‘বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলন’ উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী ॥ আমরা ইচ্ছে করলে সবই করতে পারি

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি বাড়াতে বিশ্ব বাজারে নতুন নতুন পণ্য তুলে ধরার জন্য গবেষণায় গুরুত্ব বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে ব্যবসায়িক যোগাযোগের একটি সেতুবন্ধন হিসেবেই গড়ে উঠবে। যেসব ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবেন তারা এখান থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার ধরারও একটা সুযোগ পাবেন। তাঁর সরকার সেভাবেই দেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছে। গত প্রায় তেরো বছরে তাঁর সরকার দেশের প্রতিটি খাতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ‘রোল মডেল’। মঙ্গলবার রাজধানীর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সপ্তাহব্যাপী ‘বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২১’ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের চাহিদা থাকে; আর বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, আমরা ইচ্ছে করলেই পারি। সব কিছুই করতে পারি। এই আত্মবিশ্বাস আমার আছে, যেটা জাতির পিতা বলে গেছেন।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, নতুন নতুন আরও কী কী পণ্য আমরা উৎপাদন করতে পারি এবং রফতানি করতে পারি, সে বিষয়ে গবেষণা করে বের করতে হবে। কোন কোন দেশে কী কী পণ্যের চাহিদা রয়েছে সেটা অনুধাবন করে সেই পণ্য যেন আমরা উৎপাদন করতে পারি, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবেন তারা যে শুধু বাংলাদেশ পাবেন তা কিন্তু নয়। তাদের দক্ষিণ এশিয়ার এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার ধরার এবং রফতানি করার একটা সুযোগ থাকবে। তাঁর সরকার সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ এবং আকাশপথ- সব যাতে উন্নত হয় তার ব্যবস্থা নিচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এই আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সম্মেলন আয়োজন করেছে। সপ্তাহব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশে^র ৩৮টি দেশের ৫৫২টি উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) হল অব ফেমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এবং বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিনও সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সম্মেলনের ওপর একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন পরিবেশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী উদ্যোক্তা এবং অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সাতদিনের এই সম্মেলন আমাদের দেশের জন্য সম্ভাবনাময় ৯টি খাত যেমন- অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি ও ফিনটেক, চামড়া, ওষুধ, স্বয়ংক্রিয় ও ক্ষুদ্র প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাট-বস্ত্র শিল্পসহ অতি চাহিদা সম্পন্ন ভোগ্যপণ্য উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেছে যা সময়োপযোগী।
‘বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এর মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের নতুন নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে, রফতানি বৃদ্ধি পাবে এবং কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ সক্ষম হবে- এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এই সম্মেলনের মাধ্যমে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশী-বিদেশী শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে এসব খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী পণ্যের নব নব দ্বার উন্মোচিত হবে। রফতানি বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারী খাতের সবাইকে এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, নতুন নতুন পণ্য আরও কী আমরা উৎপাদন করতে পারি এবং আমরা রফতানি করতে পারি- সেটাও গবেষণা করে বের করতে হবে। সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে এবং কোন কোন দেশে কী কী পণ্যের চাহিদা রয়েছে সেটা অনুধাবন করে সেই পণ্য আমরা বাংলাদেশে উৎপাদন করতে পারি কিনা, সেটা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। কাজেই আমাদের যারা ব্যবসায়ী বন্ধু রয়েছেন বিশেষ করে বেসরকারী খাতে- তাদের প্রতি আমি অনুরোধ জানাব আপনারা এই বিষয়টার দিকে বিশেষভাবে নজর দিবেন। কারণ, আমাদের রফতানি পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
সরকারপ্রধান বলেন, কোন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ কতটা উন্নত তা বোঝাতে বিশ্বব্যাংকের ‘ইস অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স’ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ২০১৯ সালে এই ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের ১৭৬ হতে ১৬৮-তে উন্নীত হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যবসার বিভিন্ন সূচক উন্নয়নে বিশ্বের সর্বোচ্চ ২০টি সংস্কারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উক্ত ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে অর্থাৎ ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনার জন্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিশেষায়িত দল গঠন করে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগ সংক্রান্ত সকল সেবা সমন্বিত করে একই প্লাটফর্ম হতে প্রদানের জন্য ২০১৯ সাল হতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ (ওএসএস) পোর্টাল ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। সেই থেকে বিভিন্ন সংস্থার বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবাসমূহ উক্ত পোর্টালে পর্যায়ক্রমে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, তঁঁর সরকার বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার করার জন্য আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোতে ২৩টি বাণিজ্যিক উইং খুলেছে। দ্বিপাক্ষিক (বিপিটিএ) ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (আরপিটিএ), মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ) সম্পাদনের লক্ষ্যে ২৩টি দেশের সঙ্গে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশে^র ৩৮টি দেশে একতরফা শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক জোটের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি- যেমন আঙ্কটাড, ইউএন-এস্কাপ, ইউরোপীয় কমিশন, ডি-৮, বিমসটেক, আফটা ইত্যাদি। তিনি বলেন, গত প্রায় তেরো বছরে তাঁর সরকার দেশের প্রতিটি খাতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ‘রোল মডেল’।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘এসডিজি প্রোগ্রেস এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি’ প্রসঙ্গে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আশা করি ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী আমরা ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম হব। ইতোমধ্যেই দেশে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে এবং ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে। আর সাড়ে ৪ কোটির বেশি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় এনেছি। ‘প্রযুক্তি বিভেদমুক্ত’ বাংলাদেশ গড়ায় অনন্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ১২ কোটি।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আগামী প্রজন্ম পাবে জাতির পিতার স্বপ্নের আত্মমর্যাদাশীল, উন্নত এবং সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। তাঁর সরকার এই ছোট্ট ভূখ-ের বৃহৎ জনসংখ্যার দেশটাতে যোগাযোগ ও কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং উন্নয়নের ৯০ ভাগ কাজই নিজস্ব অর্থায়নে করছি।
সরকারপ্রধান বলেন, মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করেছি এবং দ্বিতীয় স্যাটেলাইটও তৈরি শুরু হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল এবং পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজেও আমরা বহুদূর অগ্রসর হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কাজ করে যাচ্ছে দেশের উন্নয়নের জন্য। যদিও করোনায় আমাদের অগ্রগতিটা থেমে গেল। যদি করোনা মহামারীটা না হতো তাহলে হয়ত আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। করোনা মহামারী মোকাবেলায় আমার দেশের মানুষের যাতে কষ্ট না হয় বা ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে থমকে না যায়, এ জন্য প্রায় এক লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছি। এমনকি যাতে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারেন, আবার মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট পায় সেদিকে লক্ষ্য আমরা রেখেছি। এখন আমরা টিকা দেয়াও শুরু করেছি। মানুষকে সুরক্ষা দেয়াটা আমাদের কর্তব্য।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। শুধু তাৎক্ষণিক কী করা সেটা নয়। সরকার গঠনের পর থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল আশু করণীয় কী, মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা। সেভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি বলেই আজকে আমাদের এ সাফল্য এসেছে। আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করেছিলাম ২০১০-২০২১। আর এখন আমরা করেছি রূপকল্প-২০৪১ অর্থাৎ ২০২১ থেকে ২০৪১ সালের বাংলাদেশ কেমন হবে, কিভাবে আমরা উন্নত করব- এরই ভিত্তিতে আমরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি দেশকে।