কুলাউড়ায় একটি পরিবারকে সমাজচ্যুতের ঘটনায় মসজিদ কমিটির মুচলেকা

9

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বিদেশে পড়তে যাওয়া নরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা সনাতন ধর্মাবলম্বী একজনকে বিয়ে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা নিয়ে সমাজচ্যুতির ঘটনায় মুচলেকা দিয়েছে স্থানীয় মসজিদ কমিটি।
১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এ বিষয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে স্থানীয় মসজিদ কমিটির লোকজন ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ না করার ব্যাপারে লিখিত মুচলেকা দিয়েছেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী, কুলাউড়ার ওসি বিনয় ভূষণ রায়, ভাটেরা ইউপির চেয়ারম্যান এ কে এম নজরুল ইসলাম, ভাটেরা বাজার মসজিদ কমিটির সভাপতি মাখন মিয়া, সম্পাদক আমিন মিয়া, তরুণীর বাবা আবদুল হাই চৌধুরীসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ব্যাপারে মসজিদ কমিটির সভাপতি মাখন মিয়া বলেন, ইন্টারনেট কি জিনিস বুঝি না। গ্রামের কিছু লোক ভুল বুঝিয়ে এ কাজ করিয়েছে। এজন্য আমরা অনুতপ্ত। আমরা মসজিদ কমিটির সবাই তাদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেছি এবং ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়েছে। আগামীতে এ ধরনের কোন কিছু হবে না।
কুলাউড়ার ইউএনও এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক প্রবীণ লোক। ইন্টারনেট, ফেসবুক সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। ফেসবুকে ঝর্ণার ছবি দেখে এলাকার কিছু লোক আপত্তিকর কথাবার্তা রটাচ্ছিলেন। এসব কথা তাদের কাছে যায়। এ বিষয়ে তরুণীর বাবাকে মসজিদে ডেকেছিলেন। ঝর্ণার বাবা না যাওয়ায় মসজিদ কমিটি পরিবারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
বৈঠকে কমিটির লোকজন পরোক্ষভাবে তাদের নিজ দোষ স্বীকার করে এবং এ কাজের জন্য অনুতপ্ত হন। এ ব্যাপারে তারা লিখিত মুচলেকা দিয়েছে। ঝর্ণার বাবাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
প্রসঙ্গত কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হাই চৌধুরীর বড় মেয়ে নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা সিলেট নগরে অবস্থিত মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে ‘পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি বাংলাদেশ’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বর্তমানে তিনি ওই সংগঠনের সমন্বয়ক।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর নুরুননাহার উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে অবস্থানরত একই সংগঠনের চেয়ারম্যান ও নুরুননাহারের শিক্ষক একই এলাকার বাসিন্দা জয়তূর্য চৌধুরী বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান। পরে জয়তূর্য নুরুননাহারের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা জানিয়ে ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন। ওই ছবি ঘিরে ২৮ জানুয়ারি ভাটেরা বাজার মসজিদ কমিটি নুরুননাহারের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়। এ বিষয়ে তরুণীর বাবা ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আমিন মিয়ার জানান, ঝর্ণা যুক্তরাষ্ট্রে সনাতন ধর্মাবলম্বী একজনকে বিয়ে করেছে, তাই তার পরিবারকে সর্তক করা হয়েছে। তবে বিয়ের বিষয়টি অস্বাকীর করে ঝর্ণা বলেন,এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
৩১ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে ঝর্ণার বাবা আব্দুল হাই চৌধুরী ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
তাতে বলা হয়েছে, ঝর্ণা ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলেন। একটি সামাজিক সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কও ছিলেন তিনি। নারী অধিকার নিয়ে তিনি বিভিন্ন কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে এলাকার কিছু মানুষের বিরাগভাজন হন ঝর্ণা।
আব্দুল হাই জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝর্ণার নামে কুৎসা রটান কিছু লোক। এ ঘটনায় সিলেট শাহপরাণ থানায় জিডিও করেছিলেন ঝর্ণা। পরে গত ২৬ ডিসেম্বর উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা চলে যান।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আমেরিকায় অবস্থানরত ঝর্ণার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে এলাকায় নানা অপবাদ প্রচার করে একটি গোষ্ঠি। বলা হয়, ঝর্ণা নাস্তিক হয়ে গেছেন। এরপর স্থানীয় মসজিদ কমিটি সভা ডেকে আব্দুল হাইয়ের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়। এ ঘটনায় তিনি সামাজিকভাবে চাপে আছেন।
ঝর্ণার ভাষ্য, ‘গত ২৬ ডিসেম্বর আমি উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় আসি। ২৭ ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় একটি মৌলবাদী গোষ্ঠি ফেসবুকে আমাকে নিয়ে কুৎসা রটাতে থাকে। বিদেশ গিয়ে ছোট কাপড় পরছি, নাস্তিক হয়ে গেছি- এই সেই নানা কিছু গল্প তারা তাদের মতো বানাতে থাকে।
স্থানীয় ভাটেরা বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটি আমার বাবা আব্দুল হাইকে জুমার নামাজের সময় সালিশ বৈঠক ডাকেন। গুরুতর অসুস্থ থাকায় বাবা যেতে পারেননি। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মাখন মিয়া ও সম্পাদক আমিন মিয়ার নির্দেশে আমার পরিবারকে এক ঘরে করে দেয়া হয়।
গ্রামের অতি উৎসাহী কিছু মানুষ স্থানীয় মসজিদে আমাকে নিয়ে সালিশ ডাকেন। আমার বাবাকে সেই বিচারে উপস্থিত হতে বলেন, কিন্তু ৭০ বছর বয়সী আমার বাবা ইতোমধ্যে তিনবার স্ট্রোক করেছেন। চিকিৎসক বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এটি সমাধান হয়ে যাবে। এবিষয়ে মেয়ের বাবার সাথে কথা হয়েছে।