বাংলা বানান রীতির ক্রমবিকাশ ও শুদ্ধ বানান চর্চার প্রয়োজনীয়তা

34

মো. আব্দুল মালিক :

মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের নিকট শ্রদ্ধা ও গৌরবের। আমাদের মায়ের ইতিহাস গৌরবের হলেও আমাদের মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির ইতিহাস একদিকে খুবই বেদনাদায়ক, অন্য দিকে গৌরবের। আমাদের হাজার বছরের পুরাতন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ আবি®কৃত হয়েছে নেপালের রাজ দরবারের পুঁথিশালা থেকে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কার করেন। এতে অনুমিত হয় তৎকালে বাংলা ভাষীরা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন এবং কেউ কেউ লুকিয়ে তাদের সাহিত্যকর্ম সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। তারপর বাংলা নামক এই ব-দ্বীপ বহুবার বিদেশীদের দ্বারা শাসিত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ এসেছে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি, উর্দুওয়ালাদের পক্ষ থেকে। বাঙালি জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরাতন। এই সুদীর্ঘ সময়ে বাঙালিরা কখনো স্বাধীন বা শাসক ছিলেন না। আমরা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট একবার এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আরেকবার স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭১ সালে আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে শাসকের মর্যাদা লাভ করি। সম্প্রতি প্রতিবেশি রাষ্ট্র মায়ানমার থেকে যেভাবে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, ঠিক একই ভাবে ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের প্রায় এক কোটি বাঙালি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দু’লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা কারো দানে পাওয়া নয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ অঞ্চলের মানুষ মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে জীবন দিয়েছেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর অঞ্চলের ১১ জন বাঙালি। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন জাতিকে তাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য এভাবে জীবন দিতে হয়নি।
মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য আমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দান করেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাঙালির ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন, যা জাতিসংঘের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অর্ন্তভূক্ত হয়েছে। ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ২৪৭তম বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চালিক অনেক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে প্রথম, বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আরো ২ জন বাঙালি অন্য বিষয়ে নোবেল পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ি বিশ্বের প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। জনসংখ্যার এই হিসাবে বাংলা ভাষা বর্তমান বিশ্বের ৪র্থ বা ৬ষ্ঠ বৃহত্তম জনগোষ্ঠির ভাষা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। অদুর ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের মর্যাদা পাবে। এসব আমাদের অর্জন। এসব অর্জনকে ধরে রেখে বিশ্বে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে আমাদের ভাষাকে সঠিক ও শুদ্ধভাবে বিশ্বসভায় উপস্থাপন করতে হবে।
ভাষা হচ্ছে নদীর স্রোতের মত গতিশীল। পৃথিবীর যেকোনো ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের বাংলা ভাষা ও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা আর আজকের আধুনিক কবিতার ভাষার মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে তা অত্যন্ত স্পষ্ট।
ভাষা সমাজের দান এবং সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হয়। তাই সামাজিক শৃঙ্খলার মতো ভাষার শৃঙ্খলা ও বজায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তির ব্যাপকতায় একটি ভাষার অধঃপতন অনিবার্য। তুলনামূলক ভাবে বাংলা ভাষার যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা কিংবা অরাজকতা বিরাজমান তা হলো বাংলা বানান। বানান হলো ভাষার একটি প্রায়োগিক দিক। ভাষার চেহারা নির্ভর করে বানানের উপর। বাংলা বানানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ বা সরলীকরণের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের হলেও ভাষার এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলার অবসান হয়নি। অনেকটা অজ্ঞতায় এবং অনেকটা অহমিকায় বাঙালির লিখিত ভাষায় বানান ভুলের সংখ্যা সত্যি লজ্জাজনক। আজকাল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বানান ভুল করা যেন এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শুধু ছাত্র-ছাত্রী কেন? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, তথা বাংলা ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই সর্বশেষ বানানরীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। তাছাড়া বর্তমানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ও অন্যান্য ডিভাইসে বাংলা লিখতে গিয়ে শুদ্ধ বানান জানা থাকা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র ফন্ট এর কারনে বানান ভুল হচ্ছে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলের শুদ্ধ ও সর্বশেষ বানানরীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন এবং কম্পিউটার, মোবাইলসহ অন্যান্য ডিভাইসে প্রমিত বানানরীতির একই ফন্ট সেট করা প্রয়োজন।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা বানানের কোন নির্দিষ্ট মানদন্ড ছিল না। তখনকার লেখকরা নিজস্ব বানান রীতি অনুসরণ করতেন ফলে বানানের ক্ষেত্রে সর্বত্র সমতা বিরাজ করতনা। উনিশ শতকে যখন বাঙালি লেখকদের হাতে বাংলা ব্যাকরণ রচিত হতে থাকে তখন রচয়িতাদের নিকট বানানের বিশৃংখলা প্রকটভাবে ধরা পড়ে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চলতি গদ্যরীতির আবির্ভাব ঘটে এবং সাহিত্যাঙ্গনে ব্যাপক ভাবে এর ব্যবহার শুরু হয়। ফলে তৎসম শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এতে বাংলা বানানে কিছু বিশৃংখলা দেখা দেয়। এসময় পন্ডিতরা বাংলা বানানের সংস্কারে উদ্যোগি হন। ১৯২৫ সালে বিশ্বভারতীর উদ্যোগে চলতি ভাষার বানানের জন্য একটি রীতি বা নিয়ম গৃহীত হয়। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এই বানানরীতি নির্ধারণ করেন এবং মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তা দেখে দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে এই বানানরীতি অনুমোদন করেন। অধ্যাপক প্রশান্ত মহলান বিশ এর উদ্যোগে বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র রচনাবলী এই বানানরীতিতে প্রকাশিত হয়। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের বিশৃংখলা দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজশেখর বসুকে সভাপতি ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সম্পাদক করে এক সমিতি গঠন করে। এই সমিতির সুপারিশকৃত বাংলা বানানের নিয়ম ১৯৩৬ সালের ৮ মে প্রথম সংস্করণ ও অক্টোবর মাসে তারই কিঞ্চিত পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালের মে মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রর্বতিত বানানরীতির পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত এই বানানরীতি সর্বাধিক মান্য হলেও সর্বজন গ্রাহ্য ছিল না। বিশ্বভারতীসহ সৃজনশীল অনেক সাহিত্যিকরা এই বানানরীতি সর্বাংশে মেনে নেননি। যার প্রমাণ শ্রী দেব প্রসাদ ঘোষ লিখিত “বাঙ্গালা ভাষা ও বাণান” বইটি যা ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। এখানে ‘বানান’ শব্দের ‘বাণান’ লক্ষণীয়। ১৯৪১ সালে শ্রী ক্ষিতীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেন ‘শব্দ কথা, প্রথম আশ্বাষ’। উক্ত বই দুটো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত বাংলা বানানের নিয়মের ক্রটি ও জটিলতা নিয়ে লেখা। তাছাড়া বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানরীতির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। ফলে বাংলা বানানে বিশৃংখলা রয়েই যায়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে বাংলা ভাষীরা দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েন। পাকিস্তানে প্রথম থেকেই বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালার বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্র হয়। ইসলামী আদর্শের নামে বাংলা ভাষার জন্য ‘আরবি’ বা প্রকারান্তরে ‘উর্দু’ হরফ প্রচলনের চেষ্টা চলে। তাছাড়া বাংলা বর্ণমালার পরিবর্তে রোমান হরফ গ্রহণের অপচেষ্টা চালানো হয়। বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য ১৯৪৯ সালের ৯ই মার্চ তদানীন্তন পূর্ব বাংলা সরকারের উদ্যোগে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মৌলানা আকরাম খাঁ। এই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে পঠিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তার অসারতা প্রমাণ করেন। তদানীন্তন বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে বাংলা বানান সংস্কারের উদ্দেশ্যে আরো একটি কমিটি গঠিত হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, মুহম্মদ ফেরদাউস খান, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আবুল কাশেম প্রমুখ এই কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঃ, ঈ এবং ‘ ী ’- কার বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুলাহর একান্ত আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল আরো একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলা বানান, ব্যাকরণ ও বর্ণমালা সংস্কার এবং সরলায়ন। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, কাজী দীন মুহাম্মদ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আবুল কাসেম প্রমুখ এই কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটি প্রায় ১১ মাস পর তাঁদের সুপারিশ একাডেমিক কাউন্সিলের নিকট জমা দিলেও তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। কারণ পূর্ব বাংলার লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহল এই সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে সাক্ষরিত এক যুক্ত বিবৃতিতে মুহাম্মদ এনামুল হক, মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও মুনীর চৌধুরী এই সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে উল্লেখ করেন, “ বাংলা লিপি ও বানান সরলায়ন ও সংস্কারের কোন আশু প্রয়োজন নেই।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বানানের নিয়ম সমিতি’ ১৯৮০ সালে বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঞ, ণ, ঈ কার এবং য-ফলা বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তাদের এই সুপারিশ কার্যকর হয় নি। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই বাংলা বানান সংস্কারের প্রস্তাব দেন।
আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৯১ সালে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’- নামক ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা ব্যবহার বিধি প্রকাশ করে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-পাঠ্য পুস্তকে বাংলা বানানের সমতা বিধানের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটি ১৯৮৮ সালে কুমিল্লার বার্ডে একটি বড় ধরণের কর্মশিবির আয়োজন করে বেশ কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করে। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে এই কর্ম শিবিরে গৃহীত সিন্ধান্ত অনুযায়ি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পাঠ্য বইয়ের বানান নামে ড. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে এবং এই নিয়ম অনুযায়ি বোর্ডের বই মুদ্রিত হতে থাকে। এই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন হায়াৎ মামুদ, জামিল চৌধুরী, বশির আল হেলাল, মাহবুবুল হক প্রমুখ। বাংলা বানানকে প্রমিত করার লক্ষ্যে তথা সর্বজন গ্রাহ্য নিয়ম চালু করার উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা একাডেমি একটি উদ্যোগ নেয়। এ জন্য ড. আনিসুজ্জামান কে সভাপতি, বশির আল হেলালকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। এই কমিটির রির্পোট ১৯৯২ সালের নভেম্বরে গৃহীত হয় এবং মতামত নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিকট পাঠানো হয়। এই কমিটির রিপোর্ট ১৯৯৪ সালে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। ২০০০ সালে এই নিয়মের কিছু সূত্র সংশোধন করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের পাঠ্যপুস্তকে এবং সরকারি বিভিন্ন কাজে বাংলা একাডেমি প্রণীত বানানরীতি অনুসরণ করার সিন্ধান্ত গ্রহণ করে পরিপত্র জারি করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পর্যালোচনা করে এবং প্রয়োজনীয় পরিমার্জনার পর পুণঃমুদ্রণের সিন্ধান্ত গ্রহণ করে। সে অনুযায়ি পরিমার্জিত সংস্করণ সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রকাশিত হয়।
বাংলা একাডেমি হচেছ বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও গবেষণার সর্বোচ্চ জাতীয় প্রতিষ্ঠান। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে এবং সরকারি কাজে বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের সিন্ধান্ত নিয়েছেন। ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি ও প্রমিত বানানরীতির অনুসরণে একাধিক সমৃদ্ধ বাংলা অভিধান রচনা করেছেন। বাংলা অভিধানের পরিশিষ্টে বা পুস্তিকাকারে প্রমিত বাংলা বানানরীতি সহজলভ্য। তাই বাংলা ভাষা-ভাষী সবারই উচিত আমাদের মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে সর্বশেষ বানানরীতিতে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করা। এর মাধ্যমে আমরা পারব আমাদের মাতৃভূমিকে উন্নত বিশ্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে।
তথ্যসূত্র:
১। বাংলা বানানের কথা- অধ্যাপক আব্দুর রহিম।
২। বাংলা বানানের নিয়ম- ড. মাহবুবুল হক।
৩। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা আকাঙ্খা ও বাস্তবতা- স্বরোচিষ সরকার।
৪। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম- বাংলা একাডেমি।