ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের রেকর্ডে মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড হয়েছে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে। ১০ম ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এ পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ৩৬০ জন। তিন হাজার ৯৯২টি ইউপিতে শতাংশের হিসাবে ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিনা ভোটে।
সামনে দেড়শ’র মতো ইউপির তফসিল চলমান। ওই ধাপের ফলাফলের পর এ সংখ্যা আরও বাড়বে। বিনা ভোটে জয়ীরা সবাই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। আর এটাই কিছুটা মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলের জন্য।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত নবম ইউপি নির্বাচনে ২১২ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন বিনা ভোটে। পাশাপশি সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের সদস্য পদেও বিনা ভোটে জয়ের রেকর্ড হচ্ছে এবার। চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদে মোট এক হাজার ৭১৫ জন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া।
এ ধরনের বিজয়কে গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয় উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পর্যালোচনা করছে বিষয়টি।
গত বৃহস্পতিবার ষষ্ঠ ধাপে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল। ইসি থেকে শনিবার ২১৯টি ইউপির চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হয়েছে। এতে দেখা গেছে চেয়ারম্যান পদে ১২ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। এক উপজেলারই আছেন ১১ জন।
এ ছাড়া সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে সদস্য পদে ৩২ জন ও সাধারণ সদস্য পদে ১০০ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। সব মিলিয়ে এ ধাপে তিন পদে ১৪৪ জন ভোট ছাড়া জয়ী।
বিনা ভোটের ১২ চেয়ারম্যানের মধ্যে ১১ জনই কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার। এ ছাড়া সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের ৩২ জনের ৩১ জনও এ উপজেলার। আবার সাধারণ সদস্য পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ১০০ জনের ৯৩ জন এ উপজেলার। ফলে এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে কোনও ভোটেরও প্রয়োজন পড়বে না। সংরক্ষিত ৩৩টি ওয়ার্ডের মাত্র দুটিতে এবং সাধারণ সদস্যের ৯৯টির মধ্যে মাত্র ৬টিতে ভোটের প্রয়োজন হবে।
এর আগে প্রথম ধাপে ৩৬৪ ইউপির মধ্যে ৭১ জন চেয়ারম্যান ভোটের আগে নির্বাচিত হন। এ ধাপে সাধারণ সদস্য পদে ৭৪ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১২ জনসহ ১৫৭ জন বিনা ভোটে জয়ী হন।
দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৪টি ইউপিতে ৮১ জন চেয়ারম্যানসহ তিন পদে ৩৫৭ জন বিনা ভোটে জয়ী হন। এর মধ্যে সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৭৩ জন।
তৃতীয় ধাপে ১০০৮টি ইউপিতে ১০০ জন চেয়ারম্যানসহ ৫৬৯ জন প্রতিনিধি বিনা ভোটে জয়ী হন। এর মধ্যে সাধারণ সদস্য পদে ৩৩৭ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১৩২ জন।
চতুর্থ ধাপে ৮৩৬টি ইউপিতে ৪৮ জন চেয়ারম্যানসহ ২৯৫ জন বিনা ভোটে জয়ী হন। সাধারণ সদস্য পদে ১৩৫ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১১২ জন।
পঞ্চম ধাপে ৭০৭টি ইউপিতে ৪৮ জন চেয়ারম্যানসহ ১৯৩ জন জয়ী হন। এর মধ্যে সাধারণ সদস্য পদে ১১২ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৩৩ জন।
প্রসঙ্গত ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত নবম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সব মিলিয়ে ২১২ জন চেয়ারম্যান বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচন প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে বিএনপি অংশ নিলেও এবারে তারা অংশ নিচ্ছে না। এ ছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মোট ১০০ জন প্রার্থী ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের ইউপি নির্বাচনে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ সবগুলো পদে একক প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। একই অবস্থা কুমিল্লার লাকসাম উপজেলাতেও। লাকসামের ৫ ইউনিয়নের কোনোটিতেই ভোট হয়নি। চেয়ারম্যানের পাশাপাশি সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদের ৬৫ প্রার্থীও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ষষ্ঠ ধাপে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নেই বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন।
এ ছাড়া ১১ ইউপির অধিকাংশ ওয়ার্ড সদস্যও জয় পেয়েছেন ভোট ছাড়াই। সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১৪৩টি পদের মধ্যে ১২৯টি বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন।
২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনেও রাউজানের ১৪টি ইউপির মধ্যে ১১টিতে চেয়ারম্যান পদে বিনা ভোটে নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন।
চলমান ইউপি নির্বাচনে বাগেরহাটের ৭৪টির মধ্যে ৪৩টিতে, ফেনীর ৪১টি ইউপির মধ্যে ২১টিতে, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ১২টি ইউপির ১১টিতে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী হওয়ায় ভোটের প্রয়োজন পড়েনি।
ইসির তথ্যমতে দেশের মোট চার হাজার ৫৭৪টি ইউপির মধ্যে মামলা ও সীমানা বিরোধসহ অন্যান্য কারণে ৪৩৬টির ভোট হচ্ছে না। বাকি চার হাজার ১৩৮টি ইউপির তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ ধাপে তিন হাজার ৭৭৩টি ইউপির ভোট সম্পন্ন হয়েছে।
ষষ্ঠ ধাপে ২১৯টি ইউপির ভোট ৩১ জানুয়ারি হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া সপ্তম ধাপে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৩৮টি এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ৮টি ইউপির ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলের মনোনীত প্রার্থীরা ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজয়ের ঝুঁকি নিতে চান না বলেই বিনা ভোটে এত সংখ্যক জয়ী হয়েছেন।
মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তুলে বদিউল আলম বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গেলে তো খরচ করতে হয়। অনেকেই এই টাকা মনোনয়ন পেতে খরচ করেছে। একইসঙ্গে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যাতে করা না লাগে সে জন্য আরও অর্থ ঢেলে শক্তি প্রয়োগ করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠছাড়া করা হয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া নির্বাচন গঠতন্ত্রের জন্য সুখকর নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অতীতে আমরা সংসদ নির্বাচনেও এ রকম জয়ের রেকর্ড দেখেছি। কোনও দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস হলে এবং জনগণ নির্বাচন বিমুখ হলে এমনটা হয়। এটা দেশের গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিহীন নির্বাচন নতুন কিছু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা দেখা যায়। তবে এটা ঠিক এবার ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্তিায় নির্বাচিতের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। করোনার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কায় অনেকেই ভোটে আসেননি। এ ছাড়া বিএনপিসহ কিছু দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পাশাপাশি ভীতি সৃষ্টির কারণেও অনেকে ভোটবিমুখ হয়েছে।
এই রাজনীতিক আরও বলেন, এটা কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা ভাবতে হবে। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। অন্য যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদেরও আহ্বান জানাবো বিষয়টি চিন্তা করতে।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটের টার্নআউট ভালো ছিল। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। এভাবে পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচিত বলা যায় কী না সেই প্রশ্নও রাখেন এই কমিশনার।