মজুদদার : আইনী ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

10

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
উসমান (রা.) তাঁর খিলাফত কালে পণ্য মজুদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। আলী (রা.) মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর খিলাফাতকালে মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু মজুদদারি জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থী তাই ইসলামে তা নিষিদ্ধ। মজুদদারির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। কেননা এমন অনেক প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী রয়েছে যেগুলো পরিহার করে চলা যায় না। তাই ইসলাম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সুলভ মূল্যে বিক্রয় করার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। আর যে কোন ধরনের মজুদদারিকে জঘন্য ধরনের অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাসূলুল্লাহ (স.) থেকে শুরু করে খোলাফায়ে রাশেদীনসহ পরবর্তী সাহাবা কিরামগণ মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
মজুদদারির পরিণাম : যারা আল্লাহর সৃষ্টজীবকে কষ্ট দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে রাখে, তাদের জন্য আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। দুনিয়াতেও তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআন ও হাদীসে ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ কারুনকে তার ধন-ভাণ্ডার ও গৃহ-আসবাবসহ যমীনে দাবিয়ে দিয়ে শাস্তি দিলেন। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন”। “ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬০৬”
মজুদদারির প্রভাব : বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে। অর্থব্যবস্থার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে মজুদদারিতেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে রাখে। আবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি পণ্য মজুদ করে থাকে। তবে দুই অর্থব্যবস্থাতেই মজুদদারির পরিণতি ভয়াবহ। এ ছাড়াও আরো কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
ব্যক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়। কেননা প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হয় না এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় না। ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়।
অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ার আশংকায় আমদানীকৃত পণ্য সামগ্রী ধ্বংস করে দেয়া হয়। কেননা আমদানীকৃত পণ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে দ্রব্যমূল্য কমে যায়। মুনাফা স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা আগুনে পুড়িয়ে বা সমুদ্রে ফেলে পণ্য ধ্বংস করে। ফলে খাদ্যের মারাত্মক সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
মজুদদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইন শৃংখলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে।
মজুদদারি নিষিদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী : আল্লামা ইউসুফ কারযাভী বলেন, মজুদদারি দু’টি শর্তে হারাম। যথা- ১. এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে যার কারণে জনগণের তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। ২. মজুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অধিক মূল্য হরণ। যার ফলে মুনাফার পরিমাণ অবেক বেড়ে যাবে। “আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, অনু. মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামে হালাল হারামের বিধান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৬”
আল-মুগনী ওয়াশ মারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমাদ গ্রন্থকারের মতে তিনটি শর্তে মজুদদারি হারাম। যথা- ১. পণ্য ক্রয়কৃত হতে হবে। যদি পণ্য আমদানীকৃত হয় বা নিজস্ব উৎপাদিত হয়, আর তা মজুদ করে রাখে তাহলে ইহতিকার হিসেবে গণ্য হবে না। ২. পণ্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হতে হবে। সুতরাং মসলা, হালুয়া, মধু, যায়তুন, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য ইত্যাদি মজুদ করে রাখলে তা হারাম হবে না। ৩. পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নিপতিত হওয়া। এর আবার দু’টি পর্যায় রয়েছে- ক. ছোট শহর যেখানে পণ্য মজুদ করলে মানুষের কষ্ট হবে এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এমতাবস্থায় ইহতিকার হারাম। খ. পণ্য সামগ্রীর সংকট বা অভাবের সময় যদি কোন বণিকদল দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে আর ধনী লোকেরা দ্রুত তাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়, ফলে মানুষের মাঝে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে। আর যদি খাদ্য সামগ্রী বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে এবং কম মূল্যে ক্রয় করা যায়। আর এতে মানুষের কষ্ট না হয় তাহলে ইহতিকার হারাম হবে না।“মুয়াফ্ফিকুদ্দীন ও শামসুদ্দীন, আল-মুগনী ওয়াশ শারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৬”। আল-হিদায়া গ্রন্থকারের মতে, পণ্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য হতে হবে এবং মজুদদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকতে হবে। আর যদি কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে ইহতিকার করা নিষিদ্ধ নয়।“বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৪”
মজুদদারির বিধান : মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে মজুদদারি সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু হানাফী আলিমগণের মতে মজুদদারি মাকরূহ। রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থকার বলেছেন, মানুষ ও পশুর খাদ্যদ্রব্য মজুদ করার কারণে যদি সেখানকার অধিবাসীদের কষ্ট বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তাহলে মজুদ করা মাকরূহ। আর যদি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে মাকরূহ হবে না। “ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭১”
ইমাম গাযালী (র.) এর মতে, মজুদদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাগণের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি সমস্ত শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সকলেই এ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুদ করে রাখা পাপ।“ইমাম গাযালী, অনু. আব্দুল খালেক, সৌভাগ্যের পরশমনি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩”
ইহতিকার এর উদ্দেশ্য যদি হয় মাল আটক রেখে মূল্য প্রচুর বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করা এবং অন্যান্য প্রাণির কষ্ট দুর্ভোগ বিবেচনা না করে সম্পদ আটক রাখা তবে তা শরীয়তে জায়েয নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের উৎপাদিত প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী জমা করে বা দূরবর্তী এলাকা যেখান থেকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট এলাকায় খাদ্য সামগ্রী ও জরুরী জিনিসপত্র আসে না, সেখান থেকে ক্রয় করে এনে জমা করে রাখে বা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও জিনিসপত্র ছাড়া অন্য জিনিসপত্র যা মৌলিক প্রয়োজনে পড়ে না এমন জিনিস জমা রাখে, তাহলে সে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মজুদদার গণ্য হবে না।
তবে উল্লেখিত অবস্থায় যদি মানুষ কিংবা প্রাণির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সম্পদ আটক না রেখে ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করা ইসলাম ও মনুষত্বের দাবি। “আশ-শায়েখ নিজামুল হিন্দ আল-আলাম, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, সাহারানপুর: মাকতাবায়ে যাকারিয়া, তা.বি. খ. ৩, পৃ. ২১৩-১৪”
মজুদদারি নিষিদ্ধকরণে সরকারের কর্তৃত্ব : আলিমগণের সর্বসম্মত মত হলো, যদি সর্বসাধারণের উপর দুর্ভিক্ষের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে বা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দেয় এবং সর্বসাধারণের মাঝে হাহাকার লেগে যায়, তখন সরকার ন্যায্য মূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করতে মজুদদারদের বাধ্য করতে পারবে। বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে। অতি মুনাফার লোভে খাদ্য সামগ্রী আটক রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপরাধে সরকার ব্যবসায়ীকে শাস্তিও প্রদান করতে পারবে। ইমাম ইবনে আবেদীন র. তাঁর রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলেন, মজুদদারির কারণে দেশে খাদ্য শস্যের অভাবে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সরকার মজুদদার শ্রেণিকে তাদের প্রয়োজনীয় খোরাকী রেখে অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদ ন্যায্য মূল্যে বাজারজাত করতে নির্দেশ প্রদান করবে। সরকারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে দেশের সকল হাট-বাজারে সুলভ মূল্যে তাদের গুদামজাত খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করবে। এমনকি অভাবের কারণে জনগণ নগদ মূল্য পরিশোধ করতে অক্ষম হলে তাদের সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত মেয়াদ ধার্য করে বাকীতে খাদ্য হস্তান্তর করবে। পরে তাদের হাতে খাদ্য শস্য আসলে সরকার তাদের নিকট থেকে তা উসূল করে দাতার নিকট পৌঁছি দিবে। “ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭১”
প্রচলিত আইনে যা বলা হয়েছে : East Bengal Act এর আওতায় অত্যাবশকীয় কিছু পণ্যের সরবরাহ, বিতরণ এবং মজুদ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৩ সালে The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act,  ১৯৫৩ শিরোনামে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয। এই আইনের অধেিন অত্যাবশকীয় পণ্য বলতে The Control of Essential Commodities Act,  ১৯৫৬ এর ধারা ২ এ উল্লেখিত পণ্যসমূহকে বুঝানো হয়েছে। ধারা ৮ অনুযায়ী কোন ব্যবসায়ী সরকার কর্তৃক দেয় পূর্ব কর্তৃত্ব ছাড়া কোন ব্যক্তির কাছে কোন অত্যাবশকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না।  The Essential Artilcles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, 1953

The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, ১৯৫৩ এর ধারা ৩ অনুযায়ী সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সময়ে সময়ে খুচরা, পাইকারি বা অন্য কোন ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থাভেদে বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। জনগণের সুবিধার্থে সরকার ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যের নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবে। ব্যবসায়ীগণ সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদও সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে। “ The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, 1953 ” যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করে তবে সে The Hoarding and Black Market Act, ১৯৪৮ এর ৩নং ধারার অধীনে শাস্তি যোগ্য অপরাধী বিবেচিত হবে। 

The Control of Essential Commodities Act,  , ১৯৫৬ অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পণ্যকে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অতি জরুরী বলে ঘোষণা করতে পারে এবং অন্য যে কোন পণ্যের উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ, ব্যবহার এবং ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ আইনের আওতায় কিছু পণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রদান এবং মূল্য নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। “ The Control of Essential Commodities Act, ১৯৫৬ এর ৩নং ধারা” ধারা ৬ অনুযায়ী উক্ত আইন ভঙ্গকারীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। (অসমাপ্ত)