অগ্নিঝরা মার্চ

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামীকাল রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমান কি বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বাণীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচির ঘোষণা তিনি ৭ তারিখে দেবেন। কিন্তু এ ক’দিনে ঘটনা তো অন্য খাতে বইছে। এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কার্ফু ভঙ্গ, গুলিতে শয়ে শয়ে লোক নিহত- এর প্রেক্ষিতে তিনি আগামীকাল কি ঘোষণা দেবেন? কেউ কেউ বলছে, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন…। একাত্তরের দিনগুলি শিরোনামের বইয়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আগের দিন ৬ মার্চে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ করেছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। প্রকাশ করেছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার বারতা দেয়ার পূর্বাভাস।
একাত্তরের ৬ মার্চের দিনটি ছিল শনিবার। এদিন বাংলার সংগ্রামী জনতার বিক্ষুব্ধ সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিলে উত্তাল রূপ নিয়েছিল ঢাকা। ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসে রাজপথে। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তাঁরই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারী অফিসে ইতোপূর্বে বেতন দেয়া হয়নি সেসব অফিস বেতন প্রদানের জন্য খোলা থাকে। দিন যতই গড়াচ্ছিল, অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্যও ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কি ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারাদেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। জনসভাটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে তখন কারো সন্দেহ ছিল না। ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কি ঘোষণা দেবেন তা ঠিক করতে বঙ্গবন্ধু দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে চলেছেন।
পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি ততদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব। এ সময় তিনি ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না।
ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।
লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাতকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।
এদিকে পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।
বেলা ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। এছাড়া খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন ১৮ জন এবং আহত হন ৬৪ জন।