জাতিসংঘে সর্বসম্মত রেজুলেশন গৃহিত ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ১০৭ দেশের পূর্ণ সমর্থন

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত প্রায় সাড়ে চার বছরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে এবং এ সঙ্কটের অবসানে মিয়ানমার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও সে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়েও মিয়ানমারের জান্তা সরকার রয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এ অবস্থায় মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানের তাগিদ দিয়ে জাতিসংঘ কমিটিতে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে জরুরী অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সে দেশের গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘে এবারই প্রথম গৃহীত সর্বসম্মত রেজুলেশনে এ সঙ্কটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটল।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত বুধবার ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনীত এ প্রস্তাব জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে (সোশ্যাল হিউম্যানিটারিয়ান এ্যান্ড কালচারাল) সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এমন প্রস্তাব পাস হওয়ার পর বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, চীন এবং রাশিয়াও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি একথা বলেন।
এদিকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক এ প্রস্তাবে প্রাথমিক দৃষ্টি দেয়া হয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সে দেশে জরুরী অবস্থা জারির পরের পরিস্থিতি নিয়ে। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নেয় সে দেশের সেনাবাহিনী। জারি করা হয় জরুরী অবস্থা। গ্রেফতার করা হয় শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের। এরপর থেকে মিয়ানমারজুড়ে চলছে অস্থিরতা, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ। ইতোমধ্যে সেখানে দমন নিপীড়নে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মিয়ানমারে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এ লড়াইয়ে ব্যাপক হারে যুক্ত হচ্ছেন সে দেশের নারী সম্প্রদায়। তাদের লক্ষ্য একটাই- স্বৈরশাসনের অবসান। আর এর জন্য গভীর জঙ্গলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নারীরা।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটি সর্বসম্মতভাবে বলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করতে হবে। মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ সংস্থার সকল মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দেয়ার জন্য মিয়ানমারকে আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, থার্ড কমিটির অনুমোদন পাওয়া প্রস্তাবে সাধারণ কমিশনকে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের নাগরিকদের গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেখাতে সে দেশের নিরাপত্তা ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সে সঙ্গে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং জরুরী অবস্থার অবসানের কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জানিয়েছে, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এবারের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১০৭ দেশ সমর্থন দিয়েছে। এ প্রস্তাব অনুমোদনের সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, জাতিসংঘে এবারই প্রথম সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো রোহিঙ্গা রেজ্যুলেশন, যা এ সঙ্কটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন। রাবাব ফাতিমা আরও বলেন, একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে এবারের রেজ্যুলেশন গৃহীত হলো, যা রোহিঙ্গাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে- যে জন্য তারা আশার পথ চেয়ে বসে আছে। রেজ্যুলেশনে রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মিয়ানমার, ইউএনএইচসিআর এবং ইউএনডিপির মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক নবায়ন ও এর কার্যকর বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান শুরু হয়। রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে হামলে পড়ে সেনা সদস্যরা। শুরু হয় তাদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেয়া। ধর্ষণসহ বর্বরতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায় সেনা সদস্যরা। এ অবস্থায় টিকতে না পেরে লাখে লাখে রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশমুখী হলে এদেশের সরকার তাদের আশ্রয় দেয়। জাতিসংঘের হিসাব মতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে আগে থেকেই ছিল চার লাখ শরণার্থী রোহিঙ্গা। সব মিলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি। এ ঘটনাকে ওই সময়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ নামে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ।
পরবর্তীতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে মিয়ানমার। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে তাদের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ^ব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশে^র বহু দেশের সরকার প্রধান, রাষ্ট্র প্রধান, রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধি সরেজমিনে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের ৩৪ শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত ঘটনা জেনেছেন।
উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল রোহিঙ্গাভারে জর্জরিত হওয়ায় সরকার নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে নবনির্মিত একটি আবাসন প্রকল্পে এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে সেখানে প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তরিত হয়েছে। শুরুতে এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার আপত্তি ছিল। কিন্তু তাদের প্রতিনিধিদের সরেজমিনে ভাসানচর ঘুরিয়ে দেখানোর পর তাদের ইতিপূর্বেকার অবিশ^াসের অবসান ঘটে। রোহিঙ্গাদের যে স্থানে রাখা হচ্ছে তা জাতিসংঘের নির্দেশিত পথরেখা অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে রোহিঙ্গাদের ক্ষতির মুখে পড়ার কোন অবকাশ নেই। এ অবস্থায় জাতিসংঘের পক্ষে ইউএনএইচসিআর উখিয়া টেকনাফের মতো ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করতে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল ভাসানচর ঘুরে এসে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। এরপর সর্বশেষ গত ১৭ নবেম্বর জাতিসংঘ প্রত্যক্ষভাবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ইউএনএইচসিআরের সহায়তার ১৩৭ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন মালামাল নিয়ে নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ ভাসানচরে পৌঁছে। নৌবাহিনীর টুনা তিমি নামের দুটি জাহাজযোগে এ মালামাল নিয়ে যাওয়া হয়। ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ চালানে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী রয়েছে। মালামাল রয়েছে এগারো ধরনের, যার মধ্যে রয়েছে স্লিপিং ম্যাট, কম্বল, প্লাস্টিক ত্রিপল, বালতি, জেরিকেন, সোলার ল্যাম্প, কিসেন সেট, ফিমেল হাইজিন কিট, লন্ড্রি সোপ, বার্থিং সোপ ও জুটব্যাগ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এ প্রস্তাব পাস হওয়ার পর বৃহস্পতিবার বলেছেন, জাতিসংঘে এই প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা রেজ্যুলেশন গৃহীত হয়েছে। রাশিয়া, চীন আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাধা দিত। তবে এবার তারা চুপ ছিল। তারাও এ সমস্যা দূর করতে চায়। বাংলাদেশ রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে এই ইস্যুতে আলাপ করেছে। সব দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তিনি আরও বলেন, এ রেজ্যুলেশনের রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এটা আমাদের জন্য এক বিরাট সুখবর।
এর আগে মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করার জন্য জান্তা সরকারের প্রতি নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ দেশ সর্বসম্মতভাবে আহ্বান জানায় গত ১০ নবেম্বর। এই ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের সম্মতি পাওয়া একটি বিরল ঘটনা।