অগ্নিঝরা মার্চ

1

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে পাল্টে গেল পুরো বাংলাদেশের দৃশ্যপট। কারও বুঝতে বাকি থাকল না বঙ্গবন্ধু কি চান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির নির্দেশে পুরোপুরি পাল্টে যায় পুরো দেশের চিত্র। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল বাঙালির। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহ শ্লোগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝা-ায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালনে উত্তাল বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিদ্রোহ-সংগ্রামের তরঙ্গ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির প্রচন্ড বিক্ষোভে একাত্তরের এই দিনে রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয় পাকি শাসকগোষ্ঠীরা।
চোখের সামনে সবাইকে বোকা বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর কৌশলে স্বাধীনতার আহ্বানে হতভম্ভ হয়ে যায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা। বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ভন্ডুলের শেষ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হওয়ায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের নীলনকশা আঁটতে থাকে পাকি শাসক গোষ্ঠী।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণই যে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল তা বুঝতে বাকি রইলো না মুক্তিপাগল বাঙালী জাতিসহ পাক সামরিক জান্তাদেরও। গোটা বাঙালি জাতিই ৭ মার্চের ভাষণ বুঝে গেলেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণেই মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল।
আজ ৮ মার্চ। উনিশ শ’ একাত্তরের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা চূড়ান্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আর ৭ মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্ধুদ্ধ বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন তার পক্ষে দেশবাসী জেগে উঠতে শুরু করে। বাংলার দামাল ছেলেরা নিজেরা দলে দলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলতেই থাকে। এ সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীনতা বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর বাণী রেডিওতে প্রচার না করায় বাঙালি ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বেতার কর্মীদের আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানীরা বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার করতে। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় রেডিওতে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
অন্যদিকে, আগের মতোই উত্তাল জনতা মিটিং-মিছিলে প্রকম্পিত করে রাখে সারাদেশ। ক্ষুব্ধ বাঙালির মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝালো শ্লোগানে উচ্চকিত ছিল সারাদেশ। প্রধান শ্লোগান ছিল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।
এ ক্ষেত্রে বসে নেই কুখ্যাত পাকিস্তানী বাহিনী। তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররাও বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাতে তৎপর। কার্ফু দিয়েও সামরিক জান্তারা সাহসী বীর বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে আঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বাঙালি নিধনের। একাত্তরের উত্তাল, ঝঞাঝাবিক্ষুব্ধ বাংলাদেশে এই দিনটিতে সারাদেশের সকল পাড়া, গ্রাম, মহল্লায় সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়।