অজ্ঞাতনামা ৭৮ শতাংশ লাশই শনাক্ত হয় না ॥ পরিচয় শনাক্তে পিবিআইয়ের ৪৭ ইউনিট কাজ করছে

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশে অজ্ঞাতনামা লাশের ৭৮ শতাংশই শনাক্ত হয় না। হতভাগ্যরা হয় বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে দাফন করা হয়। জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী, পরিবারপরিজন, পড়শীরা শেষবারের মতো প্রিয় মুখটি দেখতেও পারেন না। অজ্ঞাতনামা লাশ শনাক্তের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। অজ্ঞাতনামা লাশ শনাক্তের সিস্টেম ডেভেলপ করা হচ্ছে। দেশে অজ্ঞাত লাশ শনাক্তের ৪৭টি ইউনিট স্থাপন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রাজধানীতে গড়ে প্রতি মাসে ৭০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। প্রতিবছর ১ হাজারের বেশি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে সংগঠনটি। যেসব বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই নারী। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাইবার ক্রাইম এ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব ও আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম তথ্য সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সারাদেশে উদ্ধার অজ্ঞাতপরিচয় লাশের বেশিরভাগেরই পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। গত প্রায় তিন বছরে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশের ৭৭ দশমিক ৯৬ ভাগেরই পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। আর যাদের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে তাদের ২০ ভাগ হত্যাকা-ের শিকার। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে গত বছরের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২ হাজার ৪৩৩টি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে কাজ করে পিবিআই। এর মধ্যে পরিচয় শনাক্ত হয় ৫৩৬টি লাশের, যাদের মধ্যে পুরুষ ৩৯৭ ও নারী ১৩৯ জন। পরে অনুসন্ধান করে পিবিআই জানতে পারে, পরিচয় শনাক্ত হওয়া এসব লাশের ১১০ জন হত্যাকা-ের শিকার।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্নস্থান থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের বেশিরভাগই সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ভবঘুরে কিংবা ছিন্নমূল মানুষ। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর সেগুলো শনাক্তের জন্য পিবিআই ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন এ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এফআইভিইএস) ব্যবহার করে থাকে। লাশ শনাক্তের এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় একটি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার দিয়ে আঙ্গুুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়, এরপর ঘটনাস্থল থেকে তথ্য পাঠানো হয় পিবিআইয়ের ক্রাইম এ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে। সেখান থেকে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারের সহায়তায় পরিচয় শনাক্ত করা হয়। যাদের তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারে আছে শুধু তাদের পরিচয় মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই বের করা যায়।
অজ্ঞাত লাশের বেশিরভাগের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার কারণ হচ্ছে, অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশের একটি বড় অংশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকে না। এছাড়া ইটভাঁটি, হোটেলে পানির কাজসহ বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে অনেকের হাতের আঙ্গুল (ফিঙ্গার) ক্ষয় হয় এবং পচে যাওয়া অনেক লাশের আঙ্গুল বিকৃত হয়ে যায়। ফলে নির্বাচন কমিশন তথ্যভান্ডারে থাকা তাদের এনআইডির ফিঙ্গার প্রিন্টের সঙ্গে পরবর্তীকালে আর মেলে না। একইভাবে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হওয়া অজ্ঞাত অনেকের পরিচয়ও মেলানো যায় না। জাতীয় নির্বাচন কমিশনে থাকা তথ্য অনেক আগের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থায় নেয়া। সে কারণে মেলানোর সময় কারিগরি সমস্যা হচ্ছে। এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। শনাক্ত না হওয়া ১ হাজার ৮৯৭টি লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, অজ্ঞাত লাশ শনাক্তের সিস্টেমটি ডেভেলপ করছে পিবিআই। সারাদেশে আমাদের ৪৭টি ইউনিট অজ্ঞাত লাশ শনাক্তের কাজ করে থাকে। সব জায়গায় আমাদের ইউনিট খোলা হয়নি। তবুও দূরে কোথাও স্পর্শকাতর লাশ উদ্ধার হলে সেখানেও আমরা গিয়ে শনাক্তের চেষ্টা করি। অনেকে ফিঙ্গারের ছাপ বারবার নিতে নিতে দক্ষ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে একটি লাশের তথ্য পাঁচজনের সঙ্গে মিলেছে। সেখান থেকে যাচাই করে পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুন-জুলাই মাসে সাভার-আশুলিয়া মহাসড়কে অন্তত দুটি মরদেহ পাওয়া যায়। তারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পিবিআই। ওই দুই লাশের ফিঙ্গার প্রিন্ট মিল পাননি পরিচয় শনাক্ত করতে যাওয়া পিবিআই টিমের কর্মকর্তারা। কারণ ওই দুই লাশের কোন তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় তারা ভবঘুরে। গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর তুরাগ দিয়াবাড়ীর ঝাউবন এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পিবিআই এফআইভিইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করে। পিবিআই জানতে পারে উদ্ধার হওয়া তরুণীর নাম পারভীন ওরফে ফেন্সি। তার বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার এলাকার সরকারপাড়া গ্রামে। তিনি রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। এ ঘটনায় গৃহকর্তা সৈয়দ জসীমুল হক এবং গৃহকর্ত্রী সৈয়দা সামিনা হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, এটি একটি হত্যাকান্ড।
পিবিআই সাইবার ক্রাইম এ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের এফআইভিইএস শাখায় কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লাশ শনাক্ত করার পদ্ধতি নিয়ে পিবিআই কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালে এসে তারা পুরো ব্যবস্থাটি দাঁড় করায়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে কাজ শুরু করে। যাদের এনআইডি নেই এবং যাদের বয়স ১৮ বছরের কম এই প্রযুক্তিতে তাদের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত অসংখ্য ক্লুলেস হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি ডিভাইস দিয়ে লাশ শনাক্তের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে সারাদেশে পিবিআইয়ের সব ইউনিটে ৬৬টি ডিভাইস রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দুর্ঘটনা, হত্যা, আকস্মিক অসুস্থতায় মৃত্যু কিংবা অন্য কোন কারণে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়ে হাসপাতাল মর্গে ঠাঁই হয় তাদের। অনেক চেষ্টার পরও স্বজনদের সন্ধান না পাওয়ায় লাশগুলোকে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ হিসেবে ঘোষণা করে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ- যাকে বলে বেওয়ারিশ লাশ। একপর্যায়ে এই বেওয়ারিশ লাশের ঠাঁই হয় ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ নামে দাতব্য সংস্থায়। তারাই সম্পন্ন করে এসব লাশ দাফনের প্রক্রিয়া।
রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় সম্প্রতি ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধের (৬৫) মৃত্যু হয়েছে। তার পরনে ছিল সাদা ছাপার লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই বৃদ্ধের। তবে নিহতের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) টিম পরিচয় জানতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে কাজ করছে। পরিচয় না পেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এভাবেই অজ্ঞাত লাশের শেষ ঠিকানা হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ কিছুদিন মর্গে থাকার পরে বেওয়ারিশ হিসেবে আমাদের কাছে আসে। পরে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক নিখোঁজ ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন আঞ্জুমানে ভিড় করলেও আমরা সঠিক তথ্য দিতে পারি না। যদি লাশের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির ছবি পাওয়া যেত তাহলে খুব সহজেই স্বজনরা ওই ছবি দেখে তাদের শনাক্ত করতে পারত। তবে বেশিরভাগ লাশেরই খোঁজ করতে কেউ আসে না এখানে। যেসব পরিবারে কোন ব্যক্তি নিখোঁজ থাকে দীর্ঘদিন, তারাও একদিন ভুলে যায়। আবার অনেকের আশা থাকে একদিন হয়তো নিখোঁজ ব্যক্তিটি পরিবারের কাছে ফিরে আসবে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, একটি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ শনাক্তের জন্য তিন মাস তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রথমে ময়নাতদন্ত হয়, পরিচয় জানার জন্য আঙ্গুলের ছাপ থেকে এনআইডির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা হয়। প্রাথমিকভাবে যদি পরিচয় না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে ডিএনএ নমুনা নিয়ে সিআইডিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া মামলা হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এরপর সবগুলো থানাকে লাশ সম্পর্কে জানানো হয়। এরপরও যখন পরিচয় মেলে না তখন বেওয়ারিশ লাশের ঠিকানা হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের একজন কর্মকর্তা জানান, উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করে থানা পুলিশ। সবশেষ যখন পরিচয় মেলে না তখন আসে আমাদের কাছে। আমরা সেই মরদেহের সব কাজ শেষ করে দাফনের ব্যবস্থা করি। তবে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কিছু তথ্য রাখা হয়। ছবিও তুলে রাখা হয়। কিন্তু অধিকাংশ লাশ বিকৃত থাকায় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। বেওয়ারিশ লাশের ওয়ারিশ বা পরিবার-পরিজনের খবর পাওয়া যায় হাজারে দুই থেকে তিনটা। তবে অনেক সময় লাশগুলো এমন অবস্থায় আনা হয় যে, সেগুলোর বেশিরভাগই শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। দেখা যায়, এক দিনে ১৫ থেকে ২০টা লাশ দাফন করা হয়। সেক্ষেত্রে কার কবর কোনটা সেটাও বলা যায় না। এ ছাড়া আমাদের নিজস্ব কোন কবরস্থান নেই। নিজেদের কবরস্থান হলে তা সংরক্ষণ বা নাম্বারিং করা যেত এবং সহজে খুঁজে বের করা যেত। তবে যদি কোন পরিবার এসে একটা টাইম লিমিট বলতে পারেন যে, ওই সময়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটেছে বা ব্যক্তির বর্ণনা দিতে পারেন তাহলে আমরা আমাদের নথি ঘেঁটে মেলানোর চেষ্টা করি। তবে এসব কেসের সংখ্যা খুবই কম হয়।