কুয়ালালামপুরের সঙ্গে অবশেষে চুক্তি সই ॥ বাংলাদেশী কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তাই বহন করবেন

1

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দীর্ঘ অপেক্ষা আর দেন দরবারের পর অবশেষে খুলে গেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। রবিবার সকালে কুয়ালালামপুরে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে খুলেছে এই বাজার। এ সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। এই চুক্তির ফলে দীর্ঘ তিন বছর পর আবারও বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত হলো।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বহুল প্রতীক্ষিত এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশী কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তাই বহন করবেন। এসব খরচের মধ্যে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় আনা, আবাসন, কর্মে নিয়োগ এবং কর্মীর নিজ দেশে ফেরত প্রেরণের খরচ ইত্যাদি। নিয়োগকর্তা নিজ খরচে মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্ট নিযুক্ত করতে পারবেন। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর বাংলাদেশী কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ইন্স্যুরেন্স সংক্রান্ত খরচ, করোনা পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টাইন সংক্রান্ত খরচসহ সব ব্যয় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা প্রতিষ্ঠান বহন করবে। নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বীমা, চিকিৎসা এবং কল্যাণও নিশ্চিত করবেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোঃ গোলাম সারোয়ার, মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, বিএমইটি মহাপরিচালক মোঃ শহীদুল আলম, শ্রম কাউন্সিলর মোঃ জহিরুল ইসলাম ও মোঃ হেদায়েতুল ইসলাম ম-ল এবং মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশী কমিউনিটি নেতাসহ উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দিতে মালয়েশিয়ার সরকার দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের অনুমতি দেয়। এদিনই ১০ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগে সমঝোতা স্মারকে সই করার জন্য দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান আনুষ্ঠানিক এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদকে আমন্ত্রণ জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতিক্রমে গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী। এ বিষয়ে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান বলেন, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশী কর্মী নেয়া শুরু হবে। এই শ্রমিকদের জন্য বাগান, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি ও খনন, নির্মাণ এবং গৃহপরিচারিকাসহ বিভিন্ন খাত উন্মুক্ত থাকবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মানুসারে মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুকদের সে দেশে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হতে পারে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, দীর্ঘ তিন বছর পর মালয়েশিয়া আবারও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া শুরু করবে। মন্ত্রীর নেতৃত্বে ও আমাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শ্রমবাজারটি পুনরায় উন্মুক্ত হয়েছে। সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন খাতে বহু বাংলাদেশী কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। করোনা সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার সঙ্গে সঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই আড়াই লক্ষাধিক কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে গত নবেম্বর মাসে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। বিদেশ গমনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ অর্থবছরে সাত থেকে আট লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হবে।
জানতে চাইলে বায়বার সাবেক সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, এটা অবশ্যই গোটা জাতির জন্য একটি সুসংবাদ। মালয়েশিয়া আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার। তিন বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর আবার খুলে গেছে। এজন্য উভয় দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এ শ্রমবাজার খোলায় জনশক্তি রফতানি খাতে নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা কিছু কমবে। আর বাড়বে রেমিটেন্স। করোনার কারণে গত দুই বছরে ধীর গতির অর্থনীতির চাকা আবার সচল হবে বলে আশা করছি। কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া সরকার যে প্রস্তাব দেবে আমরা সেটাই মেনে নেব। এখন পর্যন্ত আমরা কোন প্রস্তাব পাইনি। আশা করছি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আগের থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
উল্লেখ্য জনশক্তি রফতানিতে নানা অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। দীর্ঘ ৭ বছর বন্ধ থাকার পর মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী এই চুক্তির আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয় ১০টি জনশক্তি রফতানিকারক এজেন্সিকে। কিন্তু প্রবাসী এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র ওই ১০ এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে শ্রমিকদের কাছ থেকে দুই বছরে ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে।
এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে বাংলাদেশী কর্মীদের আর ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে আগে যারা ভিসা পেয়েছিলেন, তারা পরেও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পান।
এদিকে বিএমইটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়- দেশটিতে শ্রমের অনেক নির্ভরযোগ্য বাজার রয়েছে। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে দেশটিতে ৭০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী যান। বহুল আলোচিত জিটুজি প্লাস চুক্তি সইয়ের পর-২০১৭ এবং ২০১৮ সালে প্রায় পৌনে এক লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয় দেশটিতে।
মালয়েশিয়া সরকারের পছন্দ করা বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি এই কর্মীদের পাঠায়। আগে মালয়েশিয়ায় এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ করা হতো।
এর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাঠাত বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। আগামীতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আনবে। সরকারের কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না। কর্মীরা যেন প্রতারিত বা নির্যাতিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকার নরজদারি করবে। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচারারস জানায়, শিল্পখাতে আগামী বছর নাগাদ তাদের ছয় লাখের বেশি শ্রমিক লাগবে। রফতানিভিত্তিক কোম্পানিগুলোতে এই শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় সর্বনিম্ন মজুরি এক হাজার ২০০ রিঙ্গিত। যা বাংলাদেশী ২৪ হাজার ৪২০ টাকার সমপরিমাণ। ফলে বলা যায় বাংলাদেশী কর্মীদের বেতন এক হাজার ২০০ রিঙ্গিতের কম হবে না। কিন্তু ওই সময় দুই দেশের সমঝোতা অনুযায়ী সরকারীভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে খরচ হওয়ার কথা ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার টাকা। তবে ওই ১০ সিন্ডিকেট প্রত্যেকের কাছ থেকে কমপক্ষে চার লাখ টাকা করে নেয়। এতে করে কমবেশি দুই লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠাতে ওই সিন্ডিকেট আনুমানিক সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়।
প্রসঙ্গত বর্তমানে দেশে লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৮০০টি। এর মধ্যে এক হাজার ৩০০ জনশক্তি ব্যবসায় রয়েছে। বাকিদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও কর্মী নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনা হয়েছিল। তখন মালয়েশিয়ার প্রস্তাব ছিল সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০টি এজেন্সি কর্মী পাঠাবে। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল কমপক্ষে আড়াই থেকে তিনশ’ এজেন্সিকে যুক্ত করার।
এদিকে মালয়েশিয়ার পর গ্রিসের সঙ্গে একটি আগ্রহপত্র স্বাক্ষর করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী। একইভাবে আলবেনিয়া, মাল্টা ও বসনিয়ার সঙ্গেও কর্মী পাঠানোর জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন শ্রমবাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ এবং জাপান, সেনেগাল, বুরুন্ডি, সেশেলসে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে।