জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ॥ চন্দ্রিমায় জিয়ার লাশ নেই খালেদা জিয়া-তারেক সহ বিএনপি নেতারাও জানেন

6
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে যুক্ত হয়ে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আবারও খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী উল্লেখ করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য সফল হতে দেয়া হবে না। আর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ যে নেই, তা খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতারাও ভাল করে জানেন, তাহলে বিএনপি এত নাটক করে কেন? আর জিয়াউর রহমানই ছিলেন খন্দকার মোশতাকের মূল শক্তির উৎস। কারণ ক্ষমতা দখল করতে আর হত্যাকান্ড চালাতে নিশ্চয়ই সামরিক বাহিনীর কিছু সহযোগিতা দরকার। তাই মোশতাক-জিয়া মিলেই এই চক্রান্তটা (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড) করেছিল।
বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত স্মরণ সভায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শুধু এইটুকু চাই, যারা ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতির পিতাকে ১৫ আগস্ট হত্যা করেছে, তাদের উদ্দেশ্য তো ছিল বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্জন ব্যর্থ হোক, স্বাধীনতার আদর্শ ধ্বংস হয়ে যাক- সেটাই করতে দেব না। যে নাম তারা মুছে ফেলেছিল, আজকে আল্লাহর রহমতে সেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখন আর কেউ তা মুছতে পারবে না।’
সম্প্রতি চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কথিত সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিএনপিকর্মীদের সংঘর্ষে জড়ানোর দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে গিয়েও যে মারামারী করল বিএনপি, বিএনপি জানে যে সেখানে জিয়ার কবর নাই। জিয়া নাই ওখানে। জিয়ার লাশ নাই। তারা তো ভালোই জানে। তাহলে এত নাটক করে কেন? আর খালেদা জিয়াও ভালভাবে জানে। খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া কি বলতে পারবে যে তারা তার স্বামী বা বাবার লাশ দেখেছে? বাস্তবতা হলো বুলেটে জর্জরিত লাশও সহজেই শনাক্ত করা যেত। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে যে বাক্সের মধ্যে লাশ আনা হয়েছিল সে বাক্সের মধ্যে কেউ জিয়ার লাশ দেখতে পায়নি। তারা কি দেখেছে কখনও? কোন একটা ছবি দেখেছে কেউ? দেখেনি। কারণ ওখানে কোন লাশ ছিল না।’
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচির সঞ্চালনায় স্মরণ সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফী, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুরুল আমিন রুহুল, উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খান, দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কাজী মোর্শেদ কামাল, উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোঃ মতিউর রহমান মতি, দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আকতার হোসেন, উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক রানা প্রমুখ।
জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান কোথায় কোন গ্রাউন্ডে যুক্ত করেছেন তার কিন্তু কোন ইতিহাস নেই, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা জিয়াউর রহমানের নাম দিয়েছিল ‘মিস্টার রিট্রিট’। অনেকের কাছে গল্প শুনেছি, যেখানে যুদ্ধ লাগত তার অন্তত তিন মাইল দূরে গিয়ে জিয়াউর রহমান থাকবেন। তিনি কখনও সামনা-সামনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। নেতৃত্ব দেয়া হয়েছিল কিছু দিনের জন্য। এভাবেই জিয়াউর রহমানকে পেয়েছিল খন্দকার মোশতাক।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বেই কখনও বিশ্বাস করতেন না। তাঁকে ধরে এনে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরও জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত অস্ত্র পাঠানো হয়েছিল সোয়াত জাহাজে, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে সেই জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন।
চন্দ্রিমা উদ্যানে কথিত জিয়াউর রহমানের মাজার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ওখানে একটা বাক্স আনা হয়েছিল। আর সেখানে ওই বাক্সের ফাঁক থেকে যারা দেখেছে একটু, সেই এরশাদের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ) মুখ থেকেই শোনা, কমব্যাট ড্রেস (সামরিক পোশাক) পরা ছিল। কারণ জিয়াউর রহমান তো তখন প্রেসিডেন্ট। তখন তো তিনি কমব্যাট ড্রেস পরেন না। এটা কি বিএনপির লোকেরা জানে না? তাদের সেখানে গিয়ে মারামারি, ধস্তাধস্তি করার চরিত্র তো এখনও যায়নি।’ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর দেশের কোন উন্নয়ন হয়নি বরং দেশ পিছিয়ে যায় উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারা দেশের কোন উন্নতি করেননি। তাদের শাসনামলে, বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া এবং দেশটাকে একেবারে শেষ করে দেয়ার চক্রান্ত হয়েছিল।
ওই সময় আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার, অত্যাচার, নির্যাতন হয়েছিল জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জিয়া নাকি গণতন্ত্র দিয়েছেন। যে দেশে প্রতিরাতে কার্ফু থাকে সেটা আবার গণতন্ত্র হয় কিভাবে? ভোট চুরি থেকে শুরু করে সবকিছুই কিন্তু এই জিয়াউর রহমান শুরু করেছেন এবং সংবিধান লঙ্ঘন করা সেটাও জিয়াউর রহমান করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, হাইকোর্টের একটা রায়ে জিয়ার ক্ষমতা দখল, এরশাদের ক্ষমতা দখল, মার্শাল ’ল দিয়ে যে ক্ষমতা দখল, সেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার সদস্য খন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার চক্রান্ত করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই (জিয়াউর রহমান) ছিল তার (খন্দকার মোশতাক) শক্তি, মূল শক্তির উৎস। কারণ ক্ষমতা যদি এভাবে দখল করতে হয়, হত্যাকাণ্ড যদি চালাতে হয় তাহলে সামরিক বাহিনীর নিশ্চয়ই কিছু সহযোগিতা তার দরকার ছিল এবং সেই মোশতাক-জিয়া মিলেই কিন্তু এই চক্রান্তটা করেছিল।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, খুনী মোশতাক জিয়াউর রহমানের ওপর নির্ভর করে যে রাষ্ট্রপতি হয়েছিল, আপনারা যদি একটু লক্ষ্য করেন, সে কতদিন থাকতে পেরেছিল? থাকতে কিন্তু পারে নাই। মীরজাফরও পারে নাই। মীরজাফর সিরাজউদদৌলার সঙ্গে বেইমানি করে নবাব হয়েছিল, কিন্তু তিন মাসও পূর্ণ করতে পারে নাই। কারণ বেইমানদের ব্যবহার করে সবাই। কিন্তু তাদেরকে বিশ্বাস করে না, রাখেও না। ঠিক জিয়াউর রহমান সেই কাজ করেছিল। খুনী মোশতাকও কিন্তু তিন মাস পূর্ণ করতে পারে নাই। তাকেও বিদায় নিতে হয়েছে।
জেল হত্যাকান্ডের সঙ্গেও জিয়াউর রহমান জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলাখানায় যে হত্যাকান্ড হয়, সেটাও জিয়াউর রহমানের নির্দেশ হয়েছে, সে-ই করেছে। কারণ সে তখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং সে এতই মোশতাকের আস্থাভাজন ছিল যে, মোশতাক নিজেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু জিয়াউর রহমানকেই সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়।
জাতির পিতাকে হত্যার আগে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হচ্ছে, এটা শোনা গেলেও বঙ্গবন্ধু কখনই তা বিশ্বাস করতেন না জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তাঁকে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এমনকি ইন্দিরা গান্ধী নিজেও বলেছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ওরা আমার ছেলে, আমার সন্তানের মতো। ওরা আমাকে কেন মারবে? উনার একটা অন্ধ বিশ্বাস এদেশের মানুষের ওপর ছিল যে, উনার গায়ে কেউ হাত দেবে না, কেউ মারবে না। কিন্তু যারা ঘরের, সেখান থেকেই ষড়যন্ত্র।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড এবং পরবর্তী বিভিন্ন জনের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সেইদিন (১৫ আগষ্ট) বাংলাদেশে এ ঘটনার পর এটা ঠিক যে, এই রকম একটা ঘটনার পর আমাদের দল, সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা ছিল, তা হয়তো তাঁরা করতে পারেনি। কিন্তু এটা আপনারা জানেন যে, যখনই আক্রমণ শুরু হয়, প্রথমে যেমন সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় বা শেখ মনির বাসায়। খবরটা আসার সঙ্গে সঙ্গে এবং আমাদের বাসায় যখন গুলি শুরু হয় বঙ্গবন্ধু কিন্তু সবাইকে ফোন করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হয়, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে কথা হয়, সেনাপ্রধান শফিউল্যাহ’র সঙ্গে কথা হয়। সেনাবাহিনীরও যার যা ভূমিকা ছিল তাঁরাও কিন্তু সঠিকভাবে করে নাই। এর পেছনে রহস্যটা কী সেটাই কথা।
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাবা, মা, ভাই-বোন সব হারিয়ে যেদিন বাংলার মাটিতে পা দিলাম, আমাকেও তো আসতে অনেক বাধা দিয়েছে। তারপরও জোর করে যখন আসলাম, দেশে ফিরে আমি সেই চেনামুখগুলো পাইনি। বরং দেশে এসে আমি কবর পেলাম। তখন আমি পেয়েছি লাখো মানুষ আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের ভালবাসা, তাদের আস্থা ও বিশ্বাস।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এজন্য আমি বলতে পারি আওয়ামী লীগ আমার পরিবার। বাংলাদেশটাই আমার পরিবার। আমি সেইভাবেই বাংলাদেশের মানুষকে দেখি। আমি যেটুকু কাজ করতে পারব, মনে হয় আমার আব্বা, আম্মা তাঁরা দেখবেন, নিশ্চয়ই দেখবেন, দেখেন। হয়তো তাদের আত্মাটা শান্তি পাবে। আমি সেই চিন্তু করেই সব কাজ করি। এজন্য আমার কোন মৃত্যুভয়ও নেই, কোন আকাক্সক্ষাও নেই, কোন চাওয়া-পাওয়ারও কিছু নেই। আমার জন্য আমি কিছু করব? করতেও চাই না।’
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদর্শ নিয়ে যদি একটা সংগঠন করা যায় তাহলে সেই সংগঠনই মানুষকে কিছু দিতে পারে। আজকে করোনার সময়ে কারা মানুষের পাশে আছে? আর কত দল শুধু বিবৃতি, বক্তৃতাই দিয়ে যাচ্ছে। কারণ আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, প্রাইভেট টেলিভিশন করে দিয়েছি, প্রাইভেট রেডিও করে দিয়েছি। একটা অবাধ সুযোগ আছে সবার কথা বলার। কথা বলেই যাচ্ছে। কিন্তু মাঠে কয়টা মানুষ আছে? মানুষের পাশে কে আছে? দুঃসময়ে কে দাঁড়াচ্ছে? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই দাঁড়াচ্ছে। কারণ এটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শিক্ষা।