কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ ॥ মেয়র পদও হারাতে পারেন জাহাঙ্গীর আলম

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা কিংবা দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকা-ে কেউ জড়িত হলে তাকে আর কোন ধরনের ছাড় নয়। তিনি যত বড় মাপেরই নেতা-মন্ত্রী কিংবা এমপি হন, পেতে হবে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি। হতে হবে আইনের মুখোমুখিও। গাজীপুরের মেয়র এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তৃণমূল নেতাদের কাছে সেই মেসেজই পৌঁছে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। শুধু দল থেকে বহিষ্কারই নয়, চরম ক্ষুব্ধ দলটির হাইকমান্ড মেয়র পদ থেকেও জাহাঙ্গীর আলমকে সরাতে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দিকেও যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। ফলে দলের পর মেয়র পদও হারাতে পারেন আলোচিত-সমালোচিত তরুণ নেতা জাহাঙ্গীর আলম।
শুক্রবার আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির দায়ে গাজীপুরের মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। জানা গেছে, দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি গাজীপুরের মেয়রের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়েও প্রস্তুতি চলছে। ক্ষমতাসীন দলের এমন শক্ত অবস্থানে মেয়র পদ হারানো এখন জাহাঙ্গীর আলমের সময়ের ব্যাপার মাত্র। গাজীপুরের মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে দলের পক্ষ থেকে যে বার্তা দেয়া হয়, সেটি হলো ব্যক্তি যত শক্তিশালীই হোক, দলের আদর্শের পরিপন্থী হলে কেউ দলের জন্য অপরিহার্য নয়। এদিকে মেয়র জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়ার পর টঙ্গী ও গাজীপুরে অনেকে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে।
অপরদিকে দল থেকে বহিষ্কারের পর সাংবাদিকদের কাছে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বিমর্ষ গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘আমি নেত্রীর (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী) কাছে যাওয়ার চেষ্টা করব। রিভিউ করব। উনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আমার বক্তব্য নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে। ভুল আর অপরাধ তো এক নয়। আমার যে আদর্শ; বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। এ তিনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের জীবনে ভুল থাকতে পারে, ভুল হতে পারে। আমার কিছু কথা কেটে কেটে মিথ্যাচারসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি নেত্রীর কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করব।’
এদিকে শনিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগরের হ্যারিকেন এলাকায় নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিপক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তারা যেকোন মূল্যে আমাকে, আমার, পরিবারকে এবং আমার সমর্থকদের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্নভাবে পাঁয়তারা করছে। তারা কখনও আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে, কখনও আমাকে পরিকল্পিতভাবে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। গত নির্বাচন থেকে এই পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি না, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। যেহেতু আমাদের সভার যে প্রস্তাব- এটা তো বঙ্গবন্ধু, আমাদের ইতিহাসকে কটাক্ষ করে বক্তব্য। কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সে পরিপ্রেক্ষিতে সেটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অফিসিয়ালি জানানো হবে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও আইনপ্রণেতাদের মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম যে সংবিধানবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তার শপথ ভঙ্গ হবে না। কারণ, মেয়র পদটি সাংবিধানিক নয়। তিনি শপথ নিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করতে হলে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের মাধ্যমেই করতে হবে।
দল থেকে বহিষ্কার হলে সংসদ সদস্য পদ হারানো- না হারানো দুই রকম নজিরই আছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি এবারই প্রথম। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও মেয়র প্রার্থীরা দলের মনোনয়ন নিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেন। সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে দল থেকে বহিষ্কার হলে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে কী হবেÑ সেই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। দলীয় প্রতীকে সিটি মেয়র পদে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর নির্বাচিত কোন মেয়রকে তার দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা এই প্রথম। এ অবস্থায় শুধু দল থেকে বহিষ্কারের কারণে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদ হারাবেন কি নাÑ সেই প্রশ্ন উঠেছে।
আইনানুযায়ী, কোন ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত আমলে নিলে এবং অসদাচরণ প্রমাণ হলে মেয়রদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে। জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষেত্রে দল থেকে আইনী ব্যবস্থা নেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে দল কী ধরনের আইনী পদক্ষেপ নেয় তার ওপরও জাহাঙ্গীর আলমের ভাগ্য নির্ভর করছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধান না থাকলেও সরকার চাইলে সিটি কর্পোরেশনের একজন মেয়রকে অপসারণের অনেক পথ রয়েছে। অসদাচরণ বা অনৈতিক কর্মকা-ের জন্য মেয়রকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে পারেন।
এদিকে, শুধু দল থেকে বহিষ্কার নয়, ভবিষ্যতে দলের কেউ এমন ধরনের ধৃষ্টতা দেখাতে না পারে সেজন্য মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। যা শুক্রবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে অতিদ্রুত তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির পরিষ্কার হয়েছে। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, জাহাঙ্গীরকে শুধু দল থেকে বহিষ্কার নয়, মামলা করতে হবে। মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করতে হবে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি করে জাহাঙ্গীর আলম চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। সে আমাদের হৃৎপি-ে আঘাত দিয়েছে। তাই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যাতে আর কেউ জাতির পিতাকে নিয়ে কটাক্ষ করার সাহস না দেখায়।
আ ফ ম নাছিমের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি একই দাবি জানান। দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর আমাদের অস্তিত্বে আঘাত করেছে, এটা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, জাহাঙ্গীর আলম যে বক্তৃতা দিয়েছেন, তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারার লঙ্ঘন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করলে শাস্তির সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এছাড়া জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। বৈঠক শেষে অনেক সিনিয়র নেতাই জানান, শীঘ্রই জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। আর মামলা হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করবে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বলেন, ভবিষ্যতে এমন ধৃষ্টতা যাতে কেউ দেখাতে না পারে- জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থাই নেয়া হবে। এ সময় তাকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক শেষে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারের তথ্য জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে।’
কে এই জাহাঙ্গীর আলম : আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী তরুণ মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান পর্ব ছিল বেশ নাটকীয়। কৃষকের ঘরে জন্ম নেয়া ঝুট ব্যবসায়ী থেকে দ্রুত নগরপিতা হয়ে দ্রুতই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান তিনি। জনপ্রতিনিধি হয়েই উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেন জাহাঙ্গীর আলম। ক্ষমতা আর অর্থবৈভবের কারণে কাউকে তোয়াক্কা না করেই নিজের ইচ্ছামতো সিটি ভবন ও দল চালাচ্ছিলেন তিনি। সর্বশেষ গাজীপুর সিটির একচ্ছত্র অধিপতি হতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঝুট ব্যবসা করেই বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যান গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। নাটকীয় উত্থান ঘটলেও আকস্মিক পতনের আশঙ্কা থাকে। মেয়র জাহাঙ্গীর ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। তার কারণে বহু মানুষ তার নিজের জমি হারিয়ে কেঁদেছেন। তাদের অভিশাপ গ্রাস করেছে তাকে। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পর এখন তাকে নানা মামলায় জর্জরিত হয়ে আরও ভুগতে হবে বলেই তাঁরা মনে করছেন।
উল্লেখ্য, মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অগোচরে ধারণ করা এক অডিও গত সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই অডিও ভাইরাল হওয়ার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা জাহাঙ্গীরের বহিষ্কার দাবি করেন। এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে গাজীপুরে মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে কয়েক দফা।