকারণ পাওয়া যায় অতীতের অনুরূপ বা সমধর্মী কাজের পেছনে যে কার্যকারণ ছিল তার সাথে যদি এর সামঞ্জস্য পাওয়া যায় তাহলে অতীতের সেই কাজের হুকুম বর্তমানের সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। একে বলা হয় কিয়াস ও ইজতিহাদ। মুসলমানরা নিছক বুদ্ধির পায়রবি না করে এই কিয়াস ও ইজতিহাদের মাধ্যমে আল্লাহ বিধানের আওতায় তাকে ব্যবহার করেছে। তিনশো বছর পর্যন্ত এ ব্যবস্থায় কোনো কমতি দেখা দেয়নি। কুরআন ও সুন্নাহ এবং একই সঙ্গে জাগতিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চা হয়েছে এবং মুসলমানরা আল্লাহর বিধানের আলোকে সাহসের সাথে জীবন সমস্যার সমাধান করেছে। পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সঠিক পথে। তারপর ধীরে ধীরে অবসাদ নেমে আসতে থেকেছে।
চতুর্থ হিজরী শতকের পূর্বে মুসলমানরা নির্দিষ্ট কোনো এক ব্যক্তির রায় ও অভিমত মেনে চলার ব্যাপারে একমত হয়নি। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে মুসলমানরা কোনো বিশেষ ব্যক্তির কথা বা রায় উদ্ধৃত করতো না। কোনো ব্যক্তির রায়ের ভিত্তিতে ফতোয়াও দিতো না। কোনো বিশেষ ব্যক্তির ফিকহী রায়ের ভিত্তিতে ফিকহের বুনিয়াদ রাখতো না। আঠারো শতকের শেষ্ঠ মুসলিম মনীষী, চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী তার হুজ্জতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থে চ তুর্থ হিজরী শতকের পূর্বে ও পরে মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা প্রসংগে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে এই দুই শতকে ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণের কথা কেউ চিন্তাই করেনি। মুহাদ্দিসদের কাছে ছিল অসংখ্য সহী হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের ‘আছার’ তথা তাঁদের কথা ও কার্যক্রম। এগুলোর ভিত্তিতে তাঁরা ফতোয়া দিতেন। এমন সব সহী হাদীস ও আছার তাঁদের কাছে ছিল যেগুলোর ওপর সাহাবায়ে কেরামও আমল করে গেছেন। জমহুর সাহাবা ও তাবেঈগণের এমন সব বাণী ও রায় তাঁদের কাছে ছিল যেগুলোর বিরোধিতা করা মোটেই কোনো উত্তম ও প্রশংসনীয় কাজ বলে বিবেচিত হতো না। যদি কোথাও হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্য ও অগ্রাধিকার দেবার কারণ সুস্পষ্ট না হতো অথবা কোনো বিষয়ের সমাধানে তাদের দিল নিশ্চিন্ত না হতো তাহলে সেক্ষেত্রে তারা ফকীহদের মধ্য থেকে কোনো একজনের সমাধানের দিকে ফিরে যেতেন। আর যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফকীহদের দুই বা একাধিক অভিমত দেখতেন তাহলে তাদের মধ্য থেকে যাকে বেশি নির্ভরযোগ্য পেতেন তার অভিমত গ্রহণ করতেন। তিনি মদীনার ফকীহ হোন বা কুফার তার পরোয়া করতেন না।
তবে তাদের একটি দল আবার কোনো একটি বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান না পেয়ে পূর্ববর্তী কোনো নির্দিষ্ট ফকীহের যুক্তির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতেন এবং তা থেকে সমস্যার সমাধান নির্ণয় করতেন। তাদের বলা হতো ‘আহলে তাখরীজ। তারা কোনো নির্দিষ্ট ফকীহের অভিমতের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করতেন। তাদেরকে অমুকের মযহাবের অনুসারী বলে উদ্ধৃত করা হতো। কাউকে হানাফী এবং কাউকে শাফেয়ী বলা হতো। যেমন ইমাম নাসায়ী ও ইমাম বায়হাকীকে ইমাম শাফেয়ীর সাথে সংশ্লিষ্ট করা হতো। এ অবস্থায় মুজতাহিদ ছাড়া কাউকে কাযীর পরে অধিষ্ঠিত করা হতো না এবং কারো ফতোয়াও গ্রহণ করা হতো না। অর্থাৎ কেবল মুজতাহিদকেই ফকীহ বলা হতো।
এ ছিল মুসলমানদের প্রথম তিন চারশো বছরের বুদ্ধিচর্চা। মুসলিম বুদ্ধিজীবি অর্থাৎ উলামা, ফকীহ ও মুজতাহিদগণ আল্লাহর বিধানের আওতায় বুদ্ধিচর্চা করে সারা ইসলামী বিশ্বে কর্ডোভা থেকে কাশগড় এবং তাসখন্দ থেকে কান্দাহার-মূলতান পর্যন্ত এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক বলয় সৃষ্টি করেন। এ সমগ্র বলয়ে চিন্তার স্বাধীনতার সাথে সাথে আন্তরিকতাও একটি মূল শক্তি হিসেবে সব সময় সক্রিয় থাকে। যখনই আন্তরিকতায় কমতি দেখা দিয়েছে তখনই চিন্তার স্বাধীনতাও ব্যাহত হয়েছে। খিলাফতে রাশেদার পর এমন সব লোক খিলাফত তথা মুসলমানদের ওপর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব লাভ করলো যারা তার যোগ্য ও হকদার ছিল না এবং একই সঙ্গে ফতোয়া দান ও পূর্ণ দীনী ইলমের অধিকারৗও ছিল না। কাজেই পদে পদে তাদের ফকীহগণের দ্বারস্থ হতে হতো। ফকীহ ও আলেমগণের মর্যাদা বেড়ে গেলো। লোকেরা দেখলো আলেমগণ বাদশাহদের এ ড়িয়ে চলতে চান। অনেকে তাদের দরবারে যেতে অস্বীকার করছেন। কিন্তু বাদশাহরা তাদের দ্বারে দ্বারে ধর্না দিচ্ছেন। ফলে একদল লোক মর্যাদা ও ক্ষমতার নৈকট্য লাভ করার জন্য ইলম হাসিলে তৎপর হলো। এ রপর থেকে একদল আলেম বাদশাহদের পেছনে চলতে থাকেন। ফলে এখানে আন্তরিকতা বাধাগ্রস্ত হয়। স্বার্থবাদিতা প্রাধান্য লাভ করে।
ইল্ম ও স্বাধীন বুদ্ধিচর্চা লাঞ্ছিত হয়। এরপরও উলামা ও ফকীহদের একটি দল ক্ষমতার নৈকট্য এড়িয়ে চলে ইলম ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বুদ্ধিচর্চার মর্যাদা সমুন্নত রাখেন। তাদের প্রচেষ্টা ও সাধনায় ইসলামী জ্ঞান চর্চা পরবর্তীকালেও আল্লাহর বিধানের আওতাধীন থেকেছে। অবশ্য শাসকদের প্ররোচনায় ক্ষমতার নৈকট্য প্রত্যাশী উলামায়ে কেরাম দীনের যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বুদ্ধিচর্চাকে মাসায়েল ভিত্তিক বিরোধ ও বিতর্কের চারণভূমিতে পরিণত করেন। এই বিতর্কের ক্ষেত্রে তারা বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেয়ীর বিরোধমূলক মাসায়েল নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করেন। ইমাম মালেক, সুফিয়ান সওরী, ইবনে সিরীন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ অন্যান্য ইমাম ও মুজতাহিদগণের বিরোধমূলক মাসায়েলের প্রতি কম দৃষ্টি দেন। তারা মনে করেন এ ধরনের বিতর্ক ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে তারা জটিলতর সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারবেন। এ ই বিরোধ ও বিতর্কের বদৌলতে তাঁরা অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। অসংখ্য মাসায়েল ইসতিমবাত করেন। তাদের এই কয়েক শো বছরের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে ইজতিহাদ ও নতুন উদ্ভাবনে যেমন ভাটা পড়তে থাকে তেমনি তাকলীদ ও বিশেষ ব্যক্তির রায়ের অনুসরণ করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। কালক্রমে তাকলী সমগ্র মিল্লাতের ওপর জেঁকে বসে এবং মুসলমানরা ব্যক্তির রায়ের ওপর নিশ্চিন্ততা অনুভব করতে থাকে।
মুসলমানদের এ বুদ্ধিচর্চা বর্তমান যুগ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে বুদ্ধির নিষ্ক্রিয়তা ও আল্লাহর বিধানের আওতায় মুক্ত চিন্তায় অনীহার কারণে তাদের ওপর নেমে এসেছে জুলুম শাহী ও বিজাতির পরাধীনতা। বিগত সত্তর আশি বছরে মুসলমানদের চিন্তার অবক্ষয় যেমন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তেমনি কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক চিন্তার একটি নতুন দিগন্তও উন্মোচিত হয়েছে। এটা বিশেষ করে সম্ভব হয়েছে আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আল্লাহর বিধানের আওতা বহির্ভূত সম্সত চিন্তা ও ভাবধারার ব্যর্থতার কারণে। আর এই সংগে মুসলমানরে বিগত তেরশো বছরে ফিকহ চর্চাও একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে। মুআমিলাত, পারস্পরিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, প্রশাসন, আইন আদালত ইত্যাদি প্রত্যেকটি বিষয়ে বিপুল মাসায়েল একত্র হয়েছে।
মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র অংশ এখনো ঐতিহ্যাশ্রয়ী। আল্লাহর বিধানের আওতায় বুদ্ধিচর্চায় তারা বিশ্বাসী। তাদের বৃহত্তর অংশ ইসলাম বৈরী না হলেও বিভ্রান্ত। তবে সার্বিকভাবে সমগ্র মুসলমান সমাজ কুরআন সুন্নাহর অনুগত। ঐতিহ্যাশ্রয়ী মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটি বিশাল অংশে রয়েছে উলামায়ে কেরাম, ইসলামিক স্কলারস ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ। আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে তাদের অনেকের যোগাযোগও যথেষ্ট গভীর। আধুনিক বিশ্ব পরিবেশ সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন। তারা জানেন, আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার যারা পরিচালক তাদের অনেকেই নিজেদের ব্যর্থতা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হওয়ার পরও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে সফলতায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর বিধানের বাইরেই তাদের অবস্থান। আধুনিক প্রযুক্তির বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে তারা বিশ্বকে এমন এক অবস্থায় এনে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন যেখানে সারা দুনিয়া একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। কোনো গভীর চিন্তা ও ধারালো যুক্তি এর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে অগ্রসর হতে ও প্রভাব বিস্তার করতে এখন আর যুগ যুগান্ত এবং বছর ও মাসের পরিধির প্রয়োজন হয়না। আবার সভ্যতা, চিন্তা ও বুদ্ধির বিবর্তনের এমন এক পর্যায়ে মানুষ পৌঁছৈ গেছে যেখানে নিখাদ সত্যকে মেনে নেবার প্রবণতা মানুষের মধ্যে নতুনভাবে জাগ্রত হচ্ছে। এমনিতে সত্যানুসন্ধিৎসা মানুষের স্বভাবজাত। কিন্তু তার পরও যুগে যুগে বিশাল মানবগোষ্ঠী সত্যকে জানার পর তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এসেছে। বর্তমান বিশ্ব সংস্কৃতিতে এধরনের প্রাচীরের সংখ্যা কমে আসছে। প্রাচীন ও মধ্য যুগের তুলনায় আধুনিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনেকটা জিদ ও হঠধর্মিতামুক্ত। সত্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে তাকে গ্রহণ করার মানসিকতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
এই সময় মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিচর্চা পুরোপুরি আল্লাহর বিধানের আওতায় এগিয়ে চলার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আল্লাহর কিতাব ও রসূলের (স.) সহী হাদীস হবে এই বিধানের ভিত্তি। আমাদের সমগ্র ফিকহ, উসূল ও মাকাসিদের পরিসর জুড়ে ব্যক্তিবর্গের যে রায় রয়েছে সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। সেগুলো আমাদের চিন্তা দর্শনের ভিত্তি নয়। আমাদের চিন্তাকে সমন্বিত, সুসংহত ও সঠিক পথাশ্রয়ী করার জন্য সেগুলো হবে সবচেয়ে বড় দিক নির্দেশক ও নজির। আতীয়ুল্লাহা ওয়া আতীয়ূর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম-তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসূলের আনুগত্য করো আর তোমাদের নেতৃবর্গের, এখানে আল্লাহর স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুগত্য এবং রসূলের স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নেতৃবর্গের ক্ষেত্রে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, নেতৃবৃর্গের আনুগত্য হবে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের আওতাধীন। অর্থাৎ তাঁদের সিদ্ধান্ত কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হলে গ্রহণযোগ্য অন্যথায় নয়। পরবর্তী বাক্যে আরো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে; ফা-ইন তানাযা’তুম ফী শাইইন ফারুদ্দুহু ইলাল্লাহি ওয়ার রসূল-’এরপর যদি কোনো ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে সি বিষয়টিকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও রসূলের দিকে।’ (আন নিসা : ৫৯) অর্থাৎ আল্লাহ ও রসূলই হচ্ছেন চূড়ান্ত ফায়সালাকারী ও সীমা নির্দেশক। তোমরা নিজেরা কেবলমাত্র তাঁদের নির্ধারিত সীমানার মধ্যে অবস্থানকারী। আমাদের কাছে আল্লাহ ও রসূলের বিধান মজুদ রয়েছেঃ নিখাদ সত্য ও নির্ভেজাল অহী। এই আলো এবং নূর আর দুনিয়ার অন্য কোনো জাতির কাছে নেই। আমরা এই আলোয় নিজেদের পথ তৈরী করে নিতে এবং সমগ্র দুনিয়াবাসীকে পথ দেখাতে পারি। দুনিয়া এখন এক অর্ডারের আওতায় চলে আসার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এই অর্ডারটা একমাত্র আল্লাহর বিধানই হতে পারে।
আমরা আগেই প্রমাণ করেছি এ বিধানটা চৌদ্দশো বছরের পুরানো নয়, যেমন অজ্ঞতা বশত এবং নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে যথেষ্ট অসচেতন হবার কারণে একদল লোক ধারণা করে থাকে। রিসালাতে মুহাম্মদীর অবসানের পরও যেমন সাহাবায়ে কেরামের পর থেকে তিন চারশো বছর পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সাথে ইজতিহাদের মাধ্যমে এ বিধান কার্যকর হতে থেকেছে। মুসলমানদের শাসনাীন সমগ্র বিশ্ব মানব সমাজ কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো বিধান দ্বারা শাসিত হয়নি। আমরা এ বিধানের আরো একটি পার্শ্ব উৎস ইজমার নাম এ জন্য নিচ্ছিনা যে এটি কুরআন ও সুন্নাহর আওতাধীন। এ সমগ্র সময়ব্যাপী ইসলামী শাসন যুগোপযোগী ছিল এবং ইসলাম বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি পরবর্তী কালেও যখন ইজতিহাদের ধারা ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ হতে থেকেছে এবং তাকলীদ তথা ব্যক্তির রায়ের ভিত্তিতে মুসলমানরা শাসিত হয়েছে তখনো কুরআন ও সুন্নাহর আওতার বাইরে তারা যাননি। কারণ কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে করা ব্যক্তির ইজতিহাদের ভেতরে অবস্থান করেছে মুফতির ফতোয়া। এই ফতোয়ার ভিত্তিতে দেশ, সমাজ ও জনতা পরিচালিত হয়েছে। পরবর্তী যুগে এই মুফতিগণই ফকীহ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে তুর্কী খিলাফতের অবসানের পর এ যুগেরও সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ তেরশো বছর পর্যন্ত এ বিধানটা যেকোনো ফরমে বিশ্ব ব্যবস্থায় টিকে ছিল। এর মূল দুর্বলতা ছিল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি ইজতিহাদের ধারা শুকিয়ে যাওয়া।
প্রতি একশো বছরে বিশ্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমরা দেখেছি অন্যান্য ধর্ম প্রথম একশো বছরেই বিকৃত হয়ে ভিন্নরূপ গ্রহণ করেছে এবং তার পয়গম্বর আনীত ধর্ম স্বরূপে টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু ইসলাম তার দুটি মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহর অবিকৃত থাকার এবং এই সাথে নবীর দেখানো পথে ইজতিহাদের মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবেশের উপযোগী করে ইসলামী বিধানের আওতায় জীবনকে গড়ে তোলার কারণে একদিকে যেমন আল্লাহর পূর্ণ উলুহীয়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তেমনি অন্যদিকে বান্দার উবূদীয়্যাতও পূর্ণতা লাভ করেছে। আর নবীর নবুওয়তের মূল লক্ষই হচ্ছে আল্লাহর পূর্ণ উলুহিয়াত প্রতিষ্ঠা এবং বান্দার উবুদীয়াতকে পূর্ণতা দান করা। প্রথম একশো দু’শো তিনশো বছর ইসলামে এর মধ্যে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। ইসলাম তিনশো বছরে পুরাতন ও সেকেলে হয়ে যায়নি। বরং সমসময়ের প্রেক্ষিতে আধুনিক ও প্রগতিশীল ছিল। বিশ্বের অবস্থান ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগে। ইসলাম তাকে টেনে আনছিল আধুনিক যুগে। তারপর ইজতিহাদের ধারা বিশীর্ণ হতে হতে এবং তাকলীদের পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করতে কয়েক শতক অতিক্রান্ত হয়। মুসলমানরা ইসলাম থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে যতই অপারগ হয়ে পড়ছিল বিশ্বে জাতিদের মধ্যে অস্থিরতা ততই বেড়ে চলছিল। এই অস্থিরতার গর্ভ থেকে পশ্চিমা বিশ্বে যতগুলো পরিবর্তনের জন্ম হয়েছে তার কোনোটাই বিশ্ব মানবতার কল্যাণে টেকসই অবদান রাখতে পারেনি। এক. ধর্ম থেকে রাজনীতি আলাদা হয়েছে। সমাজ সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে চেংগিজী অত্যাচারে জর্জরিত করেছে। অসাধুতা, শঠতা, প্রতারণা, দুর্নীতি, শোষণ ও অকল্যাণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দুই. চিন্তার স্বাধীনতার নামে সততা, নৈতিকতা ও সদাচারের সংগাই পাল্টে দেয়া হয়েছে। ফরাসী বিপ্লব সততা ও নৈতিকতার কোনো স্থায়ী ও কল্যাণকর চিন্তাদর্শন দাঁড় করাতে পারেনি। বরং এর গর্ভ থেকে এক ধরনের ফ্যাসিবাদের দাপট দেখি বিশ্ব জুড়ে। তিন. শিল্প বিপ্লব ইউরোপীয় রেনেসাঁর কোনো কৃতিত্ব নয়। এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিকতার একটি পর্যায়। শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের সামাজিক অবস্থানের যে পরিবর্তন ঘটেছে পশ্চিমা চিন্তাদর্শন তার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারেনি। সামাজিক ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, লুন্ঠন ও শোষণ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ এবং নব্য উপনিবেশবাদী কায়দায় মানুষকে দাসে পরিণত করাই হয়েছে এর নীট ফল। ইসলাম ও মুসলমানরা এক্ষেত্রে নিজেদের কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কারণ সামগ্রিক বিবেচনায় তারাও পশ্চিমা রঙে রঞ্জিত হয়ে গেছে।
এখন পশ্চিমা চিন্তাদর্শনগুলোর ব্যর্থতার পর বিশ্বে যে অশান্তি, অস্থিরতা ও অবিশ্বাস বাসা বেঁধেছে তা দূর করে সমগ্র মানব সমাজে স্বস্তি, শান্তি ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে একমাত্র ইসলাম, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী চিন্তাদর্শন। আল্লাহর উলুহীয়াত ও বান্দার উবূদীয়াত প্রতিষ্ঠাই হবে এর একমাত্র পথ। অর্থাৎ মানুষ এই পৃথিবী পৃষ্ঠে, যতগুলো ক্ষমতা ভোগ করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সম্সত ক্ষমতার একমাত্র উৎস আল্লাহ। তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। আল্লাহ থেকে এ ক্ষমতা লাভ করতে হবে এবং আল্লারহ নির্দেশ মতো একে ব্যবহার করতে হবে। আর মানুষ মানুষের দাস নয়, একমাত্র আল্লাহর দাস, গোলাম ও বান্দা। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী এবং আল্লাহর বিধানকে কার্যকর করার জন্য সে অন্য মানুষের হুকুম পালন করবে। আল্লাহর বিধান বিরোধী কোনো হুকুম সে পালন করবে না (লা তাআতা লি মাখলুকিন ফীমা’সিয়াতিল খালেক : স্রষ্টার বিধান অমান্য করে সৃষ্টির হুকুম পালন করা যাবে না-হাদীস)
এক অর্ডারের এই বিশ্বের যুগে ইসলামই একমাত্র যুগোপযোগী, সর্বাধুনিক ও প্রতিশীল চিন্তাধারা। সারা বিশ্বে একে কার্যকর করার জন্য আল্লাহর বিধানের আওতায় কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইজতিহাদের ধারা একটি স্বীকৃত ও চিরন্তন পদ্ধতি। মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বিশেষ করে উলামা ও ইসলামিক স্কলারর্সদের দায়িত্ব এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী। তারা মিল্লাতের ও মানবতার সবচেয়ে সচেতন অংশ। তাদের অবশ্যই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।