কিয়েভে তুমুল লড়াই

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে তুমুল লড়াই চলছে। যুদ্ধের তৃতীয় দিন রুশ বাহিনী শহরটির কেন্দ্রস্থলে ঢোকার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন সেনারা রুশদের প্রতিহত করতে প্রাণপণ লড়ছে। তারপরও কিয়েভে রুশ ট্যাঙ্ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ সময় কয়েক ইউক্রেনীয় লাল পতাকা নেড়ে রুশ বাহিনীকে স্বাগত জানায়। যুদ্ধ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে।
শনিবার ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী মারিয়োপোল দখলে নিয়েছে রাশিয়া। শহরটির একাধিক ভবন ও সামরিক স্থাপনা রুশ হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। ইউক্রেন সেনাদের দাবি, কিয়েভ ছাড়াও পূর্ব এবং উত্তরের কয়েকটি শহরে রুশ বাহিনীর সঙ্গে তাদের লড়াই চলছে। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশ ছাড়ার মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রস্তাবে শনিবার তিনি বলেন, আমাকে নিরাপদে নেয়ার জন্য বিমান পাঠানোর দরকার নেই। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে ওয়াশিংটন আমাদের গোলাবারুদ সরবরাহ করুক। এরই মধ্যে কয়েকটি রুশ গণমাধ্যমে চাউর হয়েছে, কিয়েভ ছেড়ে পালিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তবে এ বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্য খবর পাওয়া যায়নি। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলছেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে মস্কোর কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন নেই। পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তিনি এই মন্তব্য করেন।
মেদভেদেভ বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মস্কো ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখবে। কাউন্সিল অব ইউরোপ বা ইউরোপীয় পরিষদ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কারের নিন্দায় শনিবার তিনি এ মন্তব্য করেন।
শনিবার এক বিবৃতিতে ইউক্রেন সরকার জানায়, এ মুহূর্তে কয়েকটি শহরের রাস্তায় রাস্তায় লড়াই চলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে এবং জানালা ও বারান্দার কাছে না আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইউক্রেন বলছে, রুশ বাহিনী রাজধানী পুরোপুরি দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। এরপর তারা দেশটির নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, কিয়েভের ওপর রুশ হামলার শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক মাইল দূর পর্যন্ত তা শোনা যায়। এ অবস্থায় ভলোদিমির জেলেনস্কি কিয়েভে হামলা প্রতিহত করার অঙ্গীকার করেন। তিনি ইউক্রেনীয়দের সতর্ক করে বলেন, তারা কোন অবস্থাতেই রাজধানীকে হারাতে পারবে না। এ অবস্থায় কয়েক হাজার জণগণের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় ইউক্রেন। ওদিকে শেষ পর্যন্ত রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের শান্তি এবং যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ইউক্রেন। শনিবার জেলেনস্কির প্রেসসচিব সের্গেই নিকিফোরভ এ কথা জানান। সের্গেই নিকিফোরভ ফেসবুকে লিখেছেন, আমাকে এই অভিযোগ এড়াতে হবে যে আমরা আলোচনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছি। ইউক্রেন সব সময়ই শান্তি ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত। এটি আমাদের স্থায়ী অবস্থান। আমরা রাশিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, আলোচনার জন্য স্থান ও সময় নির্ধারণ নিয়ে কথাবার্তা চলছে। যত তাড়াতাড়ি আলোচনা শুরু হবে, তত বেশি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবে। শুক্রবার রাশিয়া ইউক্রেনকে অস্ত্র ছেড়ে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। তিন দিনের এই যুদ্ধে নারী ও শিশুসহ উভয় পক্ষে কয়েক শ’ সৈন্য নিহত হয়েছে। এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র চেরনোবিল থেকে বিপজ্জনক গামা রশ্মির বিকিরণ বেড়েছে বলে ইউক্রেন দাবি করেছে। রুশ বাহিনী শুক্রবার চেরনোবিলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ওই এলাকায় গামারশ্মি বিকিরণের মাত্রা অন্তত ২০ গুণ বৃদ্ধির দাবি করেছে কিয়েভ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রুশ সৈন্যদের ফিরে আসা উচিত। ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে মস্কো ভেটো দেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কখনই হাল ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই শান্তি স্থাপনে কাজ করা উচিত।
ইউক্রেনে রকেট পাঠাচ্ছে নেদারল্যান্ডস : ইউক্রেনে যত দ্রুত সম্ভব ২০০টি এয়ার ডিফেন্স রকেট পাঠাবে নেদারল্যান্ডস। দেশটির সরকার শনিবার পার্লামেন্টে এক চিঠিতে এ কথা জানায়। ইউক্রেনের অনুরোধের ভিত্তিতে নেদারল্যান্ডস এসব রকেট পাঠাতে যাচ্ছে।
আমাকে বন্দী করার পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়া হয়েছে : রাশিয়া রাতারাতি তাকে পাকড়াও করে পছন্দের নেতাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল বলে দাবি করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। শনিবার এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, তাদের সেনাবাহিনী রাশিয়ার ওই পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে।
যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে : ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে করছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। শনিবার এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিশ্বকে প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। সকালে প্যারিসে শুরু হওয়া বার্ষিক কৃষি মেলা উদ্বোধন করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইউরোপে যুদ্ধ ফিরে এসেছে। এই যুদ্ধ বেছে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং একটি দুঃখজনক মানবিক পরিস্থিতিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পুতিনের পক্ষে লড়তে তৈরি হাজারো চেচেন : ইউক্রেন হামলায় যোগ দিতে তৈরি রাশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ চেচনিয়া অঞ্চলের কয়েক হাজার বাসিন্দা। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অভিযানের সমর্থনে শুক্রবার রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার চেচেন। চেচনিয়া অঞ্চলের রাজধানী গ্রোজনির কেন্দ্রীয় চত্বরে অন্তত ১২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক জড়ো হয়ে পুতিনের পদক্ষেপকে সমর্থন জানান। অঞ্চলটির নেতা রামজান কাদিরভের নেতৃত্বে হয় এ সমাবেশ। কাদিরভ বলেন, এখানে সবাই স্বেচ্ছাসেবক, যারা দেশ ও দেশের জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে যে কোন অভিযানের জন্য প্রস্তুত। আমরা সুপ্রিম কমান্ডার ইন চীফ পুতিনের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। চেচেনের ন্যাশনাল পলিসি মিনিস্টার আখমেদ দুদায়েভের বলেন, স্বদেশ রক্ষায় আমরা কতটা প্রস্তুত তা জানান দেয়াই সমাবেশের উদ্দেশ্য। এটি আমাদের জন্য একটা পরীক্ষা। প্রেসিডেন্ট পুতিনের আদেশ পালনে আমরা কতটা প্রস্তুত তা বোঝাতে এই আয়োজন। সেন্ট্রাল গ্রোজনিতে সমবেত চাকরিজীবীদের সামনে দেয়া বক্তব্যে কাদিরভ অবিলম্বে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে পুতিনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জেলেনস্কিকে পরামর্শ দিতে চাই। তিনি যেন আমাদের প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করে ক্ষমা চান। ইউক্রেন রক্ষায় এটি করুন। চেচনিয়া রাশিয়ার বিশেষ সাংবিধানিক অঞ্চল। উত্তর ককেশাসে পূর্ব ইউরোপের দক্ষিণ অংশে কাস্পিয়ান সাগরের কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে প্রায় ১৪ লাখ মানুষের বসবাস, যাদের বেশিরভাগ চেচেন জাতিগোষ্ঠীর। কিছু রুশ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন। স্বাধীনতার দাবিতে এক সময়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছিলেন চেচেনরা। তবে তা কঠোর হাতে দমন করে মস্কো।
ইউক্রেনকে মার্কিন সহায়তা : ইউক্রেনকে ৬০ কোটি ডলার সহায়তা দিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিনকেনকে নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ বিষয়ক আইনী ধাপসমূহের দ্রত সুরাহা করতে ব্লিনকেন চিঠিও দিয়েছেন। চিঠিতে বাইডেন বলেন, ইউক্রেনে মোট ৬০ কোটি ডলার পাঠানো হবে। তার মধ্যে ৩৫ কোটি ডলার ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ও ২৫ কোটি ডলার দেশটির বেসামরিক খাতসমূহের জন্য বরাদ্দ থাকবে।
পুতিনের পাশে আসাদ : ইউক্রেন ইস্যুতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। শনিবার সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের দফতরের এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেন পুতিন। তিনি বলেন, মস্কো পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। পুতিন ইউক্রেন সম্পর্কে বলেন, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি। একটি পুতুল সরকার ইউক্রেন চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ইউক্রেন কোনদিনই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না এবং আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। পুতিনের এ বক্তব্যের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, আমরা শান্তি এবং কূটনৈতিক পথের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এই পথ অনুসরণ করব এবং কেবল এটিই করব। আমরা নিজেদের ভূমিতে আছি। আমরা কোন কিছু এবং কাউকে ভয় পাই না। আমরা কাউকে পরোয়া করি না, কাউকে দেশ দখল করতে দেব না। তিনি আরও বলেন, আমাদের অংশীদারদের কাছ থেকে পরিষ্কার এবং ফলপ্রসূ পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। কারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু এবং অংশীদার, সেটি দেখাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।