ইতিহাস গড়ার পথে টাইগাররা

4

স্পোর্টস ডেস্ক :
শীতের ভোর কাটিয়ে বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমীরা আজ হয়ে যেতে পারেন একটি ঐতিহাসিক অর্জনের সাক্ষী। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে কোণঠাসা করে ফেলেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। বাক্যটি আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব- এমন বিপর্যস্তপরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে আর কখনই পড়েনি কিউইরা। চতুর্থ দিন শেষে ১৭ রানে এগিয়ে থাকলেও এবাদত হোসেনের দুর্ধর্ষ বোলিংয়ে চোখে বিভীষিকাময় কোন স্মৃতিতে পড়ার শঙ্কায় নিমজ্জিত। কারণ ১৩০ রানে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ৪৫৮ রানে শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে এখন পর্যন্ত ৫ উইকেট হারিয়ে ১৪৭ রান তুলতে পেরেছে। চতুর্থ দিন পড়ন্ত বিকেলে বিধ্বংসী এবাদত কিউইদের ০ রানেই ৩ উইকেট তুলে নিয়েই তাদের এমন বিপদে ফেলেছেন। তাই প্রথমবার বাংলাদেশের বিপক্ষে কিউইদের চোখ রাঙাচ্ছে পরাজয়। তাদের আশা আজ শেষদিন ইতিবাচক থেকে দুর্বার বাংলাদেশী বোলারদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে প্রতিরোধ গড়ার। আর এই টেস্টের নিয়ন্ত্রণ নেয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য দ্রুত কিউইদের বাকি ৫ উইকেট তুলে নিয়ে জয়ের স্বপ্ন পূরণ করা। গত বছর শেষ হয় প্রথম বিশ^ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ- যেখানে নিউজিল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয় আর বাংলাদেশ সবার নিচে থাকে। এবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় চক্রের শুরুতে ঘরের মাটিতে পাকদের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হয়ে শুরু করেছে বাংলাদেশ। তারপরই নিউজিল্যান্ড সফরে এসেছে কঠিন সময়ে। টানা হারের ব্যর্থতায় পর্যবসিত দল সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের মতো অভিজ্ঞ দুজনকে ছাড়াই কিউই ভূমিতে পা রেখেছে যেখানে আগে কখনও কোন ফরমেটে স্বাগতিকদের হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি ৯ টেস্ট খেলে কোন ড্র পর্যন্ত নেই। তবে অতীতের সব পারফর্মেন্সকে ছাপিয়ে এবার ভাল করার প্রত্যয় জানায় বাংলাদেশ দল। সেটি মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের প্রথম ৪ দিন শক্তিশালী কিউইদের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে বাস্তবতায় রূপ দিয়েছেন মুমিনুলরা। চতুর্থ দিন শেষে ১৭ রানে এগিয়ে গেছে নিউজিল্যান্ড, কিন্তু শীর্ষ ৫ ব্যাটার সাজঘরে ফেরায় তারা আছে চরম বিপদে। আজ সারাদিনই তাদের লড়াই এই ম্যাচে পরাজয় এড়ানোর। ৫ উইকেটে ১৪৭ রান তুলেছে তারা। একেবারে শেষবেলায় তারা এবাদতের এক বিভীষিকাময় স্পেলে শূন্য রানেই ৩ উইকেট খুঁইয়ে এমন বেকায়দায় পরিস্থিতিতে পড়েছে। অথচ তার আগে উইল ইয়াং (৬৯) ও রস টেইলর ৭৩ রানের জুটি গড়ে দারুণ জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন ম্যাচ বাঁচানোর বড় ভরসা হিসেবে টিকে আছেন অভিজ্ঞ টেইলর ইতোমধ্যেই ১০১ বল খেলে ৩৭ রান নিয়ে। তাকে উইকেট আঁকড়ে থেকে আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতিরোধ গড়তে সংকল্পবদ্ধ রাচিন রবীন্দ্র ৩০ বলে করেছেন ৬।
এমন কোণঠাসা হওয়ার কারণে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং কোচ লুক রনকি বললেন, ‘পুরোটাই রস ও রাচিনের সোজা ব্যাটে খেলার ওপর নির্ভর করছে। তারা যখন কিছুটা রিভার্স করাবে কিংবা বাড়তি গতি তুলবে তখন শুধু সোজা ব্যাটে খেলতে হবে। খুব খারাপ সময়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ উইকেট হারিয়েছি এটা করতে না পেরে। তাদের সিমাররা সোজা বল করেছে, কিছুটা রিভার্স করিয়েছে এবং কিছুটা নির্দিষ্ট ছন্দের বাউন্স দিয়েছে। আমাদের ইতিবাচক থেকে যতটা সম্ভব লম্বা সময় ব্যাট করতে হবে। তবে সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এই টেস্টের বেশিরভাগ অংশেই আমাদের ওপর শাসন করেছে।’ ১৩০ রানের বড় লিড পেয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে টেস্টের প্রথমে প্রতিপক্ষ দল ব্যাট করার পর ব্যাটিংয়ে নেমে দুইবার লিড পেয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৩ সালে গল টেস্টে ৬৮ রানে এগিয়ে গিয়ে ড্র এবং ২০১৭ সালে কলম্বো টেস্টে ১২৯ রানে এগিয়ে থেকে জিতেছিল। এবারই সর্বাধিক রানের লিড পেয়ে জিততে পারবে বাংলাদেশ? এ বিষয়ে ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ে এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশী পেসার হিসেবে ১২ বছরের মধ্যে সেরা বোলিংয়ের নজির গড়ে ৩৯ রানে ৪ উইকেট নেয়া এবাদত বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডে আমাদের আগের ম্যাচগুলোতে এত ভাল করতে পারিনি। এই দলটাই চাচ্ছে নতুন কিছু দিতে, নতুনভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে, দেশের জন্য ভাল কিছু করতে। এই দলের চেষ্টাই এটা যে বিদেশের মাটিতে জেতা শুরু করব। দেশে ও দেশের বাইরে দুই কন্ডিশনেই আমি খেলেছি। আমরা এখনও শিখছি কিভাবে দুই জায়গায় বল করা যায়। বল পুরনো হলে কিভাবে রিভার্স করা যায়। আমরা চেষ্টা করব আগামীকাল (আজ) যেন দেশকে জিতিয়ে আসতে পারি।’
কিউইদের আগে প্রথম ইনিংসে ৪৫৮ রানে থামে বাংলাদেশ। আগের দিন ৬ উইকেটে ৪০১ রানের সঙ্গে বাকি ৪ উইকেটে ৫৭ রান যোগ করে। এটি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ। এছাড়া এটি ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে টেস্টে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান। ১৭৬.২ ওভার ব্যাট করে টেস্টের এক ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বাধিক ওভার ব্যাট করার নজিরও স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। সকালে প্রথম ১ ঘণ্টা কিউই পেসারদের হতাশ করে ইয়াসির রাব্বি ও মেহেদি হাসান মিরাজ ৪০ রান তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরই ধস নামে। ১৩ রানের মধ্যেই ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ট্রেন্ট বোল্ট ৪টি ও নেইল ওয়াগনার ৩ উইকেট নেন। মিরাজ ৪৭ (৮ চার) ও ইয়াসির ২৬ রানে আউট হয়ে যান। তবে ১৩০ রানের বড় লিড নিয়ে স্বস্তিতেই থাকে বাংলাদেশ। সেই স্বস্তিটা বেড়েছে এবাদতের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। এখন আজ হতে পারে নতুন ইতিহাস। কিউইদের বিপক্ষে এর আগে ১৫ টেস্ট খেলে ৩ ড্র ছাড়া বাকি সব ম্যাচেই হেরেছে বাংলাদেশ। ৩ ড্র দেশের মাটিতে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এবার ম্যাচটিতে ড্র বা জয় যেটাই আসুক তা নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। উপমহাদেশের বাইরে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে ২ টেস্ট জয় ছাড়া আর কোন বড় সাফল্য নেই। সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাটি এবার বিশ^ টেস্ট চ্যাম্পিয়ন কিউইদের বিপক্ষে হতেও পারে বাংলাদেশের। তাই লিটন দাস বললেন, ‘কাল নতুন দিন। কাল উইকেটটা অতটা সহজ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। কারণ যত দিন যাচ্ছে, উইকেটের কিছু না কিছু কাজ করছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে যত কমে তাদের অল আউট করে দেয়া যায় এবং সেই রানটা চেইজ করা যায়। কারণ যত কম দিব ওই রানটা আমাদের চেইজ করতে হবে। খুব একটা সহজ হবে আমাদের ইনিংসটা সেটিও কিন্তু না। আমাদের অনেক পরিশ্রম করে ব্যাটিং হবে।’ চ্যালেঞ্জ একটি আসবে, তবে সেটিকে যত ছোট করা যায় ততই ভাল বাংলাদেশের জন্য। কারণ একজন ব্যাটার কম নিয়ে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। প্রথম ইনিংসে ৭৮ রান করা ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয় ফিল্ডিংয়ের সময় আঘাত পাওয়ায় ৩টি সেলাই পড়েছে আঙ্গুলে। তিনি ব্যাট করতে পারবেন না।